বাদশার আলোচনায় মহীরূহ অভিজ্ঞতার চাতক তৃষ্ণা
সুকন্যা পাল, দুর্গাপুর
অগ্রাহয়ণের সন্ধ্যা মানেই অল্প অল্প শীত শীতে অনুভূতি। এমন আদুরে অনুভব সল্প সল্প করে ক্রমেই অবাধ প্রবেশ করতে চেয়েছিল বাদশার দুয়ার প্রান্তে। কিন্তু ততক্ষণে তো একটা পরিবর্ত আবহ হঠাৎই গ্রাস করে ফেলেছে বাদশার অন্দরমহলে। উষ্ণতার পরিমন্ডলে। মনোজ্ঞ আলোচনার বাক্যকর্ষণের স্বরলিপিতে। আলস্য রবিবারের ঝড়ো ঝড়ো মুগ্ধতায় অতিথির টুকরো টুকরো বক্তব্যে।
পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুর শিল্পনগরীর প্রবীণ-বন্ধু শিল্প-আবাসের একান্ত ঠিকানা হল বর্ধমান ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি ফর হিউম্যান অ্যাকটিভিটিস। ওরফে ‘বাদশা’। কাগজে কলমে প্রবীণ-বন্ধু শিল্প-আবাস প্রতিষ্ঠিত হলেও বাদশা আসলে বয়সকে তুড়ি মারার নস্টালজিক উদ্যোগী প্রতিষ্ঠান। এই মানবিক কারখানায় প্রবীণ মন্ত্রপূত হয় নবীনত্বের তন্ত্রে। আবাসিকেরা তাই অন্তঃকরণে বিশ্বাস করতে করতে কখন যেন নিজস্বতাতেই শিখে ফেলেছেন, ‘আমরা নতুন যৌবনের দূত। আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত।’
আর এই চঞ্চলতা অথচ এই অদ্ভুত প্রতিবিম্বেই তো লাল নীল ও সবুজ জীবন প্রতীকে বর্ণময় হয়ে ওঠে নানান সাংস্কৃতিক আয়োজন। প্রবীণা ঝর্ণা মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে রবি সাঁঝের উদ্বোধনী সঙ্গীতে তাই বাদশা প্রেক্ষাগৃহ মুখর হয়ে ওঠে, হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে…সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে। এরপরেই শুরু হয় প্রতিষ্ঠানের অর্ধ বার্ষিক সাধারণ কর্মকান্ডের নানান পর্যালোচনা। দেবদাস কর্মকার, গৌতম ভাদুড়ি ও প্রশান্ত মন্ডল এই পর্যালোচনায় অংশ নেন। বাদশা শুধু প্রবীণত্বের আলোকে উদ্ভাসিত হয় তা নয়, এখানে দুস্থ স্কুল পড়ুয়াদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া বিনামূল্যে এবং নিঃস্বার্থে। এদিনের অনুষ্ঠানে সেই উজ্জ্বল কচিকাঁচা পড়ুয়াদের হাতেই তুলে দেওয়া হলো প্রশংসামুগ্ধ শংসাপত্র। সবুজাভ দীক্ষার শিক্ষা দৃষ্টান্তে।
আজকের সমাজ ব্যবস্থায় উত্তর মেরু যদি হয় নবীণ প্রজন্ম তো দক্ষিণ মেরুর দাবিদার অবশ্যই প্রবীণকুল। এই দ্বিজ মেরুর সেতুবন্ধনের পরম প্রয়াসে আজকের উল্লেখযোগ্য নিবেদন ‘ওল্ডার পার্সন্স ইন অ্যান ইন্টার-জেনারেশনাল সোসাইটি’ শীর্ষক আলোচনা। দুর্গাপুরে দুই প্রবীণ শিক্ষক চন্ডিচরণ ঘোষ ও সুদেব রায়ের মন্তব্যে বারেবারে ফুটে উঠেছে প্রবীণ অভিজ্ঞতার ও নবীণ উদ্যমের হরগৌরী মিলন মুর্ছনা। আলোচনার তাল যতই উচ্চগ্রামে পৌঁছেছে ততই যেন শীতের ঠান্ডা হয়ে উঠেছে ফিনিক্স পাখি। বাদশার ডায়াসে তখন যুগবন্ধনের উষ্ণ ফুলঝুরির রমরমা। এসবের মধ্যেই শিল্পনগরীর আপন মানুষ তথা সমাজসেবী রমাপ্রসাদ হালদারের উপস্থিতি ও পাশে থাকার বার্তা যেন অনুষ্ঠানকে ‘ঝলক দিখলা যা’এ রূপান্তরিত করেছে। বছর আশির চন্ডিচরণ ঘোষ কিন্তু ততক্ষণে প্রমাণ করে বসলেন, ‘হায় কিসিসে কম নেহি।’ কি অপার দক্ষতাতেই না এই বয়সে পাঠ করলেন স্বরচিত কবিতা জড়াকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে।
তাই হয়তো অনুষ্ঠানের কিছুটা হলেও আলোক চুষে নিতে আবৃত্তিতে পরমা মন্ডলও উপস্থাপন করেছিলেন, মোর সারা জীবনের অন্তরের অনির্বাণ বাণী, জ্বালায়ে রাখিয়া গেনু আরতির সন্ধ্যাদীপ-মুখে।
আমেরিকা নিবাসী তথা বাদশার অন্যতম প্রাণ ভোমরা সুকুমার রায় সুদূর মার্কিন মুলুক থেকেই জানালেন, ‘আরতির সন্ধ্যাদীপ-মুখে এরকম বহু সাতরঙা অনুষ্ঠানের আয়োজন হরদম আমরা সবাই মিলে করে থাকি। আসলে বাদশা লোকমুখে বৃদ্ধাশ্রম হলেও আক্ষরিক অর্থে আমাদের মননে এটি একটি জীবন-মানস সরোবর। যার অসীম পরশে আমরা লালিত হয়ে চলেছি মহীরূহ অভিজ্ঞতায়। আগামীর সরণিতে বাঁচার মাইলস্টোনের চাতক তৃষ্ণায়।