শারদোৎসব
মহালয়ার ভোরে রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্র পাঠই জানান দিয়েছে দেবীর আগমন বার্তা। এক বছরের অপেক্ষা শেষ। ঘরে ফিরছেন উমা। প্রতিবারের মতো এবারেও ঘোটক, গজ, দোলা বা নৌকার মধ্যে একটিতে চেপে আসবেন তিনি। প্রত্যাগমনও হবে এগুলিরই মধ্যে কোনও একটিতে। কিন্তু অন্যান্য সব দেবদেবীর মতো মা দুর্গারও বাহন রয়েছে। যেমন তেমন নয়, একেবারে পশুরাজ সিংহ। কিন্তু এহেন বাহন থাকা সত্ত্বেও কেন ঘোটক-গজ-দোলা-নৌকার প্রয়োজনীয়তা? বিষয়টি নিয়ে কথা হল মিন্টো পার্কের রামকৃষ্ণ সারদা মণ্ডপের প্রধান পূজারী রবিশঙ্কর ঘোষালের সঙ্গে। তিনি জানান, সত্যযুগে মর্ত্যে যান হিসেবে ব্যবহার করা হতো ঘোড়া, গজ, নৌকা, পালকি ইত্যাদি। ফলে ওই সময় অনুযায়ী ধরাধামে দেবীর আগমন এবং প্রত্যাগমনের জন্য মূলত এই চারটি যানকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই যানগুলিতে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে শুভ এবং অশুভ কিছু প্রভাব। যেমন ‘নৌকা’র ফল আনন্দ-সর্বসুখ-শস্য এবং জলবৃদ্ধি, ‘ঘোটক’-এর ফল ছত্রভঙ্গ-রোগজ্বালা-ব্যাধি-অরাজকতা, ‘গজ’-এর ফল শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা এবং দোলার ফল মড়ক-মহামারি-ব্যাধি। প্রতিবারই দেবী দুর্গার আগমন-প্রত্যাগমনের এই যানগুলি তিথি, নক্ষত্র এবং দিনের বিচারে নির্বাচিত হয়। পুরাণ ও শাস্ত্র অনুযায়ী রবি এবং সোমবার দেবীর আগমন বা প্রত্যাগমনের যান হিসেবে ব্যবহৃত হয় গজ। বুধে ব্যবহৃত হয় নৌকা। বৃহস্পতি এবং শুক্রবার যান হিসেবে ব্যবহৃত হয় দোলা। শনি এবং মঙ্গলবার ব্যবহৃত হয় ঘোড়া।
আগমনের এই দিনটি ধরা হয় মহাষষ্ঠী থেকেই। তবে ভৌমদোষ বা তিথি নক্ষত্রের ফেরে যানের পরিবর্তন হতে পারে। সেই হিসেবেই এবার দেবীর আগমন ঘোটকে এবং প্রত্যাগমন দোলায়। কিন্তু সিংহের পিঠে চেপে আসতে বাধাটা কোথায়? রবিবাবু জানান, দুষ্ট অসুরকে দমন করতে মা দুর্গাকে সাহায্য করেছিলেন সিংহরূপী বিষ্ণু। তাই বাহন হলেও তাঁর পিঠে চেপে মর্ত্যে আসেন না দেবী। আর বিষ্ণুদেব হওয়ার জন্যই মণ্ডপে দেবী প্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠার আগে মহাষষ্ঠীর রাতে, অধিবাসের সময় দুর্গার বাহন সিংহকে পৈতে পরানোর রীতি রয়েছে। প্রথমে ধ্যানমন্ত্রের মাধ্যমে ফল-মিষ্টি দিয়ে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এরপর আরতি শেষে সিংহকে পরানো হয় পৈতে। এই উপাচারের পরই সপ্তমীতে হয় নবপত্রিকার স্নান। নবপত্রিকায় কলা ওরফে ব্রহ্মাণীকে, কচু ওরফে কালিকাকে, হরিদ্রা ওরফে উমাকে, জয়ন্তী ওরফে কার্তিকীকে, বিল্বশাখা ওরফে দেবী শিবাকে, ডালিম ওরফে রক্তদন্তিকাকে, মানকচু ওরফে চামুণ্ডাকে, ধান গাছ ওরফে মহালক্ষ্মীকে এবং অশোক ওরফে শোকরহিতাকে পুজো করা হয়। এরপর শঙ্খজল, উষ্ণজল, শ্বেতচন্দন মিশ্রিত জল, গঙ্গা জল, মধু মিশ্রিত জল, কুশোদক, পুষ্প মিশ্রিত জল, রুপোর জল, সোনার জল, সামান্য অর্ঘ্য, ডাবের জল, মধু ও ঘি মিশ্রিত জল, নারকেলের জল, আখের রস, দই, তিলের তেল, শিশিরোদক, রাজদ্বারের মাটি, চতুষ্পদের মাটি, বৃষ শিংয়ের মাটি, গজদন্তের মাটি, বেশ্যাদ্বার মাটি, নদীর উভয়কূলের মাটি, গঙ্গামাটি, সর্বতীর্থের মাটি, সাগরের জল এবং মহৌষধি দিয়ে নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয়।
