GeneralNewsPoliticsSambad MatamatWorld

ঝুমন দাসের অপরাধ কি ?

শিতাংশু গুহ, নিউইয়র্ক

ঝুমন দাস ‘আপন’-কে নিয়ে ‘ডয়েচে ভেল’ পহেলা সেপ্টম্বর ২০২২ একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, এতে প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘আসলে ঝুমন দাসের অপরাধ কি’? বাংলাদেশের হিন্দুরাও জানতে চায়, ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টে হিন্দুদের বারবার ‘ইসলাম অবমাননার’ দায়ে ফাঁসানো হচ্ছে, এর কারণ কি? কেন এই আইন হিন্দুদের ওপর ‘ব্লাসফেমী’ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে? জানি ‘ডয়েচে ভেল’ বা আমার প্রশ্নের কোন উত্তর কেউ দেবেন না, তাঁরা আওয়ামী লীগ শাসনামলে সম্প্রীতির জয়গান গাইবেন। অনেকদিন আগে খান আতা’র একটি ম্যুভি দেখেছিলাম, যাতে একটি ডায়লগ ছিলো, ‘তোমার মাথা মাথা, আর আমার মাথা তোমার লাঠি মারার জায়গা’? বাংলাদেশে ‘সম্প্রীতি’ এখন এমনই? 

ডেইলি ষ্টার জানিয়েছে, ১২ঘন্টা জেরার পর পুলিশ ৩১শে আগষ্ট ২০২২ ঝুমন দাসকে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টে ‘ইসলাম ধর্ম অবমাননার’ দায়ে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে। মামলাটি করেছেন শাল্লা পুলিশ ষ্টেশনের এসআই সুমনুর রহমান। একই সময়ে আর একটি খবরে দেখলাম, শাল্লা থানার ওসি আমিনুল ইসলাম একজন হিন্দুকে ঝুমনের বিরুদ্ধে মামলার বাদী বানাতে চেয়েছিলেন। তিনি হচ্ছেন, বাহরার ভেরাধর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জয় কুমার বৈষ্ণব, ভদ্রলোক রাজি হননি, তাই এসআই বাদী? প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে কি ঝুমন দাসকে ফাঁসানো হচ্ছে? ফেইসবুকে ‘ইসলাম বা নবী’ অবমাননার দায়ে ঘটে যাওয়া প্রতিটি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা কি হিন্দুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নয়?

এবার যে পোষ্টের জন্যে পুলিশ ঝুমন দাসকে গ্রেফতার করে তাতে লেখা ছিলো, “অসভ্যতা ও বর্বরতার এইটা একটা নজির। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুলে ১৪শতকের প্রাচীন নবরত্ন মন্দিরের গেটে মসজিদের এই দানবক্স দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কোন মসজিদের প্রধান গেটে কোন মন্দিরের দানবক্স লাগানোর কল্পনাও কেউ করতে পারবে না। করলে ধর্ম অবমাননার মামলা খেয়ে কারাগারে থাকতে হবে অনেকদিন। তাহলে এটা লাগানোর সাহস এঁরা কিভাবে করে। ঐ মন্দিরের আশেপাশের হিন্দুদের এটা অপসারণ করার বিন্দুমাত্র সাহস বা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করার ক্ষমতা নাই বলেও আশ্চর্য্য হয়েছি। মন্দিরের গেটে মসজিদের দানবক্স ও ইসলামী বয়ান লাগানো স্রেফ গুন্ডামী, সংখ্যাগুরুর ইত্রামী”।

পত্রিকায় এসেছে, ঝুমন এটি তাঁর পোষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই যে পোষ্টটি ঝুমনের তাহলেও, এতে ইসলামের অবমাননা হলো কোত্থেকে? শেষের লাইনটি বাদ দিলে এরমধ্যে কি আছে? গুন্ডামী ও ইত্রামী শব্দ দু’টো প্রয়োগ ঠিক হয়নি, কিন্তু এও মনে রাখতে হবে, এটি সামাজিক মাধ্যম, শব্দ দু’টি বাংলাদেশের বহুল ব্যবহৃত; ঝুমন অশিক্ষিত বা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মত ‘তেল মারা’ শব্দ ব্যবহারে পটু নয়? পোষ্টে আশেপাশের হিন্দুদের যে চিত্র উঠে এসেছে, এটাই বাস্তবতা। শুধু সিরাজগঞ্জ নয়, গোটা বাংলাদেশের হিন্দুরা এখন ‘ইসলাম অবমাননার’ ভয়ে আছে, ষড়যন্ত্রকারীরা কখন কার বিরুদ্ধে এ ভুয়া অভিযোগ তুলে নাস্তানাবুদ করবে সেই ভয়ে সবাই তটস্থ। 

