ইউপির টেনিদাকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই যোগীর – উত্তর প্রদেশে ব্রাহ্মণের অভিশাপ আর ঠাকুরের যুদ্ধে বিজেপিকে বাঁচাচ্ছে বিরোধীরা
দেবারুণ রায়
বাংলায় বিজেপির তের মণ তেল পুড়লেও রাধা নাচেনি। মানে সত্তাসুখের শিকে ছেঁড়েনি। বেশ ক’জন হবু মুখ্যমন্ত্রী ধূতি পাঞ্জাবি কিনে রেখেছিলেন। আর তেমনি মন্ত্রী সান্ত্রী হওয়ার নিশ্চিত কুণ্ডলীমতে বেশ কিছু অর্ডার ছিল দর্জিবাড়িতে। সংঘপতিরা তাঁদের প্রথম পছন্দমাফিক দুজন ব্রাহ্মণকে তিলক পড়িয়ে রেডি রেখেছিলেন। একজন ভোটে পথে ছিলেন। আর অন্যজন ছিলেন পথ্যে ও নেপথ্যে। যথাক্রমে শুভেন্দু অধিকারী ও অনির্বাণ গাঙ্গুলি। বিকল্প হিসেবে অব্রাহ্মণ উচ্চবর্ণ স্বপন দাশগুপ্ত ও নিপাতনে সিদ্ধ দিলীপ ঘোষ। এটা ধান ভানতে শিবের গীত নয়। কারণ বাংলায় কুচকাওয়াজই সার। বিজেপি ক্ষমতায় আসার জায়গায় ছিলও না। আসেওনি। তৃণমূলের বাঘের মাসিরা ভেবেছিল তারাই বাঘ। তাদের কৃপাতেই মমতা ক্ষমতায় আছেন। ভুল সবই ভুল প্রমাণিত হয়ে ৯৯জন অকূলে ভেসে গিয়ে সমূলে ফিরছে।
উত্তর প্রদেশের ঘটনা এমন নয়। কিন্তু সংঘের নেতা খোঁজার খেলাটা এক। এক্ষেত্রে একটা সমস্যা আর দুটো সমাধানের বিন্দু। এবার ব্রাহ্মণ নেতা অবশ্যই চাই। কারণ ঠাকুর-রাজে বামুনঠাকুররা ভীষণ উত্তেজিত। নেহাৎ যোগী সাক্ষাৎ গোরখপুর মঠের মতো রাজনৈতিক প্রভাবশালী সংগঠনের মোহন্ত ও বয়সে যুবক এবং গরু-গেরুয়ায় গরম বিভাজক বক্তা বলে এতদিন পূর্বাশ্রমের ঠাকুর পরিচিতি হজম করেছেন। কিন্তু ব্রহ্মশাপের হাত থেকে বাঁচতে ভোটের আগে ঝুঁকি নিতে চাননি সংঘের মাথারা এবং তাঁদের অন্তর্যামী মোদি। এই সূত্রেই অজয় মিশ্রের ভাগে স্বরাষ্ট্র এল প্রতিমন্ত্রীর তকমায়। এটা একটা নিপুণ রাজনীতির বার্তা। উত্তর প্রদেশের দল ও জনগণের জন্য রচিত চিত্রনাট্যের চরিত্রায়ন। প্রথমত সংঘের সুটেবল বয় শ্রীমৎ আদিত্যনাথকে বোঝানো , তাঁর রাজ্যপাটে সুস্থিতির স্বার্থে উত্তর প্রদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতিগোষ্ঠী ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা হিসেবে ব্রাহ্মণ অজয় মিশ্রের অভাবনীয় উত্থান। কিন্তু সেটা লখনউতে নয়। একেবারে দিল্লিতে। যেখানে উত্থান হলে যোগীর যন্ত্রণা নেই। রাজ্য মন্ত্রিসভায় নিলে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস পড়ত। অন্যদিকে অমিত শাহকে যেমন ব্রাহ্মণ নেতা খুঁজে বের করতে বলেছিলেন , ঠিক তেমনটিই পাওয়া গেছে। যিনি ভবিষ্যতে যোগীর বিকল্প হতে পারবেন। এবং বড় নেতা না হওয়ার দরুণ মোদির সৌরমণ্ডলের কক্ষচ্যুত হবেন না। যোগীকে যেমন রীতিমত রেয়াত করে চলতে হয় অজয়ের বেলায় তা হবেনা। যেহেতু উত্তর প্রদেশটাই বিজেপি রাজনীতির আসল রঙ্গভূমি তাই নিয়ন্ত্রণ চাই ষোল আনা।
উল্লেখ্য, যোগীর রাজত্বকালে ঠাকুরদের পোয়াবারো হয়েছে এবং অনগ্রসর দলিত সংখ্যালঘুরতো কথাই নেই, ব্রাহ্মণরাও কলাটা মুলোটায় বঞ্চিত। অথচ সে রামও নেই সে অযোধ্যাও নেই। না আছে বাজপেয়ী, জোশী এমন কি কলরাজের কাল। ঠাকুর রাজনাথেরও দিন গিয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় আগমার্কা ইউপি ওয়ালা ব্রাহ্মণ বলতে শুধুমাত্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র। লখিমপুর খেড়ির বাইরে যাঁর কোনও রাজনৈতিক পরিচিতি নেই। আর নিজের বিধানসভা কেন্দ্র নিঘষনের লোকেরা ছাড়া আর কেউই “টেনি মহারাজের” করিশমা দেখেনি। এইরকম একজন নেতাকে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মোদিত্ববাদী নেতারা ভরসা করেন। যাঁর মধ্যে লখনউ, এলাহাবাদ, বারাণসীর এলিটিজম নেই। জটে জড়ানো অতীত এবং আনুগত্যের নিশ্চয়তা আছে। লখিমপুর খেরিতে ওঁর রাজনৈতিক গুরু এক কুর্মি নেতা। এই কেন্দ্রে ১৯৬২ থেকে কোনও বামুন জেতেননি সংসদে। চিরকাল কুর্মি অর্থাৎ অ-যাদব অনগ্রসরদের গড়। যথেষ্ট নির্ভুল অঙ্ক কষে অমিত শাহ এই কেন্দ্রে অজয়কে তুলে ধরার সুপারিশ করেন বসের কাছে। এবং আগস্ট মাসের মন্ত্রিসভা রদবদলে যখন অজয়ের কপালে বিজয়তিলক লাগল, বিজেপির দুঁদে নেতারাও বেশ চমকে গেলেন।
জেলার ন’টা বিধানসভা কেন্দ্রেই লখিমপুরের টেনি দা (মহারাজ)র রমরমা। নিঘষন ওঁর গ্রামের বিধানসভা কেন্দ্র। সেখানে আশিসকে আগামী ভোটে দাঁড় করানোর জন্যে সব বন্দোবস্ত ছিল পাকা। স্লোগান দিচ্ছিলেন বিজেপি কর্মীরা। “নিঘষন কা ইয়ে পুকার। মনু ভাইয়া অবকি বার।” এরই মধ্যে লঙ্কাকাণ্ড লখিমপুরে। আশিস ক’দিন ১৫ কিমি দূরের নেপালে কাটিয়ে পিতৃআজ্ঞায় পুলিশের কাছে গেলেন। বুঝলেন, বাবারও বাবা আছে। আসরে অবতীর্ণ মহামহিম সুপ্রিম কোর্ট। রাজ্য যদি আদালতের নির্দেশ অমান্য করে তার দায় নিতে হবে মুখ্যমন্ত্রী যোগীকে। তাঁর স্থায়িত্ব হবে অনিশ্চিত। দলের বাইরে তো বটেই। ঘরেও শত্রুর অভাব নেই। রাজনীতির পাঠশালায় পড়া দুঁদে নেতাদের মঠের নেতার জয়ধ্বজা ওড়াতে হচ্ছে। সবাই লোহা গরম হবার অপেক্ষায়। সুতরাং অজয় মিশ্রের ভাবমূর্তির চেয়ে তাঁর নিজের ভাবমূর্তির সংকট তাঁর ও দলের কাছে অনেক বেশি উদ্বেগের। তবে ৩০২ এর মামলা এবং তাতে চার্জশিট হলে আইনি না হলেও জনসন্তুষ্টি ও ভাবমূর্তির খাতিরে সরিয়ে দিতে হবে অজয় কে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপরিষদ থেকে। কারণ তা নাহলে খোদ প্রধানমন্ত্রীই বিরোধীদের রাজনৈতিক স্লোগানের খোরাক যোগাবেন। এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতি উত্তর প্রদেশের বিরোধীদের বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে। কিন্তু যোগী সহায়। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে আটকে, তৃণমূলকে ছেড়ে দিয়েছেন বলে রাহুলের হুল ফোটানো এবং প্রিয়াঙ্কার প্রিয় বর্ষণ অখিলেশের প্রতি রীতিমত ঘেঁটে দিয়েছে বিরোধী রাজনীতির সামান্য ও অসামান্য সঞ্চয়ের খুদকুঁড়ো। এখন ব্যাপারটা দাঁড়ালো যে, বিজেপি হঠাও কমন কর্মসূচি হলেও তৃণমূলের “পৃথিবী আমারে চায়” ও কংগ্রেসের জন্মগত সত্তার অধিকার এবং মায়াবতীর ভোটারদের মায়ায় আসক্তির দরুণ ওবিসি সমর্থন ভূমিতে কংগ্রেস ও বিজেপির অক্ষম ও পরাক্রমশালী দৃষ্টি যুক্তিসংগত রাজনীতির বাস্তবতাকে পিষে মারছে অনগ্রসর অধ্যুষিত উত্তর প্রদেশের প্রতীক লখিমপুরের নিশ্চিত বিরোধী ঐক্যের নবদুর্বাদলকে। এই নবদুর্বাদলই হতে পারত আগামী ইউপির দুর্বাদলশ্যাম।