Sambad Matamat

সংখ্যালঘু নির্যাতন: সমাধান-ভাবনা

বাংলাদেশে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই, ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতন অব্যাহত গতিতে চলে আসছে। অসংখ্য হত্যা, ধর্ষণ, মন্দির প্রতিমা ভাঙচুর, বাড়িঘর লুণ্ঠন, নারী অপহরণ, জমিজমাব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেআইনিভাবে দখল করা, নানা রকমের হুমকি দিয়ে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা প্রভৃতি বেশ অবাধেই ঘটে চলেছে। দেশের সংবাদপত্রগুলি টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে প্রায় প্রতিদিনই জাতীয় ঘটনার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এই অপরাধগুলির বিচারের দাবী নানা সময়ে নানা মহল থেকে কখনও কখনও উত্থাপিত হলেও আজ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের কাউকেই বিচারামলে আনা হয় নি। শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা। বিচারের বানী নীরবে নিভৃতে কেঁদেই চলছে।সংখ্যালঘু বিতাড়নের অমোঘ অস্ত্রটি খুঁজে পেয়েছিলেন পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইউব খান। ১৯৬৫ সালে সংঘটিত পাকভারত যুদ্ধের বাহানায় (যুদ্ধটি চলেছিল মাত্র ১৭ দিন) অমুসলিম সম্প্রদায় সমূহের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি বলে ঘোষণা করে আইন জারী করার মাধ্যমে। কথা ছিল, যারা যুদ্ধের আগে দেশত্যাগহ করেছেন সয় সম্পত্তি ফেলে তাঁদের সম্পত্তিগুলি শত্রু সম্পত্তি আইনের আওতায় আনা হবে এবং কর্তৃপক্ষ সম্পত্তি আইন অনুযায়ী আবেদনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে লিজ দিতে পারবেন।

কিন্তু আইন না মানা, আইন ভঙ্গ করা, আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো এগুলিই তো কার্যত: আমাদের দেশে আইন বলে বিবেচিত হচ্ছে। সে অনুযায়ী বিদেশে অবস্থানকারীদের তো বটেই, দেশে নাগরিক তালিকাভুক্ত এবং ভোটার তালিকাতে নাম যথারীতি অন্তর্ভুক্ত থাকা সত্বেও শতকরা ৮০ ভাগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সম্পত্তি ৬৫-৬৬ সালেই শত্রু সম্পত্তি তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।মাত্র ১৭ দিন যে যুদ্ধ চলার পরও বন্ধ হয়ে যায়, সেই যুদ্ধের বাহানায় তৈরি বর্বর আইনটি আজ দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে দিব্যি অব্যাহত আছে শুধুমাত্র আইনটির নাম স্বাধীনতার পর পরিবর্তন করে “অর্পিত সম্পত্তি” আইন রাখা হয়েছে। কিন্তু কুখ্যাত শত্রু সম্পত্তি আইনের সকল ধারা উপধারা বহাল তবিয়তে বজায় রাখা হয়েছে।  ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে পাঁচ বছর একটানা রাজত্ব করার পর ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন নামে একটি আইন প্রণয়ন করে যে সকল সম্পত্তি মালিকের উত্তরাধিকার এ দেশে অবস্থান করছেন স্থায়ীভাবে তারা সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রসহ আবেদন জানালে ট্রাইব্যুনাল যথাযথ শুনানি করে যদি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণই পান যে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী যথার্থই বৈধ মালিকের উত্তরাধিকারী এবং এ দেশের নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দা এবং সেই সূত্রে তিনি সম্পত্তির যথার্থ দাবীদার হওয়াতে তঁকে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি প্রত্যর্পণ করা যেতে পারে মর্মে রায় ও আদেশ দেন তবে তিনি ঐ সম্পত্তি ফেরত পাবেন।দ্বিতীয়ত: যদি কোন অর্পিত সম্পত্তি লিজ প্রাপ্ত ব্যক্তি নিয়মিত লিজ মানি প্রতি বছর সময়মত পরিশোধ করে থাকেন ও ঐ সম্পত্তিতে বসবাসরত থাকেন তবে তিনি তার স্থায়ী (৯৯ বছর মেয়াদী) লিজ প্রাপ্তির আবেদন করলে যদি সম্পত্তির মালিকের কোন বৈধ উত্তরাধিকার এ দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে সম্পত্তি পাওয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করে না থাকেন তবে তাঁর দাবী অনুযায়ী সম্পত্তি স্থায়ীভাবে তিনি পেতে অধিকারী থাকবেন। এ বিধানাবলী সংশ্লিষ্ট গেজেটে (ক) তালিকাভুক্ত অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে বর্ণিত হয়েছে কিন্তু প্রত্যর্পণ আইন অনুযায়ী যে সকল সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকারী সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালগুলিতে আবেদন করে তাঁদের দাবীর যাথার্থ্য প্রমাণিত হওয়ায় তাঁদের অনুকূলে ট্রাইব্যুনালের রায় ও আদেশ পেয়েছেন-দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁরা কেউই উক্ত সম্পত্তি ফেরত পান নি1 অপরদিকে যে সকল সম্পত্তির মালিকের বৈধ উত্তরাধিকার এ দেশে না থাকায় অন্যেরা লিজ নিয়ে প্রতিবছর নিয়মিতভাবে লিজের টাকা সরকারী ট্রেজারিতে জমা দিয়ে লিজ নবায়ন করে সম্পত্তিতে ভোগ দখল করে আসছেন তাঁদের মধ্যে যারা ঐ সম্পত্তি নিজ নামে স্থায়ী লিজ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন আইনত তারা সুযোগ থাকা সত্বেও তঁদের দায়িত্ব সমাপ্ত করেছেন।  এই আইনটি যেমন পাকিস্তানী ভাবধারা তথা সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে মারাত্মক ভূমিকা রেখে চলেছে এবং দফায় দফায় ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুকে হাজারে হাজারে দেশত্যাগে বাধ্য করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিচ্ছে কেউই আমরা তা কদাপি ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবছি না।গেজেটে “খ” তালিকাভুক্ত সম্পত্তি অর্থাৎ পতিত জমির ক্ষেত্রে বিধানটি হলো সংশ্লিষ্ট মালিক তার মালিকানা দাবী করলে আবেদনকারীর কাগজপত্র পরীক্ষা করে দাবীর বৈধতা প্রমাণিত হলে সম্পত্তি তাঁকে প্রদান করে তাঁর নাম খারিজ করে দেওয়া হবে। এ বিষয়টিও অনুরূপ অবহেলার শিকারে পরিণত হয়ে আছে বলে জানা যায় সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে।ফলে, বিষয়টি আমলাদের কাছে পোয়াবারো হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ আইন প্রয়োগের অধিকার তাঁদেরই হাতে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের উচ্চস্তরে বেশ কিছু পাকিস্তানী মনা আমলা আছেন এবং তাঁরাই মূলত: আইনটির প্রয়োগে টালবাহানা ধরছেন বলে শুনা যায়। তবে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষও কোন ধোয়া তুলসীপাতা নন।প্রত্যর্পণ আইনটিতে একটি মারাত্মক বিধান যুক্ত রয়েছে। সেই বিধানটিতে বলা হয়েছে সরকারী কাজ অর্পিত সম্পত্তির আওতাভুক্ত কোন সম্পত্তির প্রয়োজন হলে তা সরকারের অনুকূলে রেকর্ড করে নেওয়া যায়1  উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন দুটি যথা জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামীকে ১৯৭২ এর মূল সংবিধানের আদলে নিষিদ্ধ তো করছেই না-উল্টো হেফাজতে ইসলাম হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের উপদেষ্টা। হেফাজত সার্বিকভাবেই ইসলামি উগ্রপন্থায় বিশ্বাসী। সি কারণে কয়েক বছর আগে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় বিশাল সমাবেশ করে সরকারকে ইসলাম-বিরোধী বলে আখ্যায়িত করে এই সরকার উৎখাতের আহ্বান জানায়। তখন অবশ্য সরকার কঠোর হস্তে তাদেরকে পুলিশী ব্যবস্থার মাধ্যমে দমন করে।ঐ সমাবেশে হেফাজতের আমির স্পষ্টত: দাবী করেছিলেন সরকার গৃহীত নারী নীতি ও শিক্ষানীতি বাতিল করে তাকে ইসলাম সম্মত করতে হবে। অর্থাৎ স্পষ্টত: তারা ইসলামের নামে নারীকে শিক্ষা-বর্জিত করে ঘরে আটকে রাখার মধ্যযুগীয় নীতি প্রবর্তনের দাবী তুলেছিল। চতুর্থ শ্রেণীর উপরে মেয়েদের পড়াশুনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এ কথা পর্যন্ত হেফাজতের আমির বলেছিলেন যে “নারীরা তো তেঁতুলের মতো-দেখলেই জিহ্বায় জল আসে”। এই উক্তিগুলি তখন সরকার সহ সকল মহলেরই নিন্দা কুড়িয়েছিল। শিক্ষানীতিকে ‘ইসলাম সম্মত’ করা বলতে আল্লামা শফি বুঝিয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী লেখক-লেখিকা-কবি-সাহিত্যিকদের লেখা পাঠ্যবইতে রাখা চলবে না। নিতান্ত বশংবদের মতো সরকার দিব্যি হেফাজতের নির্দেশ মত রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রণেশ দাশগুপ্ত সহ বহু সংখ্যক খ্যাতনামা লেখকের লেখা পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িক লেখকদের লেখা বইতে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন করে বই ছাপিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে সেই বইগুলিকে পঠন-পাঠন করার নির্দেশ দেওয়া হলো। পরিণতিতে শিশুকাল থেকেই ছেলেমেয়েরা সাম্প্রদায়িক মনোভাবে উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করলো। এগুলির সামগ্রিক পরিণতিতে দেশজোড়া একটি সাম্প্রদায়িক আবহ তৈরি হলো। তা দিন দিনই ঘনীভূত হচ্ছে। হাই কোর্টের সম্মুখভাগে একটি সুন্দর ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছিল জাস্টিসিয়া নামে। তা দেখে হেফাজতের আমির আল্লামা শফি টেলিফোনে (হট লাইনে কিনা জানি না) প্রধানমন্ত্রীকে ওই ভাস্কর্য অপসারণ করতে বলেন তিনি তৎক্ষণাৎ প্রধান বিচারপতিকে টেলিফোনে বলে ভাস্কর্যটি অপসারণের নির্দেশ দিলে তিনি তা করতে বাধ্য হন কারণ হেফাজতিরা হুমকি দিয়েছিল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভাস্কর্যটি অপসারণ না করলে লক্ষাধিক, মুসুল্লি ইসলাম রক্ষার জন্য হাই কোর্ট ঘেরাও করবে। তারা বলেছিল এটি একটি দেবী মূর্তি। আর কোনটা শৈল্পিক বোধে নির্মিত ভাস্কর্য তা বুঝবার ক্ষমতাও ঐ মূর্খদের নেই। কিন্তু সরকার ওদের কথায় সায় দিয়ে একদিকে হেফাজতকে মাথায় তুললেন অপরদিকে সাম্প্রদায়িক আবহ দেশে ফিরিয়ে আনলেন। ফলে সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের সাহস বাড়তে বাড়তে দিনে দিনে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এমনটি হতে পারে না-হতে দেওয়া যায়ও না। যদিও অনেক বিলম্ব ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে তবু এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলিকে সকল শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। অনেকেই অনুভব করেন সাম্প্রদায়িকতা এক বিষাক্ত ঘায়ের মত সমাজ-দেহের দ্রুত পচন টেনে আনছে। তাই দরকারি massive surgery করেও এই ঘাকে নির্মূল করতে হবে। প্রথমত: সংবিধানের নতুন একটি সংশোধনী এনে জামায়াতে ইসলামি ও হেফাজতে ইসলাম সহ ধর্মের নামে সকল দল ও রাজনীতিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। দ্বিতীয়ত: ঐ সংশোধনীতে জিয়ার “বিসমিল্লাহ্‌” এবং এরশাদের রাষ্ট্রধর্মের বিজ্ঞান বাতিল করতে হবে। তৃতীয়ত: পাঠ্যপুস্তক থেকে হেফাজতের দাবীতে লিখিত সাম্প্রদায়িক লেখকদের প্রত্যাহার করে পূর্বে বার্তিলকৃত লিখাগুলি পুন:স্থাপিত করে আগামী শিক্ষাবর্ষের সুরুতেই নতুন পাঠ্যপুস্তক ছেপে বিতরণ করতে হবে। চতুর্থত: অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০০১ আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। পঞ্চমত: বিগত ২০০১ থেকে এ যাবত সংঘটিত সকল সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার বিচার অবিলম্বে শুরু করতে হবে এবং ঘটনা সমূহের জন্য দায়ী সকলকে দলমত নির্বিশেষে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। ষষ্ঠত: হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে অপসারণকৃত জাস্টিসিয়া নাম ভাস্কর্য অবিলম্বে পুন:স্থাপন করতে হবে। সপ্তমত: অন্যান্য অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও অবিলম্বে একটি সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে সমাজের একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিকে সংখ্যালঘু বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী নিয়োগ দিতে হবে এবং অষ্টমত: নিয়োজিত সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রীকে বা অপর কোন প্রখ্যাত ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করতে হবে। (রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক।মতামত  লেখকের একান্ত নিজস্ব)

———————————————————————রণেশ মৈত্র

Leave a Reply

Your email address will not be published.