BusinessGeneralIndiaNewsPoliticsSambad Matamat

কর্পোরেটকা সাথ কর্পোরেটকা বিকাশ

দেবারুণ রায়

“সবকা সাথ, সবকা বিকাশ” মন্ত্র নিয়ে ভারতের মোদী জমানার বিজেপি সরকার নয় নয় করে ন’টা বাজেট পার করে দিল। এই মন্ত্র পড়েছিলেন এবং পড়ে চলেছেন প্রধানমন্ত্রীর পদস্থ “প্রধান সেবক।” তিনি বলেছিলেন, তিনি নামবালা নন নেহেরু গান্ধী ( নাম উহ্য রেখে ) দেরঁ মতো। তিনি কামবালা। কর্মেই তাঁর পরিচয় রেখে যেতে চান। আহা এই অপূর্ব বচন ভারতবাসীর কানে মধুর মতো লেগেছিল। তাই দুবার তাঁর সরকার আড়ে বহরে বেড়েছে জনতা জনার্দন অথবা জয় শ্রী রামের আশীর্বাদে। এবং এই দুবার ভোট দিয়েই ভারতবাসী হাঁফ ছাড়তে রাজী কিনা তা নিয়ে ভারতভাগ্যবিধাতা সংশয়াচ্ছন্ন। লোকে বলছে, মানে আম লোকে, তিন হাজার কিলোমিটার টি শার্ট পড়ে হেঁটে নিজের শীতঘুম কাটিয়ে হয়ত পাপ্পু থেকে রাহুলের শাপমোচন হল।কিন্তু এখনও কংগ্রেসের শীত ও তারপর দেশবাসীর শীতঘুম কাটবে কী ? এই মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেনের কুহেলি কাটাতে এগিয়ে এসেছেন মোদীমন্ত্রের মোক্ষদা অর্থমন্ত্রী নির্মলা। তিনি কতটা নির্মূল করতে পারলেন, চব্বিশের ভোটে চক্রবর্তী হয়ে কংগ্রেস ও নেহরুর সরকারের রেকর্ড ছোঁয়ার মত জয়ের সম্ভাবনা সেটাই বিবেচ্য। কারণ রাজনীতির রাজকীয় তুবড়ি ফাঁকা না সত্যি সত্যিই আলোর ফুলকি, জুমলা না জিন্দাবাদ তা প্রমাণ করে অর্থনীতি। সুতরাং দেখা যাক, ” সবকা সাথ, সবকা বিকাশ” কি বাজেটবৃক্ষের ফুলফল হয়ে ফুটল , না কি এপ্রিল মাসে আয়করের কড়ি গুণে চাকরিজীবী ছাঁপোষা ভোটার আবারও দেখবেন ওই ফুলটা আসলে এপ্রিল ফুল ? যেটা শুধু ফি বছর এপ্রিলের ১ তারিখেই ফোটে। এবারও কি মধ্যবিত্ত রোজগেরেকে মাথা চুলকে ভাবতে হবে, হায় ফাগুন দিন, কোথা গেল সে আমার কামনার সাধনার দিন …? বিরাট সে আশঙ্কা দরজার কড়া কিন্তু নাড়ছে। আপনি শুনতে পাচ্ছেন কি পাচ্ছেন না, সে আপনার পকেট জানে। আয়কর, ব্যয়কর, বাড়িকর, গাড়িকর, বিষয়কর, এসব বিস্ময়কর ভাবে কপালে নয়, স্বাভাবিক ভাবেই পকেটে লেখা থাকে। এবং চোখে দেখছেন না কিছু কিছু কর, কিন্তু তারা আছে বিলক্ষণ, যেমন গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স, সংক্ষেপে জিএসটি, যা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে রুখে দিয়েছিলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্রভাই মোদী। যা মধ্যরাতে সংসদ ডেকে দেশজুড়ে হৈচৈ ফেলে ঘোষণা করল প্রধানমন্ত্রী মোদীর সরকার। যেসব রাজ্য বা দলগুলো অতীতের মোদীলাইনে হেঁটে জিএসটির পরওয়ানাটুকু শুধু শুধরে নিতে বলল, তাদের নামে ঢি ঢি পড়ে গেল। রব তুলল বিজেপি।

