রবীন্দ্রনাথের মংপু : আগামী দিনে সম্ভাবনা
অরুণ কুমার:
মংপু হল পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিঙের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। এই মংপুকে দার্জিলিং জেলার একটি হিল স্টেশন বলা হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই জায়গাটিকে বিখ্যাত করে তুলেছেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি বেশ কয়েকবার মংপুতে অবস্থান ও পরিদর্শন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তরাধিকার ছাড়াও, মংপু এর সম্ভাবনা এবং আকর্ষণগুলির সাথে একটি প্রাকৃতিক পদে সমৃদ্ধ জায়গা হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। প্রায় 3700 ফুট উচ্চতায়, এখানকার আবহাওয়া সারা বছর ধরে হালকা এবং আরামদায়ক থাকে। কমলা উপত্যকা সিটং মতো পর্যটন গন্তব্যগুলি এখান থেকে আধা ঘন্টার ড্রাইভের মধ্যে মংপুকে স্থানীয় দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য একটি আদর্শ ঘাঁটি তৈরি করে।
জানা গিয়েছে রবীন্দ্রনাথ এই স্বল্পপরিচিত মংপু গ্রামে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে তাঁর অভিভাবক মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে থাকতেন। বাড়িটি বর্তমানে রবীন্দ্র ভবন নামে পরিচিত এবং এটি রাজ্য সরকার রক্ষণাবেক্ষণ করে সিঙ্কোনা প্লান্টেশন কর্তৃপক্ষ এর মূল দায়িত্বে রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে কোন অনুরাগী ভক্তের জন্য এটি অবশ্যই একটি দর্শনীয় স্থান। এখানে রবীন্দ্র ভবনে এলে ঠাকুরের বিভিন্ন কর্মকান্ড এখানে দেখতে পাওয়া যাবে।এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত মংপু নিসর্গ পাহাড়ি সৌন্দর্যে সত্যিই অনন্য। এই বিষয়টি কেবল মংপুর ‘রবীন্দ্র ভবন’ এ এলেই যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই মংপু ভারতের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরাংশে অবস্থিত দার্জিলিং জেলার ৩৭৫৯ ফুট উচুতে অবস্থিত একটি পাহাড় ঘেরা শহর এটি সড়ক পথে দার্জিলিং থেকে পূর্বে ৩৩ কিলোমিটার ও শিলিগুড়ি থেকে ৫২ কিলোমিটার উত্তরে এর অবস্থান৷ খুব সহজেই সড়কপথে এখানে পৌঁছে যাওয়া যায়।
জানা গিয়েছে,1938 সালে মংপুতে প্রথমবার যখন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তখন কাছাকাছি আরেকটি বাড়ি রয়েছে যেখানে তিনি ছিলেন। এটি মংপু বাজার থেকে প্রায় 3 কিমি দূরে ‘সুরেল’ নামে পরিচিত একটি এলাকায় একটি ব্রিটিশ বাংলো। এই বাংলোটি জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত কবিতা “ক্যামেলিয়া” এখানে অবস্থান কালে লিখেছিলেন। মংপুর পাহাড়ঘেরা রবীন্দ্র ভবন পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। দার্জিলিং থেকে ঘুম পাহাড় হয়ে তিস্তা বাজার, কিংবা বলা ভালো, কালিম্পং যাওয়ার পথে ‘সাড়ে ছ-মাইল’ গ্রাম থেকে ক্রমশ নিচের দিকে নামতে নামতে সতেরো কিলোমিটার দক্ষিণে হল মংপু। রবীন্দ্রনাথ যখন কলকাতা থেকে মংপু যেতেন, প্রথম দিকে ওই সতেরো কিলোমিটার রাস্তা পাকা ছিল না। সেই সময় তিনি এক পালকিতে সওয়ারি হয়ে সাড়ে ছ-মাইল থেকে মংপু যেতেন। সেই পালকিটা বর্তমানে রবীন্দ্র ভবনে রক্ষিত আছে। পরে অবশ্য রাস্তা পাকা হয়েছে এবং তখনকার সেই পালকি বাহকদের একজনের উত্তরসূরিই এখন রবীন্দ্র ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ করেন। তার নাম শিশির রাউত। সেই ব্যক্তিই আবার পর্যটকদের গাইডের কাজ করে দেন। বাংলা, নেপালি, হিন্দি এবং কিছুটা ইংরেজিতেও কথা বলতে পারেন। রবীন্দ্র ভবনে কবির মংপুবাসের সময়কার পাণ্ডুলিপি, চেয়ার, টেবিল এবং ছবি আঁকার সরঞ্জাম সযত্নে রক্ষিত আছে। রবীন্দ্র অনুরাগী অসংখ্য পর্যটক মংপু রবীন্দ্র ভবনে ভিড় জমান। এখানে রবীন্দ্র ভবনে দেখতে পাওয়া যাবে অনেক কিছুই। জানা যাবে অজানা তথ্য।এমনকি আপনি ঠাকুরের লেখা ও সঙ্গীতে বিশেষজ্ঞ না হলেও, আপনি এটি একটি সামগ্রীর মূল্য খুঁজে পাবেন। ছোট জাদুঘরে ঠাকুরের ছবি, লেখা এবং বেশ কিছু স্মৃতিকথা রয়েছে। তাই এই মংপু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কিত রবীন্দ্র সংগ্রহশালার জন্য উল্লেখ্য সেই সঙ্গে তিনি এখানে মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে থাকাকালীন তাঁর বিখ্যাত ‘জন্মদিন’ কবিতাটি রচনা করেছিলেন৷ এইভাবে স্মৃতির ধন্য হয়ে আছে হিমালয়ের কোলে অবস্থিত অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত মংপু জায়গাটি।