প্রথম আলো ৩০শে আগষ্ট জানিয়েছে, মহামান্য আদালত দুই মাদক ব্যবসায়ীকে একবছের কারাদণ্ডের বদলে পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন, পাশাপাশি দুটি এতিমখানায় দুজন এতিমকে বাংলা অনুবাদসহ দুটি কোরআন শরিফ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঝুমন দাস বা ধর্ম অবমাননার অজুহাতে জেলে অসংখ্য হিন্দু ছেলেমেয়ে আটক আছে, যদি ধরেও নেয়া যায় যে তাঁরা অপরাধী আদালত তাঁদের প্রতিদিন পূজা করা ও গীতা পাঠের শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দিতে পারেন? ভারতের সুপ্রিমকোর্ট ‘শ্রেয়া সিংহল’ মামলার রায়ে আইটি এক্টের ৬৬এ ধারা বাতিল করে বলেছে, সামাজিক মাধ্যমে কোন পোষ্ট দেয়ার জন্যে কাউকে গ্রেফতার করা যাবেনা, মামলাও হবে না। এরপর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সামাজিক মাধ্যমে বক্তব্যের জন্যে আর কোন মামলা না করতে এবং অতীতে দায়ের করা সকল মামলা প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিয়েছে। 

বাংলাদেশে আদালত কি এমন একটি মহৎ কাজ করতে পারেন? পারলে সংখ্যালঘুরা ধর্ম অবমাননার অজুহাতে সন্ত্রাসের শিকার হতে বেঁচে যেতো। ২০১২-তে রামুর ঘটনা থেকে হিন্দু-নির্যাতনের নুতন অস্ত্র ‘ধর্ম-অবমাননা’ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ২০০৯ থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ধর্মানুভূতি বিস্তারের এই দায় কি আওয়ামী লীগ সরকার এড়াতে পারেন? ভোরের কাগজ ৩রা সেপ্টেম্বর ২০২২ ‘ঝুমন দাসরা বারবার বলি হচ্ছে’ সম্পাদকীয়তে ঝুমন দাসের গ্রেফতার ঘটনাকে অমানবিক হিসাবে বর্ণনা করেছে। তাঁর স্ত্রীর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, এটি ষড়যন্ত। পত্রিকাটি লিখেছে, ঝুমন দাশ মামুনুল হকের ঘটনায় জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বলেছিলেন, আমি কোনো ব্যক্তি বা ধর্মের বিরুদ্ধে কখনো লিখেছি, এটা কেউ দেখাতে পারবে না। আমি সব ধর্মকে সম্মান করি। আমি জেলে থাকার সময় আমার নামে ১৭টি ফেসবুক আইডি সচল ছিল। আমার নাম ব্যবহার করে কেউ এসব করেছে। নতুন পোস্টে সাম্প্রদায়িক উসকানির যে অভিযোগ আনা হয়েছে- সেটি আসলে কার আইডি?  

ঝুমন দাসকে নিয়ে লেখা শেষ করার পূর্বক্ষণে টুইটারে দেখলাম একটি ভিডিও, ছাত্রদের রোষে এক হিন্দু প্রধান শিক্ষক। আবার ধর্মীয় অনুভূতি!! এবার চাঁদপুরের শাহরাস্তি, ঘটনা ৫ই সেপ্টেম্বর ২০২২। বলশীদ হাজী ইয়াকুব আলী হয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক অখিল দেবনাথ নাকি প্রাত্যহিক শপথের আগে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে নিষেধ করেছেন। প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে চার্জ গঠিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্ররা কি এখন স্কুলে পড়তে যায়? পুরো দেশটাই কি সাম্প্রদায়িক হয়ে গেলো, স্কুলের ছাত্ররা পর্যন্ত? ‘ধর্মানুভূতির’ জ্বালায় তো মানুষ অস্থির হয়ে যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.