অমল তাস খেলেছেন নির্মলা সীতারামন। যেটা খুসি বেছে নাও আয়করে। পুরোনো রেটে না নতুন হারে। এবং আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় বুঝতে হবে ছাড়ের গল্পে সাসপেন্স কোথায়। নতুন হারে আম পাবলিককে যদি সত্যিই ছাড় দিয়ে থাকেন তাহলে তো জনগণের আর্থিক অভিভাবক নির্মলার ইচ্ছায়, তাঁদের কল্যাণ হবে এবার। কিন্তু তিনি নিজেই সংশয়ে আছেন। তাই গেয়ে রাখলেন আগাম : তোমাদের সামনে দুরকমের পথ খোলা রাখছি, যে রাস্তায় খুশি পা বাড়াও। নিজ দায়িত্বে। পরে বাপু আমাকে দুষো না। আমার দোষ নেই। এরকম আগে হয়নি তা নয়। তবে গাছের ফল পেড়েও খাব,কুড়িয়েও খাব এরকম করে কেউ ভাবেননি। সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। এবার ভাল মন্দ দুটোর দায় আমারই। এটাই অর্থমন্ত্রীদের বলতে শোনা গেছে এতকাল। আয়করে মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীকে বড় ছাড় দেওয়ার স্বপ্ন চিরকালের বিজেপি ঘরানার প্রডাক্ট। কংগ্রেসের প্রণব থেকে মনমোহন, চিদম্বরমদের চিরকাল এই গল্পেই ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন বিজেপির নেতারা।

কিন্তু ঘোল খাওয়া আর খাওয়ানোর ঘরানাটি গোল। যে যখন সরকারে, সে তখন ভজোকটো দশায়। আবার যারা ভোটে হেরে ঘোল খেয়েছে তারা বিরোধী দলে বসে পাল্টা দেওয়ার জন্যে ওঁৎ পেতে আছে। ফাঁক পেলেই ঘোল খাইয়ে ঘোলের জবাব দেবে। আর, সরকারে বসলেই ভুলচুক হতে বাধ্য। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ভুল করে বসলেই বিরোধীরা সংসদ অচল করে দিতে পিছপা হবে না। স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া হল বাজেটে। জিডিপির ২ শতাংশও পেরলো না স্বাস্থ্যে বরাদ্দ। ফলে স্বাস্থ্যকর বাজেট বলা যাচ্ছে না। ২০১৭-র স্বাস্থ্যনীতিতে গলা কাঁপিয়ে বলেছিলেন সেকালের প্রথম মোদী সরকারের স্বাস্থ্যরক্ষার দপ্তর। বলা হয়েছিল, এক হাজার মানুষের চিকিৎসার জন্যে থাকবেন একজন ডাক্তার। কিন্তু আজও কি তা বাস্তবায়নের অবস্থায় ? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ‘হু’র সুপারিশ, এক হাজার মানুষপিছু তিনটে করে হাসপাতাল বেড থাকতে হবে। স্বাস্থ্যের সরকারি অবস্থান অনুযায়ী ২ টি হাসপাতাল-বেড থাকলে ভাল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ভোঁ ভাঁ। একটা বেডের বরাদ্দও জোটে না বাজেটে। তাহলে সবকা সাথ কীভাবে বলব বুঝতে পারি না। ডাক্তারের চরম আকাল, নার্স বা স্বাস্থ্য কর্মীদের তীব্র অভাব গ্রাম থেকে শহরের সর্বত্র। সুতরাং স্বাস্থ্যনীতির ঘোষণার পাঁচ বছরেও স্বাস্থ্যকর হল না ভারতের স্বাস্থ্য। অথচ দেশের সব শহর, আধা শহর, নগর, আধা গ্রামীণ অঞ্চলে বেসরকারি সুপার ফেসিলিটি হসপিটালের নামে ধনকুবেরের ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যের বিপুল বিস্তার অব্যাহত।