এখানেই শেষ নয়। এরপর সোনা, রুপো বা মাটির তৈরি মোট আটটি ঘটে নবপত্রিকারূপী দুর্গাকে ফের স্নান করানো হয়। রীতি অনুযায়ী স্নানের সময় এক একটি ঘটের জন্য বাজানো হয় ঢাকের পৃথক পৃথক বোল। যেমন—গঙ্গাজল ভর্তি প্রথম ঘটের জন্য মালবরাগ বিজয়বাদ্যম, বৃষ্টির জল ভর্তি দ্বিতীয় ঘটের জন্য ললিতরাগ, সরস্বতী জল ভর্তি তৃতীয় ঘটের জন্য বিভাস রাগ, সাগরোদক ভর্তি চতুর্থ ঘটের জন্য ভৈরব রাগ, পদ্মরেণু মিশ্রিত জলভর্তি পঞ্চম ঘটের জন্য ইন্দ্রাভিষেক বাদ্যম, নির্ঝরোদক ভর্তি ষষ্ঠ ঘটের জন্য বরারি রাগ, স্বর্ণতীর্থদক ভর্তি সপ্তম ঘটের জন্য বসন্তরাগ পঞ্চমবাদ্যম এবং শুদ্ধ জল ভর্তি অষ্টম ঘটের জন্য ধানসী রাগ। এরপর দেবী দুর্গার চক্ষুদান এবং প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি একাধিক উপাচারের মাধ্যমে মণ্ডপে থাকা অন্যান্য দেবদেবী এবং তাঁদের বাহনদেরও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বাগবাজার সর্বজনীনের পুরোহিত তুলসীদাস মুখোপাধ্যায় জানান, ধরাধামে মায়ের আগমনে ব্যবহৃত প্রতিটি যানের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে কিছু শুভ ও অশুভ সঙ্কেত। যেমন গজে আগমন ও গমন দুটি ক্ষেত্রেই শুভ। সেটিতে ধরিত্রী সুজলা সুফলা হয়ে ওঠার ইঙ্গিত রয়েছে। নৌকো করে আগমনের অর্থ দেবী প্রচুর শস্য নিয়ে মর্ত্যে আসছেন। দুর্গাপুজো যেহেতু সামাজিক উৎসব, তাই দেবী দুর্গার যান হিসেবে হাতি, ঘোড়া, নৌকো বা পালকিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। যার উদ্দেশ্য, মর্ত্যের তৎকালীন যানবাহনগুলিকে সমান গুরুত্ব বা সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া। তুলসীবাবু জানান, শাস্ত্রমতে পশুরাজ সর্বশক্তির অধিকারী হলেও তিনিও দেবী দুর্গার পদতলে বিরাজমান। দেবীর ডান পা থাকে সিংহের পিঠে এবং বাঁ পায়ের শুধুমাত্র বৃদ্ধাঙ্গুল থাকে মহিষরূপী অসুরের পিঠে। দেবীর এই দুই পা রাখার ভঙ্গিমার অর্থ এক নয়। বাহন সিংহের পিঠে পা রাখার অর্থ স্নেহ। অন্যদিকে দেবীর শক্তির কাছে তুচ্ছ অসুরকে আটকানোর জন্য মায়ের বাঁ পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলই যথেষ্ঠ। শাস্ত্র অনুযায়ী, সিংহের পিঠে দেবীর রণসাজ তাঁর ঐশ্বর্য বা তেজের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু মা দুর্গা যখন মর্ত্যে আসছেন তিনি তখন বাঙালির ঘরের মেয়ে উমা। দেবীর সঙ্গে রয়েছে তাঁর সন্তানরা। রয়েছে বাহনরাও। মা মেনকার কাছে দেবীর রূপ কন্যাস্বরূপা এবং জগতের কাছে তিনি মাতৃস্বরূপা। মর্ত্যে কিন্তু দেবীর এই রণসাজ ঐশ্বর্যের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং স্নেহময়ী বা মাধুর্যের রূপেই বিরাজমান তিনি। তাই দেবীর আগমন বা প্রত্যাগমনের যান ধরাধামের সাধারণ আর পাঁচটি যানের মতোই। তবে সৃষ্টির পাশাপাশি লয় না থাকলে বিশ্বের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। তাই গজের পিঠে আগমনে হয় শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা এবং দোলায় মড়ক। কিন্তু মর্ত্যে যুদ্ধের ব্যাপার স্যাপার নেই, তাহলে দেবীর হাতে ত্রিশূল কেন? কারণ হিসেবে তুলসীবাবু জানান, মর্ত্যে আগমনকালে দেবীর সঙ্গে থাকেন তাঁর সন্তানরা। লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ এবং সন্তানতুল্য সমস্ত মানবজাতিকে এই জগতের খল, কপট ব্যক্তিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই দেবীর এই রণসাজ।
– শৌণক সুর