ধন্য শ্রমিকের দান
সীমা ঘোষ
কোভিড 19 এর সঙ্গে লড়াই করছে বিশ্ব। কম বেশি সব দেশের অর্থনীতিতেই তার প্রভাব পড়েছে। সমগ্র বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারাচ্ছেন অথবা কাজ থাকলেও বেতন ঠিক মত পাচ্ছেন না। এরই মাঝে ভারতে কয়েকটি রাজ্য শিল্পপতিদের সুবিধা দেওয়ার জন্য এবং অর্থনীতিতে গতি আনার নাম করে চালু করে দিল এক জঘন্য শ্রমিক বিরোধী অর্ডিনান্স। কোথাও সেই অর্ডিনান্স চালু থাকবে তিন বছর, কোথাও 1200 দিন। এই অর্ডিনান্স অনুযায়ী সমস্ত উদ্যোগে এবার থেকে শ্রমিকদের কাজের সময় বাড়িয়ে করা হল 12 ঘন্টা, যেখানে এতদিন ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্ট 1948 অনুসারে শ্রমিকদের কাজের সময় নির্ধারিত ছিল দিনে 8 বা 9 ঘন্টা এবং সপ্তাহে 48 ঘন্টা। ঐ আইনের সেকশন 51 অনুসারে কাজের সময় এক বা আধ ঘন্টা বেশি হতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে ওঁরা মিনিমাম ওযেজেস অ্যাক্ট 1948 অনুসারে ঐ অতিরিক্ত সময়ের জন্য অতিরিক্ত মজুরি পাবেন সাধারণ মজুরির দ্বিগুন হারে। কিন্তু এই নতুন অর্ডিনান্সে এই সমস্ত কোনো আইনের পরোয়া না করে শ্রমিকদের কাজের সময় বাড়িয়ে দিনে 12 ঘন্টা অর্থাৎ সপ্তাহে 72 ঘন্টা করা হচ্ছে যার জন্য শ্রমিক কোনও অতিরিক্ত মজুরি পাবেন না। এছাড়া মালিকপক্ষের সম্পূর্ন স্বাধীনতা থাকছে যে কোনোও সময় যে কোনও কাউকে কাজ থেকে বরখাস্ত করার, কোনও শ্রমিক সংগঠনের অস্তিত্ব থাকবে না অর্থাৎ শ্রমিকদের কানো সমস্যার কথা বলার জন্য কেউ থাকবে না এবং শোনার জন্যও কেউ থাকবে না কারন কোন সরকারী নজরদারি এখানে থাকবে না। মালিক পক্ষ সম্পূর্ন স্বাধীনতা পাবে তার শ্রমিকদের নিয়ে যা খুশি তাই করার। এমনকি পানীয় জল, ক্যান্টিনের সুবিধা, চিকিৎসা ইত্যাদি যা কিছু ন্যূনতম সুবিধা শ্রমিকেরা সুদীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে হাসিল করেছিলেন, সেগুলো ও মালিক পক্ষের ইচ্ছাধীন। শ্রমিকদের এই ন্যূনতম অধিকারটুকুও তারা আর দিতে বাধ্য নন। পক্ষান্তরে মালিক পক্ষ পাচ্ছেন অবাধে কাজ করার সুযোগ, শ্রমিকদের নিয়ে যা খুশি তাই করার অধিকার, অতি শীঘ্র এবং অনলাইনে লাইসেন্স, কিছু ক্ষেত্রে বিনা রেজিস্ট্রেশনে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অধিকার। মনে করা হচ্ছে এই অর্ডিনান্সের ফলে দেশে বিদেশী পুঁজির বিনিয়োগ বেড়ে যাবে, ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি। দেশের তিনটি রাজ্য – উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ এবং গুজরাত এই ভয়াবহ অর্ডিনান্স জারি করেছে, আশঙ্কা আরও কিছু রাজ্য এই একই পথ অনুসরণ করবে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে কাজের সময় 8 ঘন্টাই থাকবে। অন্যান্য রাজ্যগুলো এখনও তাদের অবস্থান জানায় নি কিন্তু কর্নাটক, আসাম প্রভৃতি রাজ্য নতুন অর্ডিনান্সের দিকেই ঝুঁকে আছে। পরিশ্রান্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন রাজ্য তথা কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতা দেখেছি। সরকারের চরম অদূরদর্শিতার শিকার হয়েছেন তাঁরা। তারপরেও যারা প্রানে বেঁচে থাকবেন, তাদের জন্য আরো ভয়াল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য দেশ শুধুই শ্রমিকদের বলিদান চাইছে। তাদের বেঁচে থাকার মানবিক অধিকারটুকুও হরন করার চেষ্টা চলছে। অর্ডিনান্সের মোড়কে তাদের সাধারণ শ্রমিক থেকে ক্রীতদাসে পরিনত করার চেষ্টা চলছে। দেশ এগিয়ে চলেছে কিন্তু আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি না তো? (pic courtesy Business Standard)