ভারতে টেসলা এলো, পিছুপিছু এলো দীর্ঘশ্বাসও
ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
চাষ হবে না গাড়ি কারখানা হবে এই নিয়ে যখন বছরের পর বছর তরজা চালাচ্ছি আমরা, ভারত নেক্সট জেনারেশন গাড়ি নির্মাণের দিকে এগিয়ে গেল। জগৎ বিখ্যাত টেসলা কোম্পানি বেঙ্গালুরুতে অফিস খুললো৷ ধাপে ধাপে কারখানা হবে, শিল্প হবে, ই-গাড়ির হাব হবে! আমাদের অবশ্য কারখানার জমিতে সর্ষে চাষেই আনন্দ। আমাদের আনন্দ টাটাকে রাজ্য থেকে ঘাড় ধাক্কা দিতে কিন্তু সেই টাটারই আশ্চর্য সব কীর্তি ফেসবুকে শেয়ার করতে! ভারতে নেক্সট জেনারেশন গাড়ি নির্মাণ বিরাট খবর কেন? কারণ টেসলার গাড়িগুলি carbon free, electric vehicle। কিন্তু আধুনিকতায় অনেকের থেকে এগিয়ে। চালক ঘুমিয়ে পড়লেও চলবে টেসলা-র গাড়ি! নিজে থেকে পার্ক করে নেবে, নিজে নিকটবর্তী হাসপাতালে জানিয়ে দেবে দুর্ঘটনা ঘটলে। গোটা পৃথিবী এখন এই দূষণবিহীন গাড়ি প্রস্তুতিতে মন দিচ্ছে। অনেক দেশ তো টাকাও দিচ্ছে এমন গাড়ির কারখানা বানাতে। ভারতে মহীন্দ্রা শুরু করেছে এই কাজ৷ এবার এলো টেসলা। বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার নামে নামাঙ্কিত কোম্পানি মহারাষ্ট্র, গুজরাট, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক এবং তামিলনাড়ু সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে। না, যে রাজ্যের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস পড়লো সেই রাজ্যের নাম নেই।
ইয়ন মাস্ক! পৃথিবীর দ্বিতীয় ধনী ব্যবসায়ী। নাসা ছাড়া বেসরকারিভাবে যারা মহাকাশ ভ্রমণের ব্যবস্থা, রকেট নির্মাণ করে সেই SpaceX, গাড়ির কোম্পানি টেসলা, ই-ওয়ালেট PayPal এর প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিশ্রুতি মতো ভারতে এলেন। কিন্তু এলেই তো হবে না। কোন রাজ্যে আসছেন সেটার জন্য মারকাটারি প্রতিযোগিতা লেগেছিল। শিঁকে ছিড়লো কর্ণাটকের। কেন? কারণ টেসলা মনে করছে আধুনিক প্রযুক্তি শিল্পের আদর্শ জায়গা কর্ণাটক। বন্দর আছে, বিরাট রাস্তা আছে, বিদ্যুৎ, পরিকাঠামো, জমি, সরকারের সাহায্য, সস্তায় অভিজ্ঞ লেবার আর এসি ঘরে দক্ষ হোয়াইট কলার শ্রমিক আছে। এছাড়াও আছে SEZ এর সুবিধা, অন্যান্য গাড়ি কারখানাকে জায়গা করে দেওয়ার অভিজ্ঞতা। আচ্ছা এগুলো বাংলায় সম্ভব না বলুন?
Why why বেঙ্গালুরু? কেন বাংলার হাইওয়ের দুধারে যে একর একর জমি আছে সেখানে নয়? কলকাতার তো ভারতের সিলিকন ভ্যালি হওয়ার কথা ছিল। ছেলেমেয়েগুলোর স্নান করে, ভাত খেয়ে সল্ট লেক, সেক্টর ফাইভ, রাজারহাট, বানতলায় যাওয়ার কথা ছিল৷ কেন তাদের বেঙ্গালুরু যেতে হচ্ছে৷ এক সময়ের ‘পেনশনার’স প্যারাডাইস বদলে গেল বানিজ্য নগরে আর এককালের বানিজ্য নগর এখন বিশাল বৃদ্ধাশ্রম। দল-রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে ভাবুন কী হারালেন! যে ছেলেটি বম্বেতে কাজ করছে বা যে মেয়েটি গুড়্গাওতে আইটি কোম্পানির গ্রোথ অফিসার তারও বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে৷ তাঁদের রাজ্যে একটা সুযোগ দিলেই তারা ফিরে আসবে আদুরে ঘরকুনো হতে ফের৷ অ্যামাজন, আইবিএম, মাইক্রোসফট, টেসকো, নোকিয়া, অ্যাপল, ইনটেল, সিসকো, অ্যাডোবি, গুগলের মধ্যে থেকে একটা স্রেফ একটা কোন কোম্পানি হলদিয়া, ধানতলা, বানতলা, সিঙ্গুর, নানুর, নন্দীগ্রামে হলে তারা ধন্য ধন্য করবে! ভারতে টেসলা এলো, পিছুপিছু এলো দীর্ঘশ্বাসও। দীর্ঘশ্বাস বৃদ্ধির ওই বাস মিস করার। একটা গাড়ি কারখানা হওয়া মানে আশেপাশে আরো দশটা গাড়ির চাকার কোম্পানি, নাট বল্টু, সিট কভার এমনকি গাড়ির বীমার কোম্পানিও ব্রাঞ্চ খুলতো। বাইরে থেকে লোক আসতো, বিমানবন্দর করার দাবি উঠতো। এলাকায় ঘর ভাড়া নিতো মানুষ, হোটেল, দোকান, মল খুলতো। অন্য কোম্পানি আসার সাহস দেখাতো, প্রতিযোগিতা হতো, ব্যবসায়িক রেষারেষি হতো, গাড়ির হাব হতো কিন্তু আখেরে লাভবান হতো বাংলা। আমরা বৃদ্ধির ওই বাস মিস করেছি। পরের বাস কবে আসবে জানিনা। ততোদিন বৃদ্ধবয়সী হয়ে বসে থাকি কবে ছেলেমেয়ে নয়ডা, দিল্লি, পুনে থেকে বাড়ি আসবে বলে আর কমবয়সী হলে বসে থাকি কবে পুজোয় কয়েকটা দিন বাড়ি ফিরবো বলে। তাবড় বাঘা কোম্পানি আর শিল্পপতি এই বাংলা থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল। চলছে না চলবে না আর চলবে না! এবার নতুন প্রজন্মই চালাবে চাকা, ঘোরাবে খেলা। Picture courtesy : youtube