উত্তর আমেরিকায় ২০২৫ এর বঙ্গ সম্মেলন

দিলীপ চক্রবর্তী
গত ৬-ই জুলাই, ২০২৫ এর NABC 2025 অথবা বঙ্গ সম্মেলনের শেষ দিন ছিল। উত্তর আমেরিকার বাঙালীরা বঙ্গ সম্মেলনের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন, কারণ তাঁদের কাছে যে কোন বঙ্গ সম্মেলন দুর্গাপূজার থেকেও বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে। এ বছরও মানুষ আমার আপনার মত বাঙালিরা কানাডার টরেন্টো শহরে উপস্থিত হয়ে গেল। আর কিছু নয় বঙ্গ সম্মেলন দেখতে হাজির হয়ে গেল।
গত ২০২৩ এর বঙ্গ সম্মেলনের কথা সকলেরই মনে আছে। ২০২৩এর বঙ্গ সম্মেলনে দর্শকগণ হতাশ হয়েছিলেন, কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও নিষ্ঠার অভাব বঙ্গ সম্মেলনের গরিমা আর চমকের পোষাক ম্লান করে দিয়েছিল। আমরা যারা বঙ্গ সম্মেলনকে ভালোবাসি, সম্মেলন নিয়ে গর্ব করি, সকলেই হতাশ হয়েছিলাম, কিন্তু ২০২৪ এর বঙ্গ সম্মেলন শিকাগোতে অপহৃত গৌরবের গ্লানি কিছুটা উজ্জ্বল করেছিল। তাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা ছিল টরেন্টোর বঙ্গ সম্মেলন আমাদের পূর্ব গৌরব পুনরুদ্ধার করবে, বঙ্গ সম্মেলনের প্রদীপ স্বমহিমায় আবার উজ্জ্বল হয়ে সকলের মনে খুশির আলো ছড়িয়ে দেবে। কিন্তু টরেন্টো আমাদের আশা পূর্ণ করতে পেরেছে কি? এ প্রশ্নের উত্তর আশা করি ইতিমধ্যে আপনারা পেয়ে গেছেন।
৪ তারিখে প্রদীপ জ্বেলে উৎসবের শুরু, ভারতীয় দূতাবাসের কনসাল জেনারেলের বক্তব্য, সিএবির প্রেসিডেন্ট ও আহ্বায়ক শ্রী জয়দেব সরকারের বক্তব্য অতি স্পষ্ট ছিল – তিনি একটি সুন্দর বঙ্গ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন টরেন্টো কনভেনসন সেন্টারে।
প্রথম দিনেই মনে হ’ল – এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দর্শকদের দেখে, ভাবলাম তাঁদের উৎসাহ উদ্দীপনার তাপমাত্রা বেশ উঁচুতে, ভালো লাগল , নিশ্চিন্ত হলাম এ বঙ্গ সম্মেলন ভালো হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সকলের মন জয় করেছে। কল্যান সেন বরাটের পরিচালনায় শিল্পীরা অত্যন্ত পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। সাহিত্য আলোচনা সভার আলোচ্য বিষয়গুলি ছিল আকর্ষণীয় ও মনোগ্রাহী। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্করের ছোট গল্পগুলি সামাজিক ও সাময়িক প্রভাব ও প্রতিফলনের কথা অত্যন্ত নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন সাহিত্যিক শ্রী কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়। এ প্রসঙ্গে প্রকাশকের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সুন্দর আলোচনার মাধ্যমে অতি সহজ করে বক্তব্য রাখেন শ্রীমতী রূপা মজুমদার। বিজনেস ফোরামে “দান করেও” কিভাবে “অর্থবিয়োগ” কম হয় – আলোচনা করেছেন। বিষয়টি বেশ আগ্রহসঞ্চারী। শ্রী উত্তম চক্রবর্ত্তী তাঁর Toronto Calcutta Foundation আলোচনা করেন। তিনি গত তিন দশকেরও বেশী সময় ধরে বহু ছাত্র ছাত্রীর শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন বলে জানিয়েছেন। বিজনেস ফোরামে সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন যোগ দিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে বঙ্গ সম্মেলনের ইতিহাসে