শত্রূ সম্পত্তি আইন
এবার শত্রূ সম্পত্তি আইন নিয়ে কিছু কথা বলবো। কারণ এই আইন হিন্দুদের সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। পাকিস্তান আমলের কথা বাদ দিলেও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার এজন্যে দায়ী। কেউ এই আইনটিতে হাত দেয়নি, কারণ প্রশাসন মূলত: সাম্প্রদায়িক। তাছাড়া স্বার্থান্বেষী মহল তো ছিলোই। এই আইনটির এখন ৫৪ বছর চলছে। ডাঃ দীপুমণি বিদেশমন্ত্রী হয়ে প্রথমবার ২০০৯ সালে নিউইয়র্ক এলে ‘সংখ্যালঘু সমস্যা নিয়ে আমরা তার সাথে বসেছিলাম। আলোচনায় শত্রূ (অর্পিত) সম্পত্তি আইন প্রসঙ্গ এলে তিনি বলেছিলেন, ‘৪৪ বছর হয়ে গেছে?’ আমরা বলেছিলাম ১৯৬৫ সাল থেকে ২০০৯ দীর্ঘ ৪৪ বছর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিশেষত: হিন্দুরা এই আইনের যাতনায় ভুগছে। এখন ২০১৯, এই কালো আইনের যাতনা কিছুই কমেনি। বর্তমান সরকার আইনটি নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছেন। একবার বাতিল, আবার সংশোধন, এ খেলা চলছে তো চলছেই। কিন্তু কাজের কাজ এখনো কিছু হয়নি। কোন হিন্দু তার সম্পত্তি ফিরে পেয়েছেন বা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, এমন তথ্য নেই? স্বভাবত: প্রশ্ন উঠছে, সবকিছু ‘আই ওয়াশ‘ নয়তো?
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের অঙ্গীকার ছিলো, পাকিস্তান আমলের সকল কালাকানুন বাতিল হবে। রহস্যময় কারণে এই কালো আইনটি বাতিল হয়নি। বরং ‘শত্রূ সম্পত্তি আইন নাম পাল্টে ‘অর্পিত সম্পত্তি হয়ে যায়। বাংলাদেশে কেউ বলেন না যে আইনটি ভালো, কিন্তু এটি এতকাল কেন জাতির ঘাড়ে চেপে থাকলো এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর কারো কাছে নেই! শত্রূ বা অর্পিত সম্পত্তি যে নামেই ডাকা হোক না কেন এটি সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের জন্যেই প্রণীত বা আজো বহাল তা দিবালোকের মত সত্য। বাংলাদেশে প্রায় সকল হিন্দু পরিবার কোন না কোনভাবে এই আইনের বদৌলতে ক্ষতিগ্রস্থ। আর এই আইন কত সম্পত্তি হিন্দুর কাছে থেকে কেঁড়ে নিয়েছে এই হিসাব অধ্যাপক ডঃ আবুল বারাকাত তার বইয়ে খুব ভালোভাবেই দিয়েছেন। এই আইন বাংলাদেশ সংবিধানের আর্টিক্যাল ১১/ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার; আর্টিক্যাল ১৩/ প্রিন্সিপাল অফ ওনারশীপ; আর্টিক্যাল ২৭/ আইনের চোখে সমতা এবং আর্টিক্যাল ২৮/ ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগত ভিত্তিতে বৈষম্য ইত্যাদি নীতিমালার পরিপন্থী এবং সাংঘর্ষিক। দেড় দশক আগেকার মার্কিন ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের এক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার এই আইনের ভিত্তিতে প্রায় ৩মিলিয়ন (৩০লক্ষ্) একর হিন্দু সম্পত্তি অধিগ্রহণ করেছে। একদা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ বিদ্বেষ সর্বত্র ঘৃণিত ছিলো। সেখানে কালোরা শুধুমাত্র গাত্রবর্ণের জন্যে সম্পত্তি হারাতো। শত্রূ সম্পত্তি আইনটি ‘ধর্মবিদ্ধেষ থেকে প্রসূত‘। বাংলাদেশে হিন্দুরা শুধুমাত্র ধর্মের কারণে সম্পত্তি হারিয়েছে বা হারাচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ বিদ্ধেষ আর বাংলাদেশের ধর্মবিদ্বেষ কি খুব পৃথক? জাতির ললাটে এই আইন রেখে আমরা নিজেদের ‘সভ্য‘ দাবি করতে পারি? জাতির জন্যে এই আইন একটি অভিশাপ। এ থেকে মুক্তি দরকার। ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার দৈনিক সংবাদ এক সম্পাদকীয়তে বলেছিলো, সংস্কার নয়, শত্রূ সম্পত্তি আইনটি বাতিল করুন। পত্রিকাটি যুক্তি দিয়ে বলেছিলো, সরকারের প্রতিশ্রুতিতে আমরা সন্দিহান। সরকারের উচিত আইনটি পুরোপুরি বাতিল করা। পত্রিকাটি বলেছে, এটি হলে ভুক্তভুগীরা হয়রানি ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবে। ২০২১–এ ৫০ বছর বয়সে বাংলাদেশ ডিজিটাল জাতিতে পরিণত হবে। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের অগ্রগতির সাথে সাথে এর সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অগ্রগতি ঘটবে তো? সরকার যাই করুন, কোন না কোন ফর্মে আইনটি এখনো আছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সাথে এই আইন কি সামঞ্জস্যপূর্ণ? ১৯৬৫: পাকিস্তান সরকার এক নির্বাহী আদেশে “শত্রূ সম্পত্তি (কাষ্টডি এন্ড রেগুলেশন) অর্ডার ২ অফ ১৯৬৫” জারী করে। জরুরী অবস্থাকালে ‘পাকিস্তান ডিফেন্স রুলাস‘ –এর আওতায় ৯ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ এটি জারী হয়। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট আইনটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত আখ্যায়িত করে সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চায় <২১ ডিএলআর (এসসি) পৃষ্টা ২০>। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান থেকে জরুরী অবস্থা উঠে যায়, কিন্তু শত্রূ সম্পত্তি আইনটি উঠেনা। বরং পাকিস্তান সরকার নুতন অর্ডিন্যান্স (অর্ডিন্যান্স ১ অফ ১৯৬৯) জারী করে শত্রূ সম্পত্তি আইনটি জিইয়ে রাখে। আইয়ুব খান এ সময় ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২৫শে মার্চ ১৯৬৯ ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারী করেন। ১লা এপ্রিল সংবিধান বাতিল হয়। সংবিধান বাতিল হবার পরও শত্রূ সম্পত্তি আইনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে একটি নুতন অর্ডিন্যান্স জারী হয় এবং সেটি বলবৎ করা হয় ২৫শে মার্চ ১৯৬৯ থেকে।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। একই দিন “লজ অফ কন্টিন্যুয়েন্স এনফোর্সমেন্ট অর্ডার ১৯৭১” জারী হয়। ফলে পাকিস্তানের সকল আইন সদ্য ভূমিষ্ট বাংলাদেশেও বহাল থাকলো। অর্থাৎ অর্ডিন্যান্স ১ অফ ১৯৬৯ বা শত্রূ সম্পত্তি আইনটি থেকে গেলো। ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশ সরকার শত্রূ সম্পত্তি নাম পাল্টে “ভেস্টিং অফ প্রপার্টি এন্ড এসেট অর্ডার ১৯৭২” (নির্দেশ ২৯, ১৯৭২) রাখে। ১৯৭৪ সালের ২৩শে মার্চ সরকার অর্ডিন্যান্স ১ অফ ১৯৬৯ এবং এতদসংক্রান্ত ধারাগুলো বাতিল করে এবং একই সাথে “অর্পিত ও অনাবাসী সম্পত্তি (প্রশাসন) এক্ট (এক্ট ৪৭, ১৯৭৪) চালু করে। সেই থেকে এটি শত্রূ (অর্পিত) সম্পত্তি নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এই আইনের ভয়াবহতা তেমন টের পাওয়া যায়নি। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সরকার এক্ট ৪৭, ১৯৭৪ বাতিল করে নুতন অর্ডিন্যান্স ৯২ অফ ১৯৭৬ (পরে ৯৩ অফ ১৯৭৬) জারী করেন। শত্রূ সম্পত্তি নামক আইনের চরম আঘাতটি নেমে আসে জিয়াউর রহমানের হাত দিয়ে। তার অর্ডিন্যান্সের বদৌলতে একজন তহশিলদার যেকোন সম্পত্তি ‘শত্রূ সম্পত্তি‘ ঘোষণার ক্ষমতা পান এবং সেই সম্পত্তির মূল্যের ওপর একটি কমিশন পান। তহশিলদারগন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে হিন্দু নাম দেখে দেখে হিন্দুদের বাড়ীঘর শত্রূ সম্পত্তি তালিকাভুক্ত করেন। আর একবার কারো সম্পত্তি শত্রূ সম্পত্তি হলে তা থেকে বেরিয়ে আসা ছিলো দু:সাধ্য কাজ। ওটা সম্ভব ছিলো শুধুমাত্র আদালত ও সচিবালয়ে মামলা করে, যা সাধারণ হিন্দুদের পক্ষে ছিলো অসম্ভব। এদিকে ‘লীজের‘ বিধান থাকায় প্রভাবশালী মুসলমান শত্রূ সম্পত্তি লিজ নিয়ে হিন্দুদের বাড়ীঘর থেকে উচ্ছেদ করে।
এমন অসংখ্য ঘটনা আছে যে, একজন মুসলমান হয়তো কোন হিন্দু বাড়ীর একটি অংশ লিজ নিয়েছেন, কিন্তু শক্তি প্রয়োগ করে তিনি পুরো বাড়িটিই দখল করেন। ১৯৭৭–১৯৯০ জিয়ার পর জেনারেল এরশাদের আগমন। হিন্দু বাড়ীঘর দখলের মহোৎসব চলতেই থাকে। একই সাথে এনিয়ে দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পরে। একসময় এরশাদ নির্দেশ দিলেন যে ‘আর কোন সম্পত্তি নুতন করে শত্রূ সম্পত্তি করা যাবেনা‘। ফল হলো উল্টো। ব্যাক ডেটে হিন্দু সম্পত্তি শত্রূ সম্পত্তি হতেই থাকলো। জিয়া–এরশাদ, এই দুই সামরিক শাসকের আমলে সম্পত্তি হারিয়ে বহু হিন্দু দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১৯৯১ সালে বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে, কিন্তু এই আইনের ওপর হাত দেয়না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে প্রায় পাঁচ বছর সময় নেয় কিছু একটা করতে। ১১ এপ্রিল ২০০১ পার্লামেন্টে “রেস্টোরেশন অফ ভেষ্টেড প্রপার্টি এক্ট ২০০১” (এক্ট ১৬, ২০০১) পাশ করে। এতে হিন্দুদের মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু ২০০১–র অক্টবরে নির্বাচনে বিএনপি–জামাত ক্ষমতায় আসে। ২০০২ সালের ২৬ নভেম্বর পার্লামেন্টে “রেস্টোরেশন অফ ভেষ্টেড প্রপার্টি এক্ট ২০০২” পাশ হয়। এরফলে আওয়ামী লীগের আমলে পাশকৃত আইনটি মূলত: শিঁকেয় তুলে রাখা হয়। এরফলে সকল শত্রূ বা অর্পিত সম্পত্তি ডেপুটি কমিশনারের অধীনে চলে আসে এবং বরাবরের মত তিনি সেটি লিজ দেয়ার ক্ষমতা পান। শত্রূ সম্পত্তি আইনের অত্যাচার অব্যাহত থাকে। ২০০৯–এ আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়। এই আইনটি নিয়ে তারা কিছু করার প্রয়াস পান। ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত অনেক দৌড়াদৌড়ি করে “অর্পিত সম্পত্তি প্রতর্পন (দ্বিতীয় সংশোধন) আইন ২০১৩ পাশ করে এবং এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় ১০ই অক্টবর ২০১৩ (২০১৩ সালের ৪৬ নং আইন)। এর আগে পরে বেশ কটি সংশোধন এসেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সকলই ‘গড়ল ভেল‘। প্রশ্ন হলো, ৫৪ বছর তো হলো, আর কত? এই জঞ্জাল কবে শেষ হবে? (author expresses his own views in the article )
…