FEATUREDGeneralIndiaNewsPoliticsSambad Matamat

আধাঁরে আলো

সুধীর বরণ মাঝি

ভ্রমণ করতে আমার ভালো লাগে। ভ্রমণে আমার এক ধরনের শখও আছে। কিছু টাকা আর সময় পেলেই বেড়িয়ে যাই পরিচিত-অপরিচিত স্থানে। বেড়াতে গেলে নতুন নতুন জায়গা-পরিবেশ, নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন সবকিছু মিলিয়ে বেশ ভালোই লাগে। একবার আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বেশ কিছুদিন থাকা হয়েছিলো ওই আত্মীয়ের বাড়িতে। এলাকাটি বেশ সুন্দর এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ। একরকম মায়াবী রূপ আছে। এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলেও তৃপ্তির ঢেকুর তোলা যায়। এখানকার মানুষের চিন্তার মধ্যে অনেক ভিন্নতা আছে। দেখলাম এখানকার কিছু মানুষ গোড়া আবার কিছু মানুষ সংস্কারমুক্ত, কিছু আধাসংস্কারমুক্ত এবং কিছু মানুষ যুক্তি দিয়ে সত্যকে গ্রহণ করতে চায়।

একদিন ছোট্ট একটি চায়ের টং দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। পাশের বেঞ্চে আরও কয়েকজন বসে চা খাচ্ছেন এবং তারা সমাজ, পরিবার, ধর্মসহ নানা বিষয়ে কথা বলছেন। এমন দৃশ্য আমাদের দেশের প্রায় সব জায়গাতেই দেখা যায় এবং যা আমাদের দেশের একটি পরিচিত দৃশ্য।তাদের মধ্যে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ভাই আপনকে কেমন যেনো অপরিচিত মনে হয়, তাছাড়া আগে কখনো আমাদের এই গাঁয়ে দেখেছি বলে মনে হয় না। আমিও সৌজন্যতার সাথে বললাম, তা ঠিক বলেছেন। আমি আগে কখনো আপনাদের এখানে আসিনি, এই প্রথম। আমি সিপনদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। চা খেতে খেতে লোকটার সাথে পরিচিত হলাম। আমার নাম শরিফ, তবে এখানকার মানুষ আমাকে শরিফ বাচাল বলে। বেশ ভালো লাগলো পরিচিত হয়ে। কথাবার্তায় এক ধরনের মাধুর্য আছে। আমাদের মাঝে নানা বিষয়ে কথা চলতে থাকে। শরিফ বাচাল একসময় আমাকে বললো, আপনার সাথে কথা বলে বেশ ভালো লাগছে, তাছাড়া আপনাকে শিক্ষিত বলেই মনে হয়। লোকটা এবার থামিয়ে বললাম, আপনার কথাগুলো শুনে অনেক ভালো লাগছে। শিক্ষিত কি না নিজেই বুঝি না, তবে শিক্ষার কয়েকটি স্তরের সনদ অর্জন করেছি মাত্র। তাওতো ঠিক আছে। শরিফ বাচাল বললো, কিন্তু ভাই, এখানকার মানুষগুলো হলো শিক্ষিত মূর্খ। ভাই এটা আবার কেমন? শুনেন তবে বলি। আপনার সময় হবে তো। সমস্যা নেই বলেন। এখানকার বেশিরভাগ লোকই শিক্ষিত কিন্তু এরা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করে না আবার করতেও চায় না। যুক্তি দিয়ে কিছু বুঝতেও চায় না, সত্যকে মানতে চায় না, এখানকার শিক্ষিত মানুষদের ন্যায়-অন্যায় বোধও কম। চেয়ারম্যান বা মোড়ল বা হুজুর যেই কথা বলে তার কোনো বিচার-বিশ্লেষণ না করেই পিছনে ছুটে। সত্য কি মিথ্যা, ন্যায় কি অন্যায় ভালো কি মন্দ না বুঝেই সায় দিয়ে যায় তাদের কথায়, তাদের কাজে। এরা শত্রু-মিত্র চিনার ক্ষমতা রাখে না। অনেকটা এই প্রবাদের মতো ‘দাদায় কইছে বানতে ধান, বাইন্দা আনছি ওধা ধান। আমি যখন ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্য খুঁজে বেড়াই, বোঝানোর চেষ্টা করি অধিকাংশ তখন আমাকে এড়িয়ে চলে যায়। আমি নাকি বেশি বুঝি এই বলে। একদিন আমি কিছু লোকের সাথে কথা বলতে গিয়ে বললাম, আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন, ‘আশরাফুল মাকলুকাত হিসেবে’। অর্থাৎ মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ কি এখানো কোনো ধর্মের মানুষকে নির্দিষ্ট করে বলেছেন, মুসলমানরা হলো সৃষ্টির সেরা জীব আর বাকি সব মানুষ হলো নিকৃষ্ট। আল্লাহ সমগ্র মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে ঘোষণা করেছেন কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষকে নয়। অথচ আমরা সেই পরিচয়কে ভুলে আমরা নিজেদেরকে কেউ মুসলিম, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খ্রিস্টান ইত্যাদি বলে নিজেদেরকে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি এবং নিজ নিজ ধর্মীয় লোকদের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্যে। কেউ নিজেকে মানুষ হওয়ার এবং অন্যকে মানুষ করার ভাবনাও ভাবি না। কিন্তু আমি মানুষ এই পরিচয় দেয়ার মানুষের সংখ্যা খুবই কম। তাই চারদিকে এতো সাম্প্রদায়িক হামলা, সম্প্রীতি নষ্টের মহা আয়োজন। ভাই বলেন, এইভাবে কী সভ্যতা এগিয়ে নেয়া সম্ভব? আবার দেখেন আমাদের দেশে অনেক মানুষ আছেন, যারা অবৈধভাবে উপার্জন করছেন, ঘুষ, দুর্নীতি, ঋণখেলাপী এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন আর লোকেমাধ্যমে বলাচ্ছেন, আল্লাহ দিচ্ছেন, ঈশ্বর দিচ্ছেন। তখন আর ভাই তাদের অবমাননা হয়? আমরা সবাই জানি মৃত্যুর পর একদিন সবাই বেহেস্তে যাবে এবং বেহেস্তে যাওয়ার জন্যে সবাই নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মীয় রীতিনীতি এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে ধর্ম পালন করে। কিন্তু দেখেন কেউ মরতে চাই না। সবাই বাঁচতে চাই। এমন কি লাইফসার্পোট নিয়ে হলেও বাঁচতে চাই। সবাই বেহেস্তে যেতে চাই কিন্তু কেউ মরতে চাই না। সবাই বাঁচতে চাই। আচ্ছা ভাই বলেন তো, না মরলে বেহেস্তে যাবে কেমন করে? ওরা এই পৃথিবীর স্বর্গসুখ বিশ্বাস করে না আবার এই পৃথিবীতেই বেঁচে থাকতে চায়। আরেক দল লোক আছে যারা ঘুষ খায়, চুরি করে, ব্যাংক লুট করে, দুর্নীতি করে. খাদ্যে ভেজাল দেয়, অবৈধভাবে জায়গা দখল করে, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অধিক সাধারণ মানুষের পকেট কেটে অধিক মুনাফা করে সম্পদের মালিক হয় এবং নিজে ও অন্যকে দিয়ে বলতে থাকে রিজিকের মালিক আল্লাহ, ঈশ্বর, গড ইত্যাদি। যদি তাই হয়, তবে সৃষ্টিকর্তা কি তোমার রিজিক ওইসবের মধ্যে লিখে রেখেছেন? ঘুষ খাবে তুমি, দুর্নীতি করবে তুমি, চুরি করবে তুমি, লুটপাট করবে তুমি, ব্যাংক লুট করবে তুমি, খাদ্যে ভেজাল দিবে তুমি, সিন্ডিকেট করবে তুমি আর মুখে বলবে রিজিকের মালিক সৃষ্টিকর্তা। এভাবেই সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে ধন-সম্পদের মালিক হচ্ছেন। আবার আরেক দল বিভিন্ন জায়গায় গরিব মানুষের কাছে গিয়ে বলেন, ইহকালে যার সম্পদ কম আখেরাতে তার হিসাব কম কথাটি খুবই যৌক্তিক, ন্যায়সঙ্গত এবং বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্যখানে। এই ওনারাই আবার ধনী ব্যক্তিদের কাছে গিয়ে তাদের জন্যে দোয়া করলেন, হে আমাদের পালনকর্তা, অমুক সাহেবের ধন-সম্পদ বাড়িয়ে দাও। আখেরাতে হিসাবকে সহজ করে দাও। তাহলে এই যে দুমোখী আচরণ। ভাই বলেন তো এর দায় নিবে কে? আমি তার কথাগুলো শুনছিলাম কখনো কখনো তার সাথে সায় দিয়ে যাচ্ছিলাম। আবার কখনো কখনো তার সাথে তর্কে জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। ভাই আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। যুবকরা তার যৌবনের চরিত্র হারিয়ে ফেলছে দিনের পর দিন। তারা ভোগবাদী চিন্তা-চেতনায় মত্ত হয়ে উঠছে। অন্যদিকে আমাদের অভিভাবকরা আজ সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ার চিন্তায় মত্ত। ভবিষ্যৎ গড়তে তারা প্রতিনিয়ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, মিথ্যার আশ্রায় নিচ্ছে, দুর্নীতির সুযোগ নিচ্ছে, অনিয়ম করছে, হানাহানি-খুনাখুনিতে জড়িয়ে পরছে। যেই সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্যে এতো কিছুর আশ্রয় আর সেই সন্তানের চরিত্র গঠনের দিকে এতোটুকু নজর নেই। সন্তানের চরিত্র গঠনের দিকে নজর দিতে পারলে নিজেরাও উন্নত চরিত্র ধারণ করতে পারতো। অহেতুক আমাদের মধ্যে বিদ্যমান ঝামেলা এড়িয়ে একটি উন্নত সভ্যতা গঠন করতে পারতাম। আমরা জানি, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। কিন্তু আমরা যেনো সেই দেশপ্রেমকে আজ ভুলেই গেছি। আমি দেশপ্রেম বলতে যা বুঝি তার সাথে আপনার দ্বিমত থাকতে পারে। তবুও আমার কথা এখানে একটু বলতে চাই। দেশপ্রেম হলো দেশকে ভালোবাসা, দেশের মানুষকে ভালোবাসা, দেশের ইতিহাস, সভ্যতা, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং দেশের ঐতিহ্যকে ভালোবাসা, তা সংরক্ষণে নিজের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। আপনার অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি। আরেকটু সময় নষ্ট করবো। ধর্ম কী, ধর্মীয় বিধিনিষেধগুলোইবা কী আমরা অনেকেই জানি না, আবার অনেকই মানি না। আজকে আমারা ধর্মকে মানছি নিজের মতো করে। নিজের স্বার্থরক্ষার জন্যে যতোটুকু প্রয়োজন ঠিক ততোটুকু। ধর্ম সম্পর্কে গ্রন্থ পড়তেও চাই না। শুধু আরেকজনের মুখে মুখে শুনে শিখতে চাই। অথচ ধর্মগ্রন্থগুলো অনেক সহজ করে লেখা সেখানে আমরা পড়েও দেখি না। আমাদের জ্ঞানের অজ্ঞতার কারণে একদল মানুষ এর সুযোগ নিচ্ছে আর আমরা অন্ধের মতো তাদেরকে বিশ্বাস করছি চিলে কান নেয়া গল্পের মতো পিছনে দৌড়াচ্ছি। পৃথিবীতে প্রথম সৃষ্টি আদম আর হাওয়া। তারা একটি বংশ বা গোত্র এবং ইসলাম ধর্মের কিন্তু তাদের কাছ থেকে এতোগুলো বংশ, এতোগুলো ধর্ম কীভাবে সম্ভব বিষয়টা আমার মাথায় ঢুকে না? আমাদের দেশে যে হারে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় উপাসনালয় বাড়ছে তাতে মনে হয় আগামীদিনে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এখনি এগুলোর দিকে নজর দেয়া জরুরি। একদিকে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার মানের অবনতি, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বৃদ্ধি, বিজ্ঞান শিক্ষার অনগ্রসরতা, ইতিহাস, কলা, কীর্তি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মানবতা ভুলে সবাই বিভোর ধর্মকে বাঁচাতে। এই মানুষগুলো বোঝে না মানুষের জন্যে ধর্ম, ধর্মের জন মানুষ নয়। মানুষ নিরাপদ না থাকলে ধর্মও নিরাপদ নয়। ধর্মকে রক্ষা করতে হলে সম্প্রীতি, মানবতা, মূল্যবোধের বিকাশ করতে হবে।

