বইমেলার অন্য মেলার মতো আস্তে আস্তে জন আকর্ষণ বাড়ছে
দেবারুণ রায়
বইমেলা এখন রাজ্যে রাজ্যে জন আকর্ষণের বৃত্তে। একাধারে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর আবাহনে উৎসাহী মানুষের ভিড় বাড়ছে ক্রমাগত। বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী ও বিদ্যাস্থানে সরস্বতী হাত ধরাধরি করে চলেছেন। তাই প্রতিদিন পড়ুয়াদের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে ভাগ্যান্বেষণে ব্রতী উদ্যোগী প্রকাশক, পুস্তক বিক্রেতা, লেখক, আলোচক, সমাজকর্মীর সংখ্যা। হচ্ছে সুস্থ স্বাভাবিক আধুনিক মনন ও বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের চেতনার উন্মেষ। হাজারো সভা-সমাবেশ-মিটিং-মিছিল যা পারেনি, বইমেলা তাই পেরেছে। নতুন প্রজন্মের নেট সর্বস্বতা সত্ত্বেও নতুন বইয়ের গন্ধ নতুন যুগের নতুন মানুষদেরও টানছে। গ্রন্থাগার আন্দোলনের স্রোতের উজানে এসেছিল মানুষের বই পড়ার আকাঙ্ক্ষা। জ্ঞানের আলো জ্বেলে অজ্ঞতার অন্ধকার ঘুচিয়েছিলেন বিজ্ঞানী, বিপ্লবী, সমাজতাত্ত্বিক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা। নিত্য নতুন গবেষণা, তার ভিত্তিতে প্রকাশনা এবং আরও পড়া, আরও ভাবা, দেশকাল সমাজ আর মানুষকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মহোৎসবে সামিল হয়েছিলেন অগ্রণী বিদ্বজ্জন। বিশেষ করে বাংলার মতো প্রদেশে মরুদ্যানের ভূমিকা পালন করে আসছে জেলায় জেলায় এবং শুধু জেলাসদরে নয়, মফস্বলের অনামী শহরে বইমেলার আয়োজন। যেমন চাকদা বা দিনহাটায় বইমেলার সাড়া জাগানো নিশ্চয়ই জনচেতনার উত্তরণের ছবি। লাইব্রেরির শূন্যতা পূর্ণ করে সমাজ-অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য যোগদান বইমেলার। সারা বছর বইয়ের ব্যবসাকে, বাজারের সনাতনী অস্তিত্বের পাশাপাশি অন লাইনের ব্যাপক নেটওয়ার্ককে সঞ্জীবনী সুধাসিঞ্চন করে চলেছে বইমেলাগুলো। এতে বই বিক্রির পেশা যেমন নানা সাংগঠনিক চেহারায় সঞ্জীবিত, তেমনি বইয়ের বিক্রি, পাঠ ও তা নিয়ে চর্চা বেড়েছে নতুন করে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে সারা দেশে দেশ বিদেশের বই কিনে বা লাইব্রেরির মাধ্যমে পড়ার পর লেখকগোষ্ঠী পাঠকগোষ্ঠী গড়ে উঠত। মুক্তচিন্তার মুক্তধারায় উদ্ভাসিত সমাজের মুখে আজকের মতো কলুষচিহ্ন ছিল না। রাজনীতি ও অর্থনীতির বিপরিসরেও ছিল সেই মুক্তি ও যুক্তিবাদের প্রতিফলন। লাইব্রেরি আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর থেকেই সেই আলোকিত দিন অস্তমিত। মন্থন যখনই বন্ধ তখনই যে বন্ধ্যা সময়ের জন্মলগ্ন। সেই অভিশপ্ত লগ্ন হয়তো কাটছে , মন্থর গতিতে হলেও মন্থন নতুন করে শুরু হয়েছে। শুধু বাংলায় নয়, সারা দেশেই বইমেলার আয়োজন হচ্ছে। লোকে হৈহৈ করে বই কিনছে পড়ছে চর্চা করছে। বই পড়ার খিদে বাড়ছে বলে বইয়ের লেখা ও প্রকাশের অর্থাৎ বইয়ের জোগানও বাড়ছে। বাজারের প্রতিযোগিতার সঙ্গে তাল মেলাতে হলে চাই উৎকর্ষ। সুতরাং লেখাপড়ার মানও বাড়তে বাধ্য সমানতালে। এই বাড় বন্ধ্যাত্বের অন্ধত্ব কাটিয়ে দিতে বাধ্য। “ভুখা মানুষ ধরো বই, ওটা হাতিয়ার ,” এই স্লোগান অর্থবহ শুধু পেটের খিদে নয়, জ্ঞানের খিদের ক্ষেত্রেও। শিলিগুড়ি, কল্যাণী, শান্তিপুর, চাকদা, নিউটাউন, গুয়াহাটিতে পাঠক-ক্রেতাদের সংখ্যা এটাই প্রমাণ করেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে নবদিগন্ত উন্মোচন করে দিতে এইসব বইমেলাগুলো যে কতটা উপযোগী তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। বিভিন্ন বিখ্যাত ও প্রাচীন পাবলিকেশন সংস্থার পাশাপাশি অনামী , অল্প নামীরাও মন্থনে পাওয়া অমৃতকলসের সন্ধান দিয়েছেন পাঠক, দর্শক, ক্রেতাদের। ভিরাসতের মতো রুচিশীল সংস্থার পাঁচটি বই বেরল নিউটাউন বইমেলায়। বিশিষ্ট লেখক অভিজিৎ সেন, ঋতুপর্ণা খানের বই যথেষ্ট সমাদৃত এই মেলায়। ঋতুপর্ণার হোমকামিং একটি পুরস্কারের জন্য মনোনীতও হয়েছে। আমার প্রথম বই ” ঐতিহাসিক ভুলের সেই সাতদিন ও বসু বুদ্ধ মমতা মোদী “র যে ক’টি কপি প্রথম প্রকাশ উপলক্ষে কলকাতার বাজারে অর্থাৎ নিউটাউন মেলায় ছিল সেগুলো নিঃশেষিত। কলকাতা বইমেলায় এই সম্ভাবনার ও ভাবনার প্রতিসরণ নিয়েই সদ্যোজাত গ্রন্থগুচ্ছ অবশ্যই উদ্ভাসিত হবে। নিউটাউন বইমেলায় ২৯ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হয় ভিরাসতের বইগুলি। অনুষ্ঠানের মঞ্চে বিশেষ অতিথি ছিলেন সাংবাদিক অঞ্জন বসু , সাহিত্যিক অমর মিত্র, কবি কালীকৃষ্ণ গুহ , আশিস গিরি জহিরুল হাসান, সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী, কংগ্রেস নেতা শুভঙ্কর সরকার , তৃণমূল নেতা ও প্রণবপুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল। এই মেলায় প্রগতিশীল ও আধুনিক বিষয়বস্তু লেখালিখির জমজমাট বাজার দেখে আশাবাদী হবেন পাঠক-লেখক-বাণিজ্যের উদ্যোগীদের যৌথ উদ্যোগ। আকাশ দূষণমুক্ত হোক অক্ষয় অক্ষরের মধুক্ষরা মন্ত্রে। নবদিগন্ত, নবযুগ উন্মোচনের সূত্রধর ও সারথী , মন্দির ও মসজিদ হোক বইমেলা, বই, ভালো বই।