EntertainmentGeneralGlobal WatchIndiaNewsSambad Matamat

নিউ জার্সিতে বৈশাখী উৎসব

দিলীপ চক্রবর্ত্তী

পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বৈশাখী মেলা বা উৎসব পালিত হয়। মুঘল সম্রাট আকবের আমলেই বৈশাখীর প্রারম্ভের সূচনার সন্ধান পাওয়া যায়। ১৬ শতাব্দীতে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করেন। এ বাংলা সনের প্রবর্তনের অন্যতম কারণ ছিল সম্রাটের কোষাগারে কর গ্রহণ প্রক্রিয়ার সহজীকরন ও শৃঙ্খলা স্থাপন, অপর কারণ ছিল কৃষিকর্মের সঠিক পরিকল্পনা করা। বাংলা নববর্ষের শুরুতে চাষের বীজ বপন করা এবং আগামী মরশুমে শষ্যাদির ফসল সংগ্রহ করা। ক্রমশঃ বাংলা নববর্ষ বাঙালীর জীবন যাত্রায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সার্বিক ঐক্য স্থাপন এবং আনন্দমুখর উৎসবের সূচনা করতে থাকে। বৈশাখী উৎসব হতাশা থেকে আশা এবং অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিশা দেখায়।

মঙ্গল শোভাযাত্রা “বৈশাখী” পালনের একটি বিশেষ অঙ্গ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাঙালিরা এ উৎসব পালন করে থাকে। নিঊ জার্সির “Indian Community Center, সংক্ষেপে ICC” গত ১১ই মে বৈশাখী উৎসবের আয়োজন করেছিল St. Andrew Greek Orthodox Church এর হলটিতে।  প্রায় দেড়শত লোকের সমাবেশ হয়েছিল এ অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করতে। বেশীরভাগ পুরুষের পরিধানে ছিল ধুতি বা পাজামা পাঞ্জাবী আর মহিলাদের পরিধানে ছিল শাড়ী ব্লাউজ আর নানা রকম গহনার সৌন্দর্যের ঝিলিক। অনুষ্ঠানের শুরুতে আই সি সির সভাপতি শ্রী নিলয় হাইট তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বৈশাখী উৎসবের সূচনা করেন। তারপর আই সি সি র সাংস্কৃতিক সম্পাদক অর্পিতা গুপ্ত সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন – আই সি সি স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে একটি সুন্দর অনুষ্ঠান করতে চলেছে, আশা করি আপনাদের সকলের এ অনুষ্ঠান ভালো লাগবে, বিশেষ করে ছোট্ট শিশুদের গান ও নাচ। দর্শকগণ অতি আগ্রহের সাথে তাদের খুদে শিল্পীদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

দর্শকের আসনে আমিও বসে অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম  আট দশ জন ছোট্ট ছেলে মেয়ে বিভিন্ন সাজে দর্শকদের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওদের পোষাক দেখে আমি আবাক হয়ে গেলাম, কারণ এর আগে আমি এমন কখনও দেখিনি।  কেঊ সেজেছে পরী, কেঊ সেজেছে গায়ক, আর বাকীদের সাজ আজ আমার আর মনে নেই, কিন্তু এটা মনে আছে ওদের প্রত্যেককেই অতি অসাধারণ ও অনন্য মনে হচ্ছিল। হঠাৎ আমাদের সকলের প্রিয় অর্ণব চক্রবর্ত্তী ঘোষণা করে জানাল – এসব ছোট্ট শিশুরা  “Go As You Like” এ অংশ গ্রহণ করছে। আরো ভাল লাগল যে কর্তৃপক্ষ প্রতিটি শিশুকেই পুষ্প স্তবক দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এর পর শুরু হল অন্য শিল্পীদের অনুষ্ঠান। আই সি সি র “অনন্ত প্রেমে”র রুপকার ছিলেন অনসূয়া ও প্রত্যূষা, আর এ “প্রেমের” ভাষ্যকার ছিলেন প্রসূন। আমরা সকলেই অতি আগ্রহ নিয়ে উপভোগ করেছি। “মিউজিক্যালি ইউর্স” এর সৌরভ ঘোষ রায় তাঁর গান ও সুরের মুর্চ্ছনা দিয়ে সকলকে মগ্ন করে দিয়েছেন। তাঁর সাথে কি বোর্ডে ছিলেন দেবরাজ দত্তগুপ্ত । আর সাথে ছিলেন বিজ্ঞানী কুণাল তথা ড্রামার সাথে ব্যাংকার সৌরভ অর্থাৎ গায়ক সৌরভ। ওদের অনুষ্ঠান দেখে মনে হয়েছে ওরা সকলেই বিদগ্ধ সঙ্গীত শিল্পী । সুরশ্রীর সুরে সুরে বর্ষবরণ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন অনিন্দিতা সরকার ভৌমিক। গীত নির্বাচন এবং গীতশিল্পীদের কুশলী কন্ঠের সঙ্গীত সকল শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে। “মিউজিকোলজী” গ্রুপের কথা না বললেই নয়। মনে হ’ল এরা সকলেই প্রতিটি যন্ত্রে অতি নিপূন, ফিমেল লীড সিঙ্গার রেশমি গোস্বামী ও মেল লীড সিঙ্গার তীর্থঙ্কর, দুজনেই অতি দক্ষ, ওদের কন্ঠের যাদু সকলকেই মোহিত করেছে। প্রলয়, সব্যসাচী ও বিহানের ড্রাম ওদের  সঙ্গীতকে অন্য উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিল। “Rythmzzdivine” প্রতিষ্ঠাতা দেবলীনার নেতৃত্বে নৃত্যের অনুষ্ঠান নৃত্যের ছন্দে ছন্দে তালে তালে ওদের  সকল দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। এত গান বাজনার মধ্যে কর্তৃপক্ষ “মাতৃ দিবসের” কথা একটুও ভুলে যাননি। সঞ্চালক সি এ বির চেয়ারম্যান দিলীপ চক্রবর্ত্তীকে মাতৃ দিবস নিয়ে কিছু বলতে বলেন । সকল উপস্থিত মায়েদের প্রণাম ও শুভেচ্ছা জানিয়ে দিলীপবাবু শুরু করেন  – মাতৃদিবস প্রথম শুরু হয় ১৯০৭ সনের ১২ই মে যখন ফিলাডেফিয়ার Anna Jarvis তাঁর মার জন্য একটি স্মরণসভা করেন। ১৯০৮ সালে তিনিই প্রথম মাতৃদিবস পালনের প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর থেকে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারে মাতৃদিবস পালিত হয়। দিলীপবাবু মায়েদের উদ্দেশ্যে  “ইতি-মা” বলে স্বরচিত একটি কবিতা পাঠ করেন। তাঁর দ্বিতীয় কবিতা ছিল “আমরা হাঁটছি”। তাঁর স্বরচিত কবিতা দুটি শ্রোতাদের প্রশংসা অর্জন করেছে। উত্তর আমেরিকায় সুলেখক হিসেবে অনেকের কাছেই দিলীপবাবু সুপরিচিত। তারপর “কথায় কবিতায়” গানের স্কুলের চারজন শিশু ছাত্রী কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। আমেরিকায় ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশুনা করা সত্বেও ওদের বাংলা  সঠিক উচ্চারনের স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা প্রশংসার দাবী রাখে।  ওরা তিনজন ঐশানী চক্রবর্ত্তী, জয়েতিক সাধুখাঁ ও সুভদ্রা সাধুখাঁ খুব সুন্দর আবৃত্তি উপহার দিয়েছে। প্রশংসা প্রাপ্য “কথায় কবিতায়” এর কর্ণধার শিক্ষিকা  বিদিতা চক্রবর্ত্তীরও। শিশু শিল্পী রিয়াংশু ঘোষরায় এবং অর্চস্মিত চৌধুরী “বড় আশা করে……” গেয়ে শ্রোতাদের মন কেড়ে নিয়েছে। অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সকল অনুষ্ঠানের পরিচালনা করেছেন শুদ্ধসত্ব আচার্য এবং  অবন্তিকা মুখার্জী।  আরেকটি কথা না বললেই নয় – প্র্তিটি শিল্পীকেই পুস্পস্তবক উপহার দেওয়া হয় আই সি সির পক্ষ থেকে। আর দর্শকদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা শিল্পীরা নিজেরাই অর্জন করেছেন।  সত্যি বলতে কি এমন “এমেচার” শিল্পীদের মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করে সকল দর্শক অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। আর দু একটা কথা না বললে “বৈশাখী উৎসবের” প্রতি অবিচার করা হবে। আই সি সির নতুন “দুর্গা  (লক্ষী ও সরস্বতী সহ) প্রতিমার” ক্রয়মূল্য উপহার দিলেন আই সি সি র সদস্য শ্রীমতী স্নিগ্ধা চক্রবর্ত্তী। আই সি সি সর্বদা সমবেত দর্শকদের জন্য সুস্বাদু আহারের ব্যবস্থা করে থাকে, এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সিঙ্গারা, জিলাপি মুড়ি ইত্যাদি ছিল স্ন্যকসের মেনুতে আর ডিনারে ছিল জিহ্বালেহনকারী পোলাও, এঁচোরের ডালনা, চাটনি ও কমলাভোগ। এত রকম মন মাতানো অনুষ্টানের মধ্যেও আই সি সি র হয়ে বলরাম মল্লিকের দেওয়া দরিদ্রদের জন্য নানা রকম মশলা ও হজমীগুলি একাগ্র চিত্তে বিক্রী করে অর্থ সংরহ করেছেন আমাদের সকলের প্রিয় সদাহস্যময় দেবল গুপ্ত। রাতের আহারের পর দর্শকবৃন্দ একে অপরের সাথে সৌজন্য বিনিময় করে ২০২৪ এর “বৈশাখী” উৎসবকে বিদায় জ্ঞাপন করে নিজের নিজের গন্তব্য স্থানের দিকে রওয়ানা হন। শেষ হয় ২০২৪ এর বৈশাখী উৎসব।

Leave a Reply

Your email address will not be published.