এ ঘটনা নতুন এবং এটা একটি আলোচ্য বিষয় হতে পারে। ঋত্বিক ঘটকের জন্ম শতবার্ষিকী ও তাঁর চলচ্চিত্র শিল্পে তাঁর প্রভাব ও “লিগেসি” র অনুষ্ঠান ভাল হয়েছে। অন্বেষা, লক্ষীছাড়া, লাইজা আহমেদ লিজা, প্রভৃতি প্রথিতযশা শিল্পীগণ তাঁদের সুরেলা কন্ঠ ও নৈপূণ্য প্রদর্শন করে সকলের হৃদয় জয় করেছেন। নাটক “তাসের দেশ” মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। সকলের ভালো লেগেছে। “হৈচৈ ফিল্ম” প্রদর্শনী, কলেজ Reunion, “NABC Idol” selection, ইত্যাদি সকলকেই মাতিয়ে রেখেছিল ।
বঙ্গ সম্মেলনের কথা বলতে গেলে খাওয়া দাওয়ার কথা না বললে আলোচনা শেষ হয় না। কর্তৃপক্ষের খাওয়া নিয়ে “Two Prong” approach ছিলো। দর্শকগণ বহু আশা নিয়ে এ উৎসবে এসে থাকেন। আর এ বছর কর্তৃপক্ষ সঙ্গীত, নৃত্য,সাহিত্য ছাড়া আরও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যেমন ফুটবল প্রতিযোগিতা, বঙ্গশ্রী ইত্যাদি সহ রসনাতৃপ্তিকারক নানারকম সুস্বাদু ব্যঞ্জনাদির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ঐতিহসিক জিম হোয়েলান বোর্ড ওয়াক হলের হাতছানি তো ছিলই। সত্যি বলতে আটলান্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত এ নগরী রাতের লাস্যময়ী নারীর মত সকলকেই তার সৌন্দর্য উপভোগের হাতছানি দেয়। তাছাড়া সুন্দরী নারীর পীনোন্নত বক্ষ যেমন প্রেমের ভ্রমরকে আকর্ষন করে তেমনি এ নগরীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষন গ্যাম্বলিং ক্যাসিনোগুলি বিভিন্ন মানুষকে মৌমাছির মত আটলান্টিক সিটিতে নিয়ে আসে। সেজন্য এ নগরী নারী, সুরা আর দ্যূতক্রীড়ার পীঠস্থান।
তাই যে কোন বাঙালীর কাছে প্রথম প্রেম ছিল বঙ্গ সম্মেলন আর দ্বিতীয়টি ছিল ক্যাসিনোগুলি। বেশীরভাগ দর্শক এক তীরে দুই পাখী বিদ্ধ করতে এসেছেন, কিন্তু প্রথম পাখীটি আর বিদ্ধ হল না, কারণ বঙ্গ সম্মেলনের আয়োজক KPC BHOF শুক্রবার হলটি ব্যবহারের অধিকার পেলেন না। ফলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হল না। কিন্তু তাঁরা কিছুদূরে “সি ভিঊ” নামে একটি হোটেলে অন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। দর্শকরা দুধের বদলে ঘোল খেলেন। বঙ্গ সম্মেলন এ বছর অত্যন্ত খারাপ হয়েছে দ্বিমত নেই।
সাধারণতঃ বঙ্গ সম্মেলন আমেরিকার কোন বাঙালী এসোসিয়েশনকে করতে দেওয়া হয়। এ বছর KPC BHOF কে করতে দেওয়া হয়েছিল। একবার বঙ্গ সম্মেলন কোন এসোসিয়েশনকে করতে দেওয়ার চুক্তি দিলে সি এ বির কোন হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকে না। যদিও সি এ বি সর্বদা ভারপ্রাপ্ত সংঘের প্রতি সর্বদাই সজাগ দৃষ্টি রাখে। কিন্তু এ বছর ভারপ্রাপ্ত কনভেনার স্বেচ্ছায় সকলকে এড়িয়ে গেছেন, কারো ন পরামর্শ নেননি, ফলে যা হওয়ার সেটাই হয়েছে, সম্মেলন অব্যবস্থার শিকার হয়ে ধরাশায়ী হয়েছে। ফলে দর্শকগণ বিভিন্ন অব্যবস্থার শিকার হয়েছেন, ব্যবসায়ীরা তিন দিনের ব্যবসার সময় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, শিল্পীরাও এ বিশৃঙ্খলার হাত থেকে রক্ষা পাননি, এ হেন অব্যবস্থার মধ্যেও যারা নিরলসভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সকলকে খুশি ও আরাম দায়ক পরিস্থিতির মধ্যে রাখার প্রয়াস