EntertainmentGeneralNewsSambad Matamat

জ়ুবিন গর্গের আকস্মিত মৃত্যু  মেনে নিতে পারছেন না কেউ 

বিভু ভট্টাচার্য 

অসমসহ সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চল জুড়ে শোকের আবহ। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, সিঙ্গাপুরে আকস্মিক দুর্ঘটনায় প্রয়াত হয়েছেন আমাদের সকলের প্রাণের প্রিয় শিল্পী জুবিন গর্গ। কফিনবন্দি হয়ে দেশে ফিরেছেন জ়ুবিন। প্রয়াত শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে হাজার হাজার  অনুরাগী গুয়াহাটির পথে নামেন। চোখের জলে তাঁরা বিদায় জানান  প্রিয় শিল্পীকে। উল্লেখ্য, প্রয়াত জ়ুবিনের মৃত্যুর শংসাপত্রে স্পষ্ট লেখা, তাঁর জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে। 

সিঙ্গাপুর হাই কমিশনের তরফে গায়কের মৃত্যুর যে শংসাপত্র পাঠানো হয়েছে তাতে জ়ুবিনের জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অসম সরকারের তরফে তাদের কাছ থেকে ময়না তদন্তের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো হয়েছে।

একজন শিল্পীকে এভাবে, এতটা ভালোবেসে বিদায় জানানো যায় ! হয়তো জুবিন গর্গকে ঘিরে এমনটা না ঘটলে বিশ্বাস হতো না। ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ, সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে একটাই নাম : জুবিন। সবাই কাঁদছে এক সঙ্গে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো শিল্পীর মৃত্যুকে ঘিরে এমন সর্বজনীন শোক মিছিল খুব কমই দেখা গেছে।

অথচ এই মানুষটি ছিলেন না কোনো সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত শিল্পী, ছিলেন না সরকারের প্রিয়ভাজনও। বরং ছিলেন শাসকশ্রেণির সমালোচক। জুবিন গর্গ ছিলেন এক ব্যতিক্রম*। যখন আসামে উলফা ফতোয়া দিল হিন্দি-বাংলা গান গাওয়া যাবে না, তখন তিনি সাহসের সঙ্গে মঞ্চে হিন্দি-বাংলা গান গেয়েছেন। CAA ও NRC বিরোধী আন্দোলনে সরব ছিলেন। সরকারের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের সমালোচনায় ছিলেন নির্ভীক। এমনকি প্রকাশ্যে বলেছেন -আমার কোন জাত নাই, ধর্ম নাই, আমার কোন ভগবান নাই, আমি মুক্ত, *আমি সমাজতান্ত্রিক-বামপন্থী।

সাধারণত জনপ্রিয় শিল্পীরা এড়িয়ে চলেন এসব বিতর্কিত অবস্থান, অথচ জুবিন নিজের চেতনাদীপ্ত  অবস্থান থেকে এক চুলও সরে আসেননি। এত ভালোবাসার এইটাই কারন। মানবিকতার এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তিনি । জুবিন ছিলেন সমাজসেবক, নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর। অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন, দুস্থ ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন।প্রকৃতি ও প্রাণীর প্রতি ছিল তার গভীর টান। তিনি শুধু গানেই নয়, কাজেও প্রমাণ করেছিলেন মানুষের জন্যই তাঁর শিল্প, তাঁর জীবন। আহত পশু- পাখিদের আশ্রয় দেওয়া, গাছ লাগানো, অসুস্থদের চিকিৎসার খরচ দেওয়া- এসব ছিল তাঁর নিত্যদিনের অভ্যাস।

ফিল্মফেয়ার কিংবা আইফা পুরস্কারের ঝলকানি তাঁকে আসাম থেকে সরাতে পারেনি। অসমিয়া সিনেমার সবচেয়ে দুঃসময়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পুনর্জাগরণের মুখ। ৪০ টি ভাষায় গেয়েছেন মোট ৩৮ হাজার গান, বাজাতে পারতেন বারোটি বাদ্যযন্ত্র ।

ধর্ম-বর্ণ জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে, ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও পৈতা ত্যাগ করেছিলেন। *অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ছিলেন অকুতোভয়*। নেতা-মন্ত্রী থেকে ব্যবসায়ী- প্রয়োজনে কাউকেই ছাড়তেন না সমালোচনায়। মানুষ জুবিনকে ভালোবেসেছে শুধু তাঁর কণ্ঠের জাদুময়তার জন্যে নয়, তাঁর জীবনের প্রতিটি সুরে। জীবদ্দশায় তিনি বলেছিলেন, মৃত্যুর পর আসাম সাত দিন কাঁদবে। কিন্তু তাঁর প্রয়াণে দেখা গেল-আসাম নয় কাঁদছে গোটা দেশ, এবং এই কান্না ইতিহাসে লেখা থাকবে।

সত্যিকারের শিল্পী মানেই স্বাধীন, অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, সৎ, সাহসী ও ন্যায়পরায়ণ। তাই এতো মানুষ একসঙ্গে কাঁদছেন। সোমবার সকালে তাঁর  শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। বছর দুয়েক আগে জুবিন বলেছিলেন যে, তিনি মরলে গোটা অসম জুড়ে বাজবে ‘মায়াবিনী রাতির বুকুত’ গানটি। সেই ইচ্ছেপূরণ হল। বেশ কয়েকবার তিনি ত্রিপুরায় এসেছেন। আমরা ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় কেন্দ্রের পক্ষ থেকে এই মহান শিল্পীর স্মৃতির প্রতি গভীর শোক জ্ঞাপন করছি।  Pic Courtesy: The Economic Times

Leave a Reply

Your email address will not be published.