সূর্যের অন্তিম কিরণ থেকে সূর্যের প্রথম কিরণ পর্যন্ত
দিলীপ গুহ
গত তিরিশে জুলাই, রবিবার, দিল্লীর বেঙ্গল এসোসিয়েশন আয়োজিত চতুর্থ নাট্যমেলায় ,বঙ্গসংস্কৃতি ভবনের মুক্তধারা অডিটোরিয়ামে মঞ্চস্থ হল দিল্লীর প্রগতিশীল নাট্যগোষ্ঠী ‘থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম ‘ এর বহু প্রতীক্ষিত নাটক “সূর্যের অন্তিম কিরণ থেকে সূর্যের প্রথম কিরণ পর্যন্ত “। পূর্ণেন্দু ভট্টাচার্যের বলিষ্ঠ পরিচালনায় প্রত্যাশা মতই সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছে এই দল।
‘থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম’ এর যাত্রা শুরু 1995 সালে, প্রথম মঞ্চস্থ নাটক শ্রদ্ধেয় মনোজ মিত্রের লেখা “অলকানন্দার পুত্রকন্যা” এবং পূর্ণেন্দু ভট্টাচার্যের লেখা “রামরাজ্য”। সমাজ সচেতনতার ভাবনা নিয়ে কয়েকজন নাট্যপ্রেমী সেদিন একজোট হয়েছিলেন মাঝে কিছুদিনের জন্য বিরতি আসে ক্লাবের কর্মকাণ্ডে, তবে 2009 সাল থেকে আবার ধারাবাহিক ভাবে চলতে থাকে ক্লাবের নাটক সহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 2010 এর 8ই মার্চ ক্লাব রেজিস্টার্ড হয়।
দিল্লীর একটি অন্যতম সংস্কৃতিমনস্ক দল হিসাবে ‘থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম’ এর এবারের উপস্থাপনা, প্রত্যাশা মতই তার জায়গা চিনিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে। মূল নাটকটি বিশিষ্ট হিন্দীভাষী লেখক ও নাট্যকার শ্রী সুরেন্দ্র বর্মার “সূরিয়া কি অন্তিম কিরণ সে সূরিয়া কি পহেলী কিরণ তক ” এর বাংলা রূপান্তর। অনুবাদ করেছেন গ্রুপের সদস্যা শ্রীমতী ভাস্বতী ঘোষ , যাঁর নিজের লেখা ও নাট্যরূপ দেওয়া বেশ কয়েকটি নাটক এর আগে মঞ্চস্থ হয়েছে ওনার নিজের এবং দিল্লীর অন্য নাট্যদলেও । নাটকটি পরিচালনা করেছেন দিল্লীর বিশিষ্ট শিল্পী ও মঞ্চ – পরিচালক শ্রী পূর্ণেন্দু ভট্টাচার্য্য, যিনি একজন সফল সিনেমা ও ওয়েব সিরিজ অভিনেতা ও।
নাটকটির নির্মাণ নিয়ে এই সাংবাদিকের সাথে কথা বলার সময় পূর্ণেন্দু বলেন যে তিনি আশি’র দশকের শেষের দিকে এই হিন্দী নাটকটি প্রথম দেখেন ‘এনএসডি রেপার্টরী’ এর উপস্থাপনায় এবং তখন থেকেই এটি বাংলায় করার কথা মনে আসে। এরপর প্রবীণ পরিচালক শ্রী রাজেন্দ্র নাথের সহায়তায় তিনি শ্রী সুরেন্দ্র বর্মার সাথে যোগাযোগ করেন। সুরেন্দ্রজী জানতে চান যে তিনি কেন এই নাটকটি করতে চান। পূর্ণেন্দু বলেন ” পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন নারী আপন অন্তঃশক্তিতে কি ভাবে প্রতিবাদী হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সেটি দেখানোর জন্য “। সুরেন্দ্রজী অনুমতি দেন নাটকটি করার জন্য। এরপর দলেরই সদস্যা ভাস্বতী অনুবাদ করেন ” সূর্যের অন্তিম কিরণ থেকে সূর্যের প্রথম কিরণ পর্যন্ত “, এবং ওক্কাক (রাজা) এর চরিত্রে অভিনয় করার জন্য দিল্লীর বিশিষ্ট শিল্পী, পলাশ দাস, সহমতি জানানোর পর নাটকটি মঞ্চস্থ করার প্রস্তুতি শুরু হলো।
এটি একটি তিন অঙ্কের পূর্ণাঙ্গ নাটক, মোট চরিত্র সংখ্যা আট। তিন মুখ্য চরিত্র হল রাজা ওক্কাক, অভিনয়ে দিল্লীর বিখ্যাত শিল্পী শ্রী পলাশ দাস, রাণী শীলবতী – অভিনয়ে রুনা ভট্টাচার্য এবং প্রতোষ – অভিনয়ে শ্রী সর্বাশীষ ভট্টাচার্য….. এক সূর্যাস্ত থেকে চন্দ্রোদয়ের সাথে সাথে যাদের অপরিবর্তনীয় জীবন বদলে যায় সম্পূর্ণ ভাবে !
গল্পের প্রেক্ষাপট দশম শতাব্দীর মল্ল রাজ্য। সেখানকার জনপ্রিয়, পরাক্রমশালী রাজা ওক্কাক অপুত্রক। পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে আক্রমণের অহেতুক আশঙ্কায় অমাত্য পরিষদ নপুংসক রাজা ও অসম্মত রাণীকে বাধ্য করে উত্তরাধিকারীর জন্য তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়োগপ্রথায় সম্মতি দিতে। নাটক এগোতে থাকে বলিষ্ঠ সংলাপের সঙ্গে রাজা ও রাণীর মানসিক দ্বন্দ্বের প্রকাশে…
ব্যক্তিসত্ত্বার সাথে সামাজিক মূল্যবোধ এর যে সংঘাত, সেটাই এই নাটকের মূল উপজীব্য। নাটকের প্রতিটি চরিত্র তাঁদের চরিত্রায়নে সম্পূর্ণ ভাবে প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। অন্যান্য চরিত্রে প্রতোষ সর্বাশীষ ভট্টাচার্য, মহত্তারিকা তন্দ্রা রায়, মহামাত্য শঙ্কর দে, মহাবলাধিকৃত কুশল ব্যানার্জী এবং রাজপুরোহিত সুবাস রায় আপন ভূমিকায় যথাযথ।
রাজা ওক্কাকের ভূমিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত অভিনেতা শ্রী পলাশ দাসের অভিনয় এককথায় অনবদ্ ! তাঁর বাচনভঙ্গী, শরীরী ভাষা, অসহায়ত্বের মধ্যেও বলিষ্ঠতার প্রকাশ ….. দীর্ঘদিন মনে রেশ রেখে যাবে !মহাদেবী শীলবতীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুপ্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী রুনা ভট্টাচার্য। একাধিক পুরষ্কারপ্রাপ্ত রুনা এই বিশেষ ভূমিকায় কোথাও যেন নিজেকেও ছাপিয়ে গেছেন !