করেছেন, সে সব স্বেচ্ছাসেবীদের কথা কেউই উল্লেখ করেননি। এঁরা সকলেই স্বার্থহীনভাবে নিছক বঙ্গ সম্মেলনকে ভালোবেসেই নিজেদের শ্রম, অনেক সময় অর্থ দান করে সকলের আবদার বা দাবী (যত অযৌক্তিক হোক না কেন) পূরণ করেন, অনেক সময় তাঁরা শিল্পীদের অন্যায় আবদার রক্ষা করতে বাধ্য হন, বেশীরভাগ সময়ই এ শিল্পীরা কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করে না, অথচ এরকম নিষ্ঠাবান স্বেচ্ছাসেবীদের যন্ত্রনার কথা কেউ কখনও উল্লেখও করেন না। সকল যন্ত্রনা ও উপেক্ষা হৃদয়ে নিয়েও এঁরা সকলকেই নিষ্ঠা সহকারে যত্ন, সেবা ও ভালোবাসার বারি উপহার দিয়ে যান সকল সমবেত ব্যবসায়ী, শিল্পী ও দর্শকবৃন্দকে।
দেখুন, NABC 2023 খুব খারাপ হয়েছে, এ কথা বলাই উচিত, অব্যবস্থার কোন সীমা ছিল না, সে জন্য CABর প্রেসিডেন্ট শ্রী রণদেব সরকার সকল শিল্পী, ব্যবসায়ী ও দর্শকদের কাছে নিঃসর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন। তিনি অব্যবস্থার মূল উৎখাত করে ভবিষ্যতের সুন্দর বঙ্গ সম্মেলনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এবার একটু শিল্পীদের কথা বলি। আজ যারা নিন্দাবাদ করছেন তাদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু বঙ্গ সম্মেলন কর্তৃপক্ষকে বারবার অনুরোধ করেন – দাদা, আমাকে একটা সুযোগ দিন। যারা দুবার লাঞ্চ খেয়েছে, তারা এগিয়ে এসে বলুন, আমি দুবার খেয়েছি। বিদ্যাসাগরের উদাহরণ ভুলে গেছেন, নিজের জিনিস নিজে বহন করুন, আপনার মাল কে বহন করবে? সত্যি বলতে কি আপনারা দাবী করছেন আপনারা শিল্পী, কিন্তু সে শিল্পী সত্তার সহনশীলতা ও ঔদার্যের উদাহরণ স্থাপন করুন। একজন শিল্পী তো “মিট এন্ড গ্রীটে” এলেন না, প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। আসেননি কেন, কোথায় ছিলেন? এক লেখক তো নিজের বই বিক্রী করে গেলেন – সকলে বলছে। অভিযোগ আর পালটা অভিযোগে কোন গঠনমূলক কাজ হয়া না। সেজন্য বিভেদ সৃষ্টি না করে আগামী বছর কি করে ভালোভাবে বঙ্গ সম্মেলন করা যায়, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করুন। গত ৪২ বছরের সুখের অভিজ্ঞতা, এক বছরের বিশৃঙ্খলায় শেষ হয়ে যায় না।
আর একটা কথা – যারা আপনাদের শিল্পী বানিয়েছে সে দর্শকদের অসুবিধার কথা কিন্তু আপনারা একবারও উল্লেখ করলেন না। এটা আমার কাছে খুব তাৎপর্যপুর্ণ মনে হয়েছে।
উত্তর আমেরিকার বাঙালীরা অত্যন্ত অতিথি পরায়ন ও শ্রদ্ধাশীল। আপনারা অনেকেই হয়ত বিভিন্ন সময়ে বিভন্ন লোকের বাড়িতে থেকেছেন, আমার স্থির বিশ্বাস তাঁরা আপনাদের যত্নের কোন ত্রুটি করেননি। তবে একটা কথা বলি – শ্রদ্ধাশীলতাই শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়। অপমান করার জন্য ২০২৩র বঙ্গ সম্মেলন কর্তৃপক্ষ আপনাদের ডেকে আনেনি, অনভিজ্ঞ পরিচালকের জন্য এটা হয়েছে। আসুন, আজকের ব্যর্থতা ভুলে সকলে মিলে পরের বঙ্গ সম্মেলনকে সাফল্য মন্ডিত করি।
অনুরোধ করছি – আসুন আমরা সকলে মিলে সাহায্য করি উত্তর আমেরিকায় বাংলার সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে। বিভাজনের খাদ গভীর না করে আসুন একসাথে কাজ করি যাতে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর কখনও না হয়। ভালো থাকবেন, শুভেচ্ছা রইলো ।