অপরদিকে এই মংপু তার সিনকোনা আবাদের জন্যও বিখ্যাত। একসময় এলাকাটি সিনকোনা বাগানের কেন্দ্রস্থল ছিল। ভেষজ গাছের অর্থনৈতিক গুরুত্ব কমে যাওয়ায়, সিঙ্কোনা বাগানগুলি এখন খুব ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না তবে প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়ানোর জন্য এখনও চমৎকার জায়গা। মংপু এবং এর আশেপাশের এলাকাও কমলার জন্য বিখ্যাত। শীতকালে আশেপাশের শিটং, শেল্ফু, রেশপ, লাবদা এলাকায় কমলা জন্মে। সিংকোনা থেকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইন তৈরি হয়। সিংকোনা প্রসেসিংয়ের কারখানা আছে মংপুতে। রবীন্দ্র ভবনের পাশেই শ্রমিক ভবন। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিপ্রেমের নিদর্শন মংপুতে পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র মংপুতেই সিংকোনা চাষ হয়। সিংকোনা থেকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইন তৈরি হয়। সিংকোনা প্রসেসিংয়ের কারখানা আছে মংপুতে। রবীন্দ্র ভবনের পাশেই শ্রমিক ভবন। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিপ্রেমের নিদর্শন মংপুতে পাওয়া যায়। ইতিহাসের পাতা কেটে যেটুকু জানা গিয়েছে তাহলো এই মংপুর সিঙ্কোনা চাষ ও ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত রসায়নবিদ চার্লস হেনরি উড-এর উৎকৃৃষ্ট পদ্ধতিতে কুইনিন নিঃসৃৃত করার আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত৷ এখানে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সরকারী অনুমোদনপ্রাপ্ত একটি এমিটিন তৈরীর কারখানা ও রয়েছে৷ এই কারখানাগুলি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিঙ্কোনা চাষ উন্নয়ন পরিষদের আওতাভুক্ত ও তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়৷ ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই কারখানাগুলি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির দার্জিলিং জেলা নির্দেশকদের দ্বারা পরিচালিত হত৷ সিঙ্কোনা চাষোন্নয়ন পর্ষদ ও অন্যান্য মহৌষধির চাষ এই অঞ্চলের ১০ লক্ষ একরের বেশি সরকারীভাবে নিয়ন্ত্রিত জমি রয়েছে।
মংপুর আশেপাশে এমন অনেক জায়গায় রয়েছে যা আপনাকে প্রাকৃতিকভাবে দৃষ্টিনন্দন করে তুলবে। সিটং, যোগীঘাট নালিদারায় অবস্থিত ডিচেন মনাস্ট্রি দেখতে পারেন। মঠটি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নির্মিত এবং আশেপাশের পর্বতগুলির একটি মনোরম দৃশ্য দেখায়। রিয়াং নদীর যোগিঘাটে পৌঁছানোর জন্য নালিদারা থেকে 6 কিমি ড্রাইভ করে পৌঁছে যাওয়া যাবে। এটি রিয়াং নদীর উপর একটি সেতু সহ একটি দর্শনীয় স্থান। নদীর ওপারে, আপনি শিটং গ্রামেও যেতে পারেন যা কমলা বাগানের জন্য বিখ্যাত। রিশপ গ্রাম মংপু থেকে প্রায় 5 কিমি দূরে। বন গ্রাম থেকে, আপনি কাঞ্চনজঙ্ঘা ম্যাসিফ সহ আশেপাশের পাহাড়গুলির দুর্দান্ত দৃশ্য পেতে পারেন। এখানে রাডোডেনড্রন পার্ক বিভিন্ন ধরনের ভেষজ গাছালি লাল হলুদ সাদা রডোডেনড্রন গাছ পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য লাগানো হয়েছে। খুব শীঘ্রই এই পার্ক দেশ-বিদেশের পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে জানা গিয়েছে আরো একটি উল্লেখ করার বিষয় হল, যারা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন অর্থাৎ দুঃসাহসিকদের জন্য, মংপু থেকে চাটকপুরে একটি ট্রেক করা যেতে পারে। যাইহোক, এলাকাটি পাহাড় ও জঙ্গলদের ভাল্লুকের আক্রমণের নিয়মিত ঘটনার পর থেকে সাবধানতা নিয়ে এই কয়েক ঘন্টার ট্রেক শুরু করা যেতে পারে।
বিভিন্ন দিক থেকে সমৃদ্ধ এই মংপুতে এখনো সেভাবে কোনো উপযুক্ত পর্যটক আবাসন গড়ে ওঠেনি। তবে আশেপাশে বেশ কয়েকটি হোমস্টে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি হতে আরম্ভ করেছে। এখানে জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত আমিষ নিরামিষ সবরকম খাদ্য সম্ভার পাওয়া যায়। এখানে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল রয়েছে সাহিত্য রচনা লেখালেখি গ্রামীণ পরিবেশে লোকসংস্কৃতি শিল্পীদের দ্বারা পরিবেশিত কর্মকাণ্ড সকলকে আকৃষ্ট করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এখানকার মানুষ আগত পর্যটকদের স্বাগত জানার জন্য সব সময় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রয়েছে।