Sambad Matamat

তসলিমা নাসরিন ও তথাগত রায়ের সাথে আড্ডা? ‘ময়মনসিংহী’ শব্দটি তসলিমার জন্যে যথার্থ

দুই মেরুর দুইজন। একজন নারী, একজন পুরুষ। একজন বাংলাদেশী, একজন ভারতীয়। একজন দেশে সমাদৃত, অন্যজন দেশ থেকে বিতাড়িত। দু’জনই লেখক, উচ্চশিক্ষিত, জ্ঞানীগুণী, সজ্জ্বন। দু’জনের মধ্যকার সম্পর্ক চমৎকার। একজন তসলিমা নাসরিন, অন্যজন ত্রিপুরার গভর্নর ডঃ তথাগত রায়। একজন ডাক্তার, অন্যজন ইঞ্জিনিয়ার। দু’জনকে একত্রে, একমঞ্চে দেখলাম, শুক্রবার ১৩ই জুলাই, নিউইয়র্কের এক আড্ডায়। আড্ডাই বলবো, যদিও আলোচনায় বাংলাদেশ, ভারত বা অন্যকিছু এসেছে। অভ্যগতরা মূলত: বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাঙ্গালী, গুটিকয় অবাঙ্গালী।

অনুষ্ঠান ছিলো শুধুমাত্র নিমন্ত্রিতদের জন্যে। সব বাংলাদেশী নিমন্ত্রিত নন, কারণ তসলিমার নিরাপত্তা। সব বাংলাদেশী তার বন্ধু নন? উল্টাপাল্টা নিউজ তো আছেই! ক’দিন আগে তিনি মুক্তধারার বইমেলায় এসেছিলেন। মিনিট কুড়ি ছিলেন, অংকুর প্রকাশনীর ষ্টলে বসেছিলেন। ব্যস, নিউজ। কথা হয়েছিলো তার সাথে, একান্তই সৌজন্যমূলক, কেউ ছবি তুলেছেন, সেটা সর্বত্র ছাপা হয়েছে। বিখ্যাত মানুষজন নিয়ে এই এক যাতনা। তসলিমাকে অনেকেই গালি দেন, তারাও কিন্তু তার সাথে ছবি তুলতে আগ্রহী। আবার অনেকে গালি দিয়ে লিখেন, যদি তার লেখাটি ছাপা হয়?

এই আড্ডার আয়োজন কলকাতার বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর। ক’দিন আগে বঙ্গ সম্মেলনে এসেছিলেন ডঃ তথাগত রায়। সেখানেই দু’জনকে নিয়ে বৈঠকের কথাবার্তা। বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী ফোন দেন তসলিমা নাসরিনকে। তিনি ধরেন। চক্রবর্তী ফোনটি হস্তান্তর করেন তথাগত রায়ের কাছে। পাশ থেকে শুনলাম, ফোন ধরেই গভর্নর তসলিমাকে বললেন, ‘কেমন আছো ময়মনসিংহী’? অবাক হলাম, ময়মনসিংহী শব্দে! এই শব্দ আগে শুনিনি। যাকে ঐ সম্বোধন করা হয়েছে, তার জন্যে এটি যথার্থ, বিশেষত: ‘সিংহী’ শব্দটি। ড: রায় এই অনুষ্ঠানেও তসলিমার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। বললেন, ‘আমি ওকে ময়মনসিংহী বলি, কারণ ও একা সিংহের মত ফাইট করে যাচ্ছে। অথচ বাংলায় ওর ঠাঁই নাই, আপনারা ওর পাশে থাকবেন’।

তিস্তা নিয়েও ত্রিপুরার গভর্নর অনেক কথা বললেন। শুধু তিস্তা নয়, সব নদীর জল নিয়ে কথা বললেন। বললেন, আন্তর্জাতিক নিয়ম হচ্ছে, ভাটির অঞ্চলকে জল দিতে হবে। বাংলাদেশ ভাটি বা নিন্মাঞ্চলে, তার জল পাওয়ার অধিকার আছে। অথচ মমতা বললেন, ‘আমাদের জলের অভাব আছে’। ড: রায় বললেন, অভাব থাকলে, অভাবের মধ্যেও শেয়ার করতে হবে। বাংলাদেশের হিন্দুদের সমস্যা তার নখদর্পনে। বললেন, গতকালও বরিশালে একটি মন্দির ভেঙেছে। তিনি বললেন, এসব বন্ধ হবেনা, যদিনা, পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা বাংলাদেশের হিন্দুদের পক্ষে কথা বলে? তসলিমা নাসরিন অবশ্য এ জায়গাটায় সামান্য দ্বিমত পোষণ করে বললেন, ‘দাদা, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কথা বললেও এ সমস্যার সমাধান হবেনা, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষদের কথা বলতে হবে, অমুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

দু’জনের কথাবার্তার সময় হাততালির কমতি ছিলোনা। দিল্লিতে বিজেপি সরকার কখনো কখনো বাংলাদেশের হিন্দুদের চেয়েও বেশি আওয়ামী লীগার হয়ে যায়, এমত এক প্রশ্নের জবাবে ত্রিপুরার গভর্নর বলেন, ভারতকে মোটামুটিভাবে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি, এ দু’টো দলের একটিকে সমর্থন দিতে হবে, ভারত কোনটিকে দেবে? হাউস থেকে বলে, আওয়ামী লীগকে। তথাগত রায় বলেন, বিষয়টি সেখানেই, বিকল্প নেই? তিনি বলেন, ভারত চায়, বাংলাদেশ চীন ও পাকিস্তানের সাথে দহররম-মহররম না করুক। ভারত ট্রানজিট চায়, কারণ এতে পূর্বাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ সুবিধা হয়। ড: রায় আরো বলেন, প্রতিবেশী হিসাবে ভারতের নজর বেশি পাকিস্তান ও চীনের প্রতি; দিল্লিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বন্ধু হিসাবে, তাই ততটা সময় দেয়না। এ সময় হাউজ থেকে কেউ একজন বলেন, গুরুত্ব না দিলে বাংলাদেশ একসময় বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দেবে।

এ জায়গাতেও তসলিমা নাসরিন কিছুটা ভিন্ন সুরে কথা বলেন। তারমতে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’র মধ্যে তেমন কোন তফাৎ নেই? সবদলই সমান। আওয়ামী লীগ এর ইসলামী সংস্করণ, ওলামা আওয়ামী লীগ খুলেছে, এরা সাম্প্রদায়িক এবং সংখ্যালঘুদের বিপক্ষে। তসলিমা এসময় ব্লগার হত্যার প্রসঙ্গ টানেন। তারমতে শুধু সংখ্যালঘু নয়, মুক্তমনাদেরও বাংলাদেশে ঠাঁই নাই।

ডঃ রায় রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গও টেনেছেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্যে সমস্যা, ভারতের জন্যেও, কারণ এরা ভারতে ঢুকতে চাইবে। আরো বলেন, দোষ যে শুধু বার্মার তা নয়, রোহিঙ্গারাও ‘আরসা’ গঠন করে সৌদি মদতে বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছিলো। এ সময় তিনি বাংলাদেশে জনসংখ্যার চাপের উদৃতি দেন।

আড্ডায় বাংলাদেশের কথা বেশি এসেছে, কারণ বাংলাদেশিরা মাইক বেশি পছন্দ করে, তারা আগেভাগে অনেক কথা বলেছেন। কলকাতার দাদাদের জোর করেও মাইক দেয়া যায়না! তারা শুনতে বেশি আগ্রহী। তবে অনুষ্ঠানে তসলিমা কম কথা বলেছেন, সারাক্ষন সবার কথা শুনেছেন, আর হেসেছেন, কারণ সেখানে তার ভক্তের সংখ্যা ছিলো অনেক। তবে ড: রায় ও তসলিমার কথা মানুষ মন্ত্রমুদ্ধের মতোই শুনেছেন।

শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।

১৪ জুলাই ২০১৮। নিউইয়র্ক।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published.