আমরা যখন কোনো মুমূর্ষু রোগীর জন্যে রক্ত খুঁজি, তখন আমরা বলি একজন মুমূর্ষু রোগীর জন্যে ও পজিটিভ, বি পজিটিভ, এ পজিটিভ ইত্যাদি আমরা কিন্তু তখন ভুল করেও একবারের জন্যেও বলি না মুসলমান মানুষের রক্ত চাই বা হিন্দু মানুষের রক্ত চাই বা খ্রিস্টান মানুষের রক্ত চাই বা বৌদ্ধ মানুষের রক্ত চাই বা অন্য কোনো ধর্মের মানুষের রক্ত চাই। শুধু বলি মুমূর্ষু রোগীর জন্যে রক্ত চাই। আবার যখন একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে তখন আমরা সবাই বলি একটি শিশুর জন্ম হলো। কেউ বলি না একটি মুসলিম শিশুর জন্ম হলো বা একটি হিন্দু শিশুর জন্ম হলে বা একটি খ্রিস্টান শিশুর জন্ম হলো বা একটি বৌদ্ধ শিশুর জন্ম হলো। আবার যখন কেউ মৃত্যুবরণ করে তখনও আমরা কেউ বলি না ওই ধর্মের একজন লোক মৃত্যুবরণ করেছে। তাহলে মাঝখানের এই সময়টুকুতে ধর্মকে নিয়ে এতো হানাহানি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, খুনাখুনি, মানবতার বিপর্যয়, মূল্যবোধের বিপর্যয়?

শ্রমিকদের ঘাম শুকানোর আগে তাদের পারিশ্রমিক বা মজুরি পরিশোধ করার কথা আমাদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থে উল্লেখ থাকলেও আমরা তা মানছি কতজন বা মানার চেষ্টাই বা করছি কতজন? আমাদের আলেমসমাজ বা ধর্মীয় নেতারা সেই বিষয়ে কতটুকু ভূমিকা পালন করছেন? যাদের যেখানে ভূমিকা রাখার কথা তারা সেখান থেকে অনেক দূর সরে এসেছেন নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্যে। ভাই এই হলো আমাদের অবস্থা। এসব কি ভালো লাগে বলেন? আমার ভালো লাগে সৌহর্দ্য, সম্প্রীতি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.