‘আপনাদের প্রয়োজনেই ‘সংখ্যালঘু’ থাকাটা প্রয়োজন’
শিতাংশু গুহ, অক্টবর ২০২৩, নিউইয়র্ক।।
বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে হিন্দুরা ‘সংখ্যালঘু’ ছিলোনা। বৌদ্ধ বা খৃষ্টানরা সংখ্যালঘু ছিলোনা। ধর্মীয় পরিচয় ভিন্ন হলেও সবাই বাঙ্গালী ছিলো, মনেপ্রাণে বাঙ্গালী না হলেও চেষ্টা ছিলো, সরকারি সাপোর্ট ছিলো। এরপর জিয়াউর রহমান সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘বিসমিল্লাহ’ আমদানী করলেন। এরশাদ সংসদে ১০মিনিটে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বিল পাশ করে, ‘ইসলাম’ সংবিধানে পাকাপোক্ত করে দেন্। সংবিধানে ৫ম ও ৮ম সংশোধনী বহাল থাকলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান-আদিবাসী-নৃতাত্বিক গ্রূপগুলো ‘সংখ্যালঘু’ হয়ে যান। সুপ্রীমকোর্ট সুযোগ দিয়েছিলো বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার, আওয়ামী লীগ সানন্দে সেটা প্রত্যাখ্যান করে। আওয়ামী লীগের কাছে জিয়াউর রহমান ‘হারাম’, কিন্তু জিয়ার ‘৫ম’ সংশোধনী এবং এরশাদের ৮ম সংশোধনী ‘আরাম’।
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবার জন্মাষ্টমী অনুষ্ঠানে হিন্দুদের উদ্দেশ্যে পুনরায় বলেছেন, ‘আপনারা নিজেদের সংখ্যালঘু ভাববেন না’। নেতারা অনেকেই এটি বলতে পছন্দ করেন। হিন্দুরা তো সংখ্যালঘু হতে বা থাকতে চায়না। তাঁদের জোর করে সংখ্যালঘু বানানো হয়েছে। এমুহুর্তে পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা আছে, আওয়ামী লীগ চাইলে সরকার এমুহুর্তে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে আসতে পারে, তাতে হিন্দুরা আর সংখ্যালঘু থাকবে না। কেউ সাঁধে সংখ্যালঘু হতে চায়না, আর ৯০% মুসলমানের দেশে ‘সংখ্যালঘু’ হবার যন্ত্রনা তো হিন্দুরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বাংলাদেশের ‘জগাখিচুড়ি’ সংবিধান হিন্দুদের ‘সংখ্যালঘু’ বানিয়েছে, সংখ্যাগুরুর সদিচ্ছা থাকলে পুনরায় বঙ্গবন্ধু’র প্রদর্শিত পথে ফিরে আসতে পারেন।
‘মদিনা সনদে দেশ চলবে’-একথা জনগণ বহুবার শুনেছে। সরকার ইসলামের জন্যে কি কি করছে একথা বলতে বলতে নেতা-মন্ত্রীদের মুখে ফেনা উঠে যাচ্ছে। এ তালিকাটি অবশ্যই বেশ লম্বা। সরকার কি বলবেন গত ১৫বছর আপনারা হিন্দুদের জন্যে কি করেছেন? বৌদ্ধ-খৃষ্টানদের জন্যে কি করেছেন? এমন একটি তালিকা কি তৈরী করবেন? এমন একