EntertainmentNewsSambad MatamatWorld

খোলা চিঠি – ২০২৩ এর বঙ্গ সম্মেলন ঘিরে কিছু কথা

দিলীপ চক্রবর্ত্তী, কর্মকর্তা : সি এ বি

আমরা উত্তর আমেরিকার বাঙালীরা প্রতি বছর বঙ্গ সম্মেলনের দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকি। এ বছরও একই উৎসাহ ৩০ শে জুন আটলান্টিক সিটিতে গিয়ে দর্শকগণ যা দেখলেন সেটা আর যাই হোক বঙ্গ সম্মেলন নয়, বঙ্গ সম্মেলনের নামে এক চরম অবস্থার তান্ডব চলছিল। ব্যাজ নেই, ব্যান্ড নেই, রেজিস্ট্রেশনের কাগজ নেই, জলখাবার নেই, কিছুই নেই, এমন কি সেচ্ছাসেবকদেরও দেখা যাচ্ছিল না, কয়েকজন ছাড়া। এ অবস্থায় এন এ বি সি কর্তাদের কোন হদিস নেই,, ফলতঃ দর্শক, সেচ্ছাসেবক, ভেন্ডাররা এমনকি শিল্পীরাও অসহায় হয়ে পরেন। যেহেতু বঙ্গ সম্মেলন সি এ বির স্বপ্নজাত, সুতরাং এ পরিস্থিতির জন্য সকলেই সি এ বি কেই দোষারোপ করলেন। যদিও এর জন্য সিএ বি মোটেই দায়ী নয়, কিন্তু এখন সে ব্যাখ্যায় যাবো না।

বর্তমানে সি এ বি দর্শকদের কাছে, ভেন্ডারদের কাছে, সি এবির স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে এবং আগত শিল্পীদের কাছে সি এ বির প্রেসিডেন্ট রণদেব সরকার নিঃশর্ত দুঃখ প্রকাশ  করছেন অনেক আগেই। আপনাদের সকলের হাত ধরে বিগত ৪২ বছর ধরে আমরা বঙ্গ সম্মেলনে আনন্দের রসধারায় অবগাহন করেছি, আমরা কেউ কখনও কক্ষচ্যূত হই নি, কিন্তু এবার সংঠকদের অবিমৃষ্যকারিতায় আমাদের প্রিয় বঙ্গ সম্মেলন মুখ থুবরে পড়ে গেল। দায় যার ই হোক না কেন, এ পীড়াদায়ক ঘটনা আমাদের সি এ বির উপর এক গভীর হতাশার কালো মেঘের ছায়া নামাল, এ যন্ত্রনা আর সকলের মতই আমাদের সি এ বির বক্ষেও গভীর বেদনাদায়ক ক্ষত সৃষ্টি করেছে। আর এন এ বি সি র  উপর নেমে এলো শিল্পীদের অবমাননার অভিযোগ। অভিযোগ পাল্টা অভিযোগে তো সমস্যার সমাধান হবে না, তাই সেদিকে যাবো না, তবে দু একটা কথা না বললেই নয়। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে জানাচ্ছি, শিল্পীদের আবদার, ইচ্ছা বা অযৌক্তিকতা দেখে অনেক সময় আমার মনে হয়েছে -কিছু শিল্পী অল্পতেই বিচলিত হন । তবে একটা কথা অত্যন্ত শ্লাঘার সাথে বলতে পারি উত্তর আমেরিকার অনাবাসী বাঙালী তথা ভারতীয়রা অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ, বিনয়ী এবং শ্রদ্ধাশীল মানুষ হিসেবেই পরিচিত। আর এ বছর মূলত কয়েকজন অনভিজ্ঞ ব্যক্তি এন এ বি সি পরিচলনা করেছেন, এদের ব্যবহারে দুঃখ পেলে এন এ বি সি তথা সি এ বির পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি ও ক্ষমা ভিক্ষা করছি।  

উত্তর আমেরিকার বাঙালীরা বঙ্গ সম্মেলনের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন, কারণ তাঁদের কাছে যে কোন বঙ্গ সম্মেলন দুর্গাপূজার থেকেও বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে। এ বছরও মানুষ বহু অপেক্ষার পর জুনের ৩০ তারিখে নিউ জার্সির এটলান্টিক সিটিতে বঙ্গ সম্মেলন দেখতে হাজির হয়েছিলেন। দর্শকগণ বহু আশা নিয়ে এ উৎসবে এসে থাকেন। আর এ বছর কর্তৃপক্ষ সঙ্গীত, নৃত্য,সাহিত্য ছাড়া আরও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যেমন ফুটবল প্রতিযোগিতা, বঙ্গশ্রী ইত্যাদি সহ রসনাতৃপ্তিকারক নানারকম সুস্বাদু ব্যঞ্জনাদির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। ঐতিহসিক জিম হোয়েলান বোর্ড ওয়াক হলের আকর্ষণ তো ছিলই। সত্যি বলতে কি আটলান্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত এ নগরী রাতের লাস্যময়ী নারীর মত সকলকেই তার সৌন্দর্য উপভোগের হাতছানি দেয় । এ নগরীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষন গ্যাম্বলিং ক্যাসিনোগুলি বিভিন্ন মানুষকে মৌমাছির মত আটলান্টিক সিটিতে নিয়ে আসে। সেজন্য এ নগরী নারী, সুরা আর দ্যূতক্রীড়ার পীঠস্থান।  

তাই যে কোন বাঙালীর কাছে প্রথম প্রেম ছিল বঙ্গ সম্মেলন আর দ্বিতীয়টি ছিল ক্যাসিনোগুলি। বেশীরভাগ দর্শক এক তীরে দুই পাখী বিদ্ধ করতে এসেছেন, কিন্তু প্রথম পাখীটি আর বিদ্ধ হল না, কারণ বঙ্গ সম্মেলনের আয়োজক KPC BHOF শুক্রবার হলটি ব্যবহারের অধিকার পেলেন না। ফলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হল না। সেজন্য তাঁরা কিছু দূরে “সি ভিঊ” নামে একটি হোটেলে অন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। দর্শকরা দুধের বদলে ঘোল খেলেন। বঙ্গ সম্মেলন এ বছর এভাবেই শুরু হয়েছিল। বঙ্গ সম্মেলন কি ভাবে করা হয়, আপনাদের একটু জানাতে চাই।   সাধারণতঃ বঙ্গ সম্মেলন আমেরিকার কোন বাঙালী এসোসিয়েশনকে করতে দেওয়া হয়। এ বছর KPC BHOF কে করতে দেওয়া হয়েছিল। একবার বঙ্গ সম্মেলন কোন এসোসিয়েশনকে করতে দেওয়ার “চুক্তি” দিলে সি এ বির কোন হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকে না। যদিও সি এ বি ভারপ্রাপ্ত সংঘের প্রতি সর্বদাই সজাগ দৃষ্টি রাখে। কিন্তু এ বছর ভারপ্রাপ্ত কনভেনার পার্থ মুখার্জী স্বেচ্ছায় সকলকে এড়িয়ে গেছেন, কারো কোন পরামর্শ নেননি, ফলে যা হওয়ার সেটাই হয়েছে, সম্মেলন অব্যবস্থার শিকার হয়ে ধরাশায়ী হয়েছে। ফলে দর্শকগণ বিভিন্ন অব্যবস্থার শিকার হয়েছেন, ব্যবসায়ীরা তিন দিনের ব্যবসার সময় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, শিল্পীরাও এ বিশৃঙ্খলার হাত থেকে রক্ষা পাননি, এ হেন অব্যবস্থার মধ্যেও যারা নিরলসভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সকলকে খুশি ও আরাম দায়ক পরিস্থিতির মধ্যে রাখার প্রয়াস করেছেন, সে সব স্বেচ্ছাসেবীদের স্মরণে রাখা উচিত । এঁরা সকলেই স্বার্থহীনভাবে  নিছক বঙ্গ সম্মেলনকে ভালোবেসেই নিজেদের শ্রম, অনেক সময় অর্থ দান করে সকলের আবদার বা দাবী ( যতই অযৌক্তিক হোক না কেন ) পূরণ করেন, অনেক সময় তাঁরা শিল্পীদের অন্যায় আবদার রক্ষা করতে বাধ্য হন, বেশীরভাগ সময়ই শিল্পীরা কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করে না। 

টি ভি ৯য়ে এক শিল্পী জানালেন – তিনি আর বঙ্গ সম্মেলনে আসবেন না, কারণ বঙ্গ সম্মেলন থেকে তাঁর যা পাওয়ার ছিল তিনি পেয়ে গেছেন। দুঃখের কথা কিছু শিল্পী বঙ্গ সম্মেলনে শুধু পেতে আসেন, কিছু দিতে আসেন না ! টি ভি ৯ এর আলোচনা চক্রে এন এ বি সি-র পক্ষ থেকে শ্রী প্রবীর রায়, শ্রী প্রনব দাস ও শ্রী ইন্দ্রাশিস বসু রায় চৌধুরী তাঁদের বক্তব্যে আহ্বায়কের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেন। প্রবীরবাবু বলেন – অনেক শিল্পিকেই প্রথমে সি এ বিই বঙ্গ সম্মেলনে আত্ম প্রকাশের করে সুযোগ দিয়েছে । বিদ্যাসাগরের উদাহরণ ভুলে গেছেন, নিজের জিনিস তিনি নিজে বহন করতেন।  উত্তর আমেরিকায় সকলে সেটাই করেন। সত্যি বলতে কি আপনারা দাবী করছেন আপনারা শিল্পী, তা হলে সে শিল্পী সত্তার সহনশীলতা ও ঔদার্যের উদাহরণ স্থাপন করুন। একজন শিল্পী তো “মিট এন্ড গ্রীটে” এলেন না, তিনিও প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। আসেননি কেন, কোথায় ছিলেন? এক লেখক তো নিজের বই বিক্রী করে গেলেন – সকলে বলছে। যা হোক অভিযোগ আর পালটা অভিযোগে কোন গঠনমূলক কাজ হয় না। সেজন্য বিভেদের ক্ষত গভীর না করে আগামী বছর কি করে ভালোভাবে বঙ্গ সম্মেলন করা যায়, সে পরামর্শ দিয়ে এন এ বি সিকে সাহায্য করুন। গত ৪২ বছরের সুখের অভিজ্ঞতা, এক বছরের বিশৃঙ্খলায় শেষ হয়ে যায় না। আসুন আমরা সকলে মিলে মিশে কাজ করে বঙ্গ সম্মেলনকে পূর্বের মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করি।

উত্তর আমেরিকার বাঙালীরা অত্যন্ত অতিথি পরায়ন ও শ্রদ্ধাশীল। আপনারা অনেকেই হয়ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোকের বাড়িতে থেকেছেন, আমার স্থির বিশ্বাস তাঁরা আপনাদের যত্নের কোন ত্রুটি করেননি। তবে একটা কথা বলি – শ্রদ্ধাশীলতাই শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়। অপমান করার জন্য ২০২৩র বঙ্গ সম্মেলন কর্তৃপক্ষ আপনাদের ডেকে আনেনি, দু একজন অনভিজ্ঞ পরিচালকের জন্য এটা হয়েছে এবং সেজন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী । আসুন, আজকের ব্যর্থতা ভুলে সকলে মিলে পরের  বঙ্গ সম্মেলনকে সফল করি ও উত্তর আমেরিকায় বাংলার সংস্কৃতিকে তুলে ধরি। বিভাজনের খাদ গভীর ও প্রসারিত না করে আসুন একসাথে কাজ করি যাতে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর কখনও না হয়।  

ইতিমধ্যে সি এ বি বঙ্গ সম্মেলনের বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান শুরু করেছে। সি পি এ দ্বারা অডিট করতে একটু সময় লাগবে জানিয়েছে আমাদের অনুসন্ধান কমিটি। এ কমিটির রিপোর্ট পেলেই আমরা রিপোর্টটি প্রকাশ করব আমাদের সকল সভ্য, সমর্থক ও জনসাধারণের জন্য।

সি এ বি সম্পর্কে দু একটা কথা জানাতে চাই আপনাদের সকলকে। কোভিডের সময় সি এ বি কলকাতা ও মুম্বাইএর শিল্পী ও কলাকুশলীদের আর্থিক সাহায্য করেছে। আম্ফানে নিঃপীড়িত মানুষের জন্যও সিএ বি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। বর্তমানে সি এ বি “মুক্তি” সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে সুন্দরবনের গ্রামে রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করেছে, সে সাথে সাধ্যানুযায়ী হারিকেন প্রুফ বাড়ি তৈরী করা শুরু করেছে। এককথায় সি এ বি আজ শুধু বঙ্গ সম্মেলন নিয়েই নয়, জনহিতকর কাজ করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আগামীতে জীবনের মূল্যবোধ ও মান উত্তরনের জন্যও সি এ বি নিরলসভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে।আশা করি, আগামী বঙ্গ সম্মেলনে আবার দেখা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.