FEATUREDFemaleGeneralNewsSambad Matamat

শ্রীতারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের জননী স্বর্গীয় প্রভাবতী দেবী আমার পিতামহী ।।

জয়তী মুখার্জী । রাচি

শ্রাবণ মাসের এক পুণ্য লগ্নে রত্নগর্ভা স্বর্গীয়া প্রভাবতী দেবী জন্ম দিয়েছিলেন এক গর্ব করার মতো সন্তানের ,যাকে আজ শুধু লাভপুর বাসীই নয় ,সমস্ত বাঙালি ,” শ্রাবণের ধারার” মত শ্রদ্ধা বর্ষণ করছেন, তিনি আমার পরম শ্রদ্ধা- ভাজন জ্যেঠামশাই স্বর্গীয় তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। তাঁর সাহিত্য সম্বন্ধে আলোচনা করার ক্ষমতা বা জ্ঞান আমার নেই । ছোটবেলার কিছু স্মৃতি মনে উঁকি দেয় শুধু। আমার ছোটবেলায় পোলিও হয়েছিল তখন তার চিকিৎসার জন্য আমি মায়ের সাথে টালার বাড়িতে বেশ কিছু দিন ছিলাম ।আমি ,মা, বাবা টালা পার্কের বাড়ির দোতলায় থাকতাম। নীচের তলায় জেঠামশাই তার লেখার ঘরটিতে বসে যে সাধনা করতেন তা আমার দেখার সুযোগ ছিল না কারণ আমি তখন হাঁটতে পারিনা। উনি নিজেই দোতলায় উঠে আসতেন মাঝে মধ্যে । মনে পড়ে বিছানার পাশে এসে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করতেন ,” কেমন আছো শীলুমা ?” তখন খুবই ছোট আমি ।অনেক কিছুই মনে নেই কিন্তু সেই ” শীলুমা” ডাক আর তাঁর স্নিগ্ধ হাসিটি আজোও মনের মধ্যে গেঁথে আছে। আর মনে পড়ে আমার বিয়ের আগে যখন ব্যাকুল হয়ে তাঁর কাছে ছুটে গিয়ে বলেছিলাম ( একথা আগেও লিখেছি) ,” ওগো জ্যেঠা মশাই , আমাকে বাঁচান ।। আমি বিয়ে করবো না।” আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন ,” কে্ঁদো না মা । তোমার বাবা যখন বিয়ের ঠিক করেছেন তখন ভেবে চিন্তেই বিয়ের ঠিক করেছেন।”লাভপুরে মাঝে মধ্যে যখন আসতেন আর মুচকুন্দ গাছের নিচে বাঁধানো বেদীর উপর বসতেন , গ্ৰামের বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে গল্পে মাতোয়ারা হয়ে যেতেন তখন বুঝতে পারতাম না কতো বড় সাহিত্যের সাধক ছিলেন। ছোট ছিলাম ।
আমার দিদি শ্রীমতী কলাপী মুখার্জির মুখে শুনেছি আমাদের ঠাকুমা একদিন কথায় কথায় আমার মাকে বলেছিলেন ,” আমার ভাইরা সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে জীবনে প্রতিষ্টিত হয়েছে। আমার হবু স্বদেশিকতা করতে গিয়ে লেখাপড়াটা শেষ করলো না। আমার মনে তো একটু খেদ ছিল । তবে আজ বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্ৰীর থেকে ও অনেক বড় কিছু অর্জন করেছে।” ঠাকুমা নিজের সন্তানের প্রসংশা জনে জনে বলে বেড়ানোর মতো মানুষ ছিলেন না কিন্তু সন্তানের এই সাফল্যে নিশ্চয়ই গর্বিত ছিলেন। মনের তৃপ্তি ও আনন্দ তিনি প্রকাশ করেছিলেন। ঠাকুমা ছিলেন অসাধারণ নারী । সত্যিই তিনি ছিলেন জোর্তিময়ী। আমার ঠাকুদা স্বর্গীয় হরিদাস বন্দোপাধ্যায়ের প্রথমা স্ত্রী একটি কন্যা সন্তান রেখে মারা যান । আমাদের সেই পিসিমার নাম ছিল ,” সতী”। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী হয়ে যখন আমাদের ঠাকুমা বন্দোপাধ্যায় পরিবারের অন্দরে প্রবেশ করেন তখন তাঁর বয়স ১৫ বছরের বেশি হবে না। তখন সতী পিসিমা ৬/৭ বছরের মেয়ে। ১৫ বছরের নতুন মা তার সপত্নী কন্যাকে এমন আপন করে নিয়েছিলেন যেন কত কালের পরিচয়। পরবর্তী কালে সেই পিসিমার ছেলে ,” বিভু” মামার বাড়িতে অর্থাৎ আমাদের বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করতেন। দিদির কাছে একটি ঘটনা শুনেছি আর যা শুনে এটা সহজে অনুমান করা যায় যে ঠাকুমা ও সতী পিসিমা দুজনে দুজনকে তাদের প্রাপ্য আদর ও সম্মান দিয়েছেন। ঠাকুমার তখন বেশ বয়স হয়েছে ।কানেও কম শোনেন। সতী পিসিমা তখন গিড়িডীতে ছেলের কর্মস্থলে থাকেন। সেখান থেকে লাভপুরে এসেছেন তার মায়ের সাথে দেখা করতে।সন্ধাবেলা। ঠাকুমার কাছে সতী পিসিমা এসে দাঁড়িয়েছেন ।ঠাকুমা লন্ঠনের আলোটি ধরে বললেন,” কে তুমি ?” আমি সতী গো মা ।” ঠাকুমা খপ করে সতী পিসিমার হাত ধরে বললেন ,” সতী ! তুমি আমার সতী !! ” আমার দিদির ভাষায় ,”  “আমার সতী ” কথার মধ্যে এমন একটি হৃদয়স্পর্শী ব্যাপার ছিল যা মনকে ছুঁয়ে গেলো।কি স্বর্গীয় সেই দৃশ্য রে, কি আনন্দময় সেই পরিবেশ তোকে বলে বোঝাতে পারবো না রে শীলা। এতোবড় মন ছিল ওদের।ওরা আমাদের আপনজন এটা ভেবেই গর্ব হয় রে।” ঠাকুমাকে কাছ থেকে দেখেছি ।তার মুখে ” টম-কাকার” কাহিনী শুনেছি । বাংলায় অনুবাদ টম কাকার মর্মান্তিক কাহিনীর অভূতপূর্ব বর্ণনা শুনে ঠাকুমার কোলে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছি । এই ঘটনাও আমার দিদির কাছেই শোনা। আর একটি কথা নাকি প্রায় গল্পের শেষে বলতেন ,” বোলনেবালা ঝুটা আর শুননেবালা সাচ্চা।” অর্থাৎ যিনি কাহিনী শোনাচ্ছেন তিনি কল্পনার আশ্রয় নিয়ে বর্ণনা করে চলেছেন আর যে শ্রোতা তার অনুভূতির মধ্যে কোন ফাঁক নেই। এমন মায়ের ছেলেও যে কাহিনী লিখে গেছেন তাতো পড়নেবালার মনকে মন্ত্রমুগ্ধ করবেই। আমার শত সহস্র প্রণাম জানাই ।  courtesy for image: www.anandabazar.com

Leave a Reply

Your email address will not be published.