রাখাইনকে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করার প্রচারণায় খুশি হওয়ার কোন কারণ নেই 1 ওই অঞ্চল নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র চলছে।
মার্কিন কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড সারমেন’র একটি বক্তব্য নিয়ে এ সময়ে বেশ আলোড়ন হচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘রাখাইনকে বাংলাদেশের অংশ করলেই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে’। প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, মার্কিন কংগ্রেসম্যানের বক্তব্য আদৌ কোন গুরুত্ব বহন করে কিনা? ঢাকা, কলকাতা ও অন্যত্র এই সংবাদ বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। এটি মার্কিন সরকারের অবস্থান নয়, কংগ্রেসের প্রস্তাবও নয়? বাংলাদেশ এ নিয়ে সরকারিভাবে কোন কথা বলেনি। তবে তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেছেন, এটি হয়তো কংগ্রেসম্যানের নিজস্ব প্রস্তাব, কংগ্রেস তা গ্রহণ করেনি। এ নিয়ে তিনি এরবেশি কিছু বলতে চাননি। ভারতের ইকোনোমিক টাইমস পত্রিকা মিয়ানমার সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে বলেছে যে, এই প্রস্তাব একটি দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অশ্রদ্ধা, অবাস্তব, অমূলক।
কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড সারমেন আসলে কি বলেছিলেন ? এনআরবি নিউজের ভাষ্যমতে তিনি বলেছেন, ‘লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আশ্রয় দেয়ায় আমি বাংলাদেশকে অভিবাদন জানাচ্ছি। আমি কংগ্রেসের এই কক্ষে এর আগেও বলেছি, এখনও বলতে চাই, মিয়ানমার অথবা বার্মা সরকার যদি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি রক্ষায় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী না হয়, রাখাইন স্টেটের উত্তরাঞ্চলের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির লোকজনকে নিরাপত্তা দিতে না চায় অথবা অপারগ হয় তাহলে ঐ স্টেটের (প্রদেশের) রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত। এবং ঐ এলাকাকে বাংলাদেশের কাছে স্থানান্তর করতে (বাংলাদেশের অংশ করতে) যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেয়া উচিত, যা ঐ এলাকার মানুষও চাচ্ছে।’ বসুন্ধরা থেকে প্রকাশিত ডেইলি সান পত্রিকা ঠিক একই কথা ইংরেজিতে বলেছে।মি: ব্র্যাড সারমেন কংগ্রেসের নিন্মকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির এশিয়া সম্পর্কিত উপ-কমিটিতে ১৩ জুন ‘দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এবং অর্থ বছর ২০২০ বাজেট’ সম্পর্কিত এক শুনানীতে আরো বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা এমন একটি সরকারের অধীনে থাকতে চায়, যারা তাদেরকে নিধন নয়, সুরক্ষায় আন্তরিক অর্থে কাজ করবে।’ কিছুকিছু মিডিয়া তার বক্তব্যকে অতিরঞ্জিত করে বলছে যে, তিনি নাকি বলেছেন, “সুদান থেকে দক্ষিণ সুদানকে আলাদা করে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে যুক্তরাষ্ট্র যদি সমর্থন করতে পারে, তাহলে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কেন একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না”? আসলে কংগ্রেসম্যান এমন কোন কথা বলেননি, অন্তত: ভিডিও তা বলেনা।এনআরবি নিউজের মন্তব্যে বাংলাদেশী দু’একজন এই দৃষ্টান্ত টেনেছেন। কথাটা অনেকের মনে ধরেছে, তাঁরা স্বপ্ন দেখছে, আরাকান মিশে যাচ্ছে বাংলাদেশের সাথে1 আরাকান মায়ানমারের অংশ তা তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন। বার্মা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধ করা জাতি, সামরিক শক্তিতে বলীয়ান। চীন এদের ঘনিষ্ট বন্ধু। রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারত বার্মার বিপক্ষে নয় ! বিশ্বশক্তি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চায়, বাংলাদেশকে সমর্থন করে। এর মানে এই নয় যে, বার্মা ভেঙ্গে কেউ আরাকান বাংলাদেশকে এনে দেবে। তাছাড়া চীনকে কেউ ঘাঁটাবে না 1 সাবেক ক্যাপ্টেন ও মুক্তিযোদ্ধা শচীন কর্মকার সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন যে, এই প্রস্তাব একটি ট্র্যাপ; এরপর পাল্টা প্রস্তাব আসবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে মায়ানমারের সাথে সংযুক্তি’র। তারমতে বাংলাদেশের উচিত এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়া। তিনি বলেন, পারস্পরিক সার্বভৌমত্বের অঙ্গীকার বাংলাদেশ-মায়ানমার সম্পর্কের ভিত্তি, এ সম্পর্কের অবনতি হতে দেয়াটা ঠিক হবেনা। শঙ্কা রয়েছে যে, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্যে বুমেরাং হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সদ্য বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে তা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যে হুমকী হতে পারে। ক’দিন আগে শাহরিয়ার কবীর নিউইয়র্কে এসেছিলেন। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিশদ রিপোর্ট আছে। রোহিঙ্গা শিবিরে অন্তত: গোটা চল্লিশেক সন্ত্রাসী গ্রূপ কাজ করছে। বিভিন্ন ইসলামী এনজিও স্যেলুকার নাম নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। শিবিরগুলো মাদ্রাসায় ভরে যাচ্ছে। প্রগতিশীল শক্তির কোন তৎপরতা সেখানে নেই 1 স্থানীয় জনগণের সাথে রোহিঙ্গাদের সংঘাত ঘটছে অনবরত। বনজঙ্গল উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ওই অঞ্চলে অপরাধ বেড়েছে। ওয়াশিংটনে জামাত লবি বেশ শক্ত। ছাত্র শিবিরকে এরা জঙ্গী সংগঠন মনে করলেও জামাতকে এখনো গণতান্ত্রিক শক্তি মনে করে। হেফাজতের শফি হুজুর একবার মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধের কথা বলেছিলেন। পরে পিছিয়ে যান 1 বাংলাদেশ-মায়ানমার যুদ্ধ কারা চায়1 যাঁরা অস্ত্রবিক্রি করে শুধু কি তাঁরা? মোটেই নয়, যারা বাংলাদেশের উন্নতি চায়না, যাঁরা বাংলাদেশকে স্থিতিশীল দেখতে চায়না, তাঁরা যুদ্ধ চায়। কংগ্রেসম্যান হয়তো একটি কথার কথা বলেছেন, যাঁরা তার বক্তব্য নিয়ে জল ঘোলা করছেন, তাঁরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র, সরকার ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। ওই অঞ্চলকে আইসিস’র ঘাঁটি গাড়ার একটি গুজব আছে, ষড়যন্ত্রকারীরা হয়তো তাই চায়1 আরাকানে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে। চীন ও ভারতের স্বার্থ সেখানে বিদ্যমান। সেন্ট মার্টিন নিয়ে অনেকের ভাবনা আছে। চীনকে ঠেকানোর চিন্তা আছে 1 প্রশ্ন হলো, আমেরিকা-চীন-ভারতের মধ্যেখানে বাংলাদেশ ঢুকবে কেন? যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। টেবিলই হোক রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।
————————————————————-শিতাংশু গুহ , guhasb@gmail.com