বিচ্ছিন্ন ঘটনায় ছিন্ন ভিন্ন
সীমা ঘোষ
গত কয়েকদিন ধরেই ঘুম নেই চোখে, সম্ভবত পুরো বাংলা কাটাচ্ছে নির্ঘুম রাত। এক ফুটফুটে মেয়ে, একজন উচ্চ শিক্ষিত ডাক্তার, তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, একমাত্র অবলম্বন, যে হতে পারত অগণিত রোগীর ভরসার জায়গা, তাকে, তারই কর্মস্থলে নির্মম, নৃশংস মৃত্যুদন্ড দিল কিছু নরপিশাচ। এ কথা জানার পরেও নিশ্চিন্তে ঘুমোনো যায় ?
আমার মেয়ে নেই। আমাদের দেশে তো এমনিতেই পুরুষের তুলনায় নারীর জন্মহার কম, কন্যা ভ্রূণ হত্যা তো আমাদের দেশে নতুন নয়। কিন্তু আমাদের পুরুষ শাসিত মহান দেশে, কোনও বয়সের কোনও নারীই তো নিরাপদ নয় কারণ অসংখ্য পুরুষ মনে করেন সব নারীই ভোগ্য বস্তু। চার মাস বয়সী শিশু থেকে সত্তর বছর বয়সী সন্ন্যাসিনী, কেউ আর নিরাপদ নয় এখানে। সব পুরুষ এমন না হলেও, অবস্থা দেখে তো মনে হয় ঐ লুম্পেনরাই দলে ভারী। কখনও কখনও মনে হয়, বুঝি রাষ্ট্র যন্ত্র ও ওদের ই সমর্থন করে, তাই বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে বছরের পর বছর।
শুনেছি অভয়া, দৃঢ় চেতা তিলোত্তমা, তার কলেজের বিকৃত, দূষিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে চেয়েছিল, তাই তাকে এত নৃশংস মৃত্যু দন্ড দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে, যারা প্রতিবাদী হবে ভাবছি, তাদেরও সতর্ক করে দেওয়া হলো ?
কিচ্ছু জানি না আমরা, কখনও জানা যাবে কিনা, তাও জানি না। তবু খুব সাধারণ এই এক বরিষ্ঠ নাগরিকের মনে উঠে আসছে অনেকগুলো প্রশ্ন, এতদিনের এত অভিজ্ঞতা থেকেই।
1. যদি ঐ সেমিনার রুমেই হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে রক্তের পরিমাণ এত কম কেন? সাজানো হত্যামঞ্চ নয় তো?
2.আমরা মৃতদেহ দেখে কিছুই বুঝবো না, কিন্তু ডাক্তাররা কেন প্রথমে আত্মহত্যা বললেন? আত্মহত্যা আর অস্বাভাবিক মৃতদেহ দেখে কি ডাক্তার বা পুলিশ আধিকারিকরা তফাৎ বুঝতে পারেন না, তাহলে তারা কি ধরনের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত?
3. তদন্ত চলাকালেই সেমিনার রুমের দেওয়াল ভেঙে, পাশের ঘরটি সংস্কারের প্রয়োজন হলো কেন? কর্তৃপক্ষ কি জানতেন না যে এর ফলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে, নাকি প্রমাণ লোপাট করাই উদ্দেশ্য ছিল?
4. পদত্যাগী অধ্যক্ষকে পদত্যাগের চার ঘন্টার মধ্যেই আরেকটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ রূপে নিয়োগ করা হলো, তাকে কোন কাজের পুরস্কার দেওয়া হলো? তাকে জিজ্ঞাসাবাদ না করে পুরস্কৃত করা হলো!
5. ১৪ ই আগস্ট, আর জি কর এ ভাঙচুরের আগাম খবর পুলিশের কাছে কেন ছিল না? এতটাই অযোগ্য আমাদের পুলিশ বাহিনী?
6. আর জি কর এ পুলিশেরা যেভাবে প্রাণ বাঁচাতে দৌঁড়োলেন এবং নার্সদের সাহায্য চাইলেন, তার পরে আর নিরাপত্তার জন্য তাদের ওপর ভরসা করা যায়? দেশে তো যুদ্ধ পরিস্থিতি নয়, নিরস্ত্র জনতার একটি জমায়েত, সেখানেই যদি তাদের এমন অবস্থা হয়, তাহলে সত্যিই বিপদ হলে, তারা আমাদের কী ধরনের নিরাপত্তা দেবেন? এমন অযোগ্য বাহিনী, আমাদের ট্যাক্সের টাকায় পুষে রাখা হবে কেন?
সর্বোপরি পুলিশ কমিশনারের ভুমিকায় অত্যন্ত হতাশ, অবশ্য হাথরস, উন্নাও, মনিপুর আমাদের পুলিশের এমন ভয়ঙ্কর উদাসীন রূপ দেখিয়েছে। এত ঘটনার ঘনঘটায় মনে হচ্ছে , এ দেশে মহিলাদের নিরাপত্তা আসলে এক সোনার পাথরবাটি। এত অন্ধকার ঘিরে ধরেছে আমাদের, সব কিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে হবে। কত বছর ধরে, অনলস পরিশ্রম করে, কত বিনিদ্র রাত রোগীদের পাশে থেকে একজন ডাক্তার তার এই মহান ডিগ্রি অর্জন করেন। আর আমাদের অশিক্ষিত, অশ্লীল কথার ফোয়ারা ছোটানো নেতারা তাদের ন্যূনতম সম্মানটুকু না দিয়ে সন্দেহ করছেন তারা কাজে ফাঁকি দিয়ে বিক্ষোভের নামে তাদের বয় ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে যাচ্ছেন। কতটা নির্লজ্জ হতে পারে এই সব নেতারা, ছিঃ। আর ধিক্কার আমাদের, আমরা এই সব লোকেদের নির্বাচন করে জন প্রতিনিধি বানিয়েছি। সত্যিই কি, কিছুই করার নেই আমাদের, এই সব অশিক্ষিত, লুম্পেন, ধর্ষণর ভোগ্য হওয়াই এদেশের মেয়েদের পরিনতি । দ্রৌপদীর অপমানের জবাবে কুরুক্ষেত্র হয়েছিল, আর কত দ্রৌপদীর প্রয়োজন আমাদের আরেকটা কুরুক্ষেত্র করার জন্য ?? Pic courtesy: The Mint