নির্মলার বাজেটে বাজে কথা একদম নেই। সেটাই স্বাভাবিক। মোদী নরেন্দ্র দামোদরের বাজেটে থাকার কথা ছিল বছর বছর ২ কোটি করে যুবার চাকরির ব্যবস্থা। দামোদরের হাঁড়িকুড়ি, চাল কুটতে হল দেরি। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা ! চোদ্দ সালে বিজেপির নতুন প্রধানমন্ত্রীর দিনবদলের পালায় যে কথা ছিল, তা তো সপনোঁ কা সওদাগরের স্ক্রিপ্ট। কল্পনার স্বর্গরাজ্যে কর্মসূচি তো কাল্পনিক হওয়ারই কথা। সুতরাং নির্মলার বাজেটে বেকারি আর কর্মসংস্থান শব্দগুলোই নেই ! বললেন চিদম্বরম, বাজেট পেশের পরপরই। কেউ এই জোরালো যুক্তি খণ্ডন করতে আসেন নি। মোদীর দলেও কি তাহলে মৌনবাদীদের মৌরসীপাট্টা হল ? মনমোহন সিং সরকারকে মৌনমোহন বলতেন মোদী তাঁর প্রথম প্রতিশ্রুতির সময়। অথচ কখনও মৌলবাদী তাণ্ডবে চোদ্দ থেকে সরকারের মৌনতায় বিস্মিত বিরোধী নেতারা মৌন না বলে মৌলমোহন বলতে চান চলতি সরকারের চালককে। মনমোহন সিংয়ের সরকার কিন্তু চালু করেছিলেন গ্রামীণ মানুষের কর্মসংস্থানের অভাবনীয় প্রকল্প ‘মনরেগা।’ এবার কিন্তু “গুজরাত অস্মিতা” থেকে “হর হর মোদীর” সার্থক স্লোগান রচয়িতারা জুৎসই ক্যাচলাইন খুঁজে খুঁজে হন্যে। কারণ গ্রামোন্নয়নের মূল সুর একশো দিনের কাজ বা ‘মনরেগা’ দিয়ে আর গ্রামের মানুষের মন রাখা যাবে না এই মোদ্দা কথাটা তাদের মনে হয়েছে। কারণ, একশো দিনের কাজের বরাদ্দ ব্যাপক হারে কমিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আর কমিয়েছেন আয়করের ঊর্ধতম স্তরের ধনকুবেরদের কর। সিনিয়র সিটিজেনদের খাতির করে ভোট টানতে শেখাল বিজেপি। সেই প্রবীণদেরই রেলে বা উড়ানে ছাড় কাটা হল কোভিডের কোপ দেখিয়ে। এবারও সেই ছাড়ের ছাঁটাই বহাল রাখা হল। যদিও ধনকুবেরদের দেওয়া কর্পোরেট কর আর আয়করে ছাড়ের অঙ্কে অটল মোদী। এক হাজার মানুষপিছু একজন ডাক্তারের অধরা ধর্ম কোন আঘাটায় ভিড়ল ? বিজেপির রামপুর উত্তর প্রদেশ আর মধ্যপ্রদেশ। রামপুরে রাম রাম পুড়ে পুড়ে রাম। এই বোল দুই প্রদেশেই রামবাবুদের কীর্তির কীর্তন। ১৯ হাজার মানুষের জন্য এখনও একজনের বেশি ডাক্তার নেই। বিজেপি মথিত বিহারে ৩৭ হাজার অসহায় মানুষ একজন ডাক্তারের ভরসায়। মন্দির নির্মাণ চলছে অযোধ্যায়, মসজিদও হবে। হোক না। যতগুলো হয় হোক। কিন্তু হাসপাতালের কী হবে ? ডাক্তার কীকরে পাবে অসুস্থ আতুর ? বাজেটে এসব নিয়ে কথা বলার অগ্রাধিকার কোথায় ? জি ২০ বৈঠক, বিশ্বগুরু হতেই হবে ভারতকে। তার কাছে এসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ। কোভিডে ৫০ লক্ষ মৃত। আর কুড়ি কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে। তাহলে সবকা বিকাশ আর সবকা বিশ্বাস ? বিকাশের বিকার নেই। নিরাকার। বিশ্বাসের, আস্থার সংকট বিজেপির তালুকে। চব্বিশের আশিটি আসনে উত্তরপ্রদেশের উত্তর কী হবে ? বাংলার উনিশে পাওয়া আঠারোর তরী তীরে ফিরবে তো ?

Leave a Reply

Your email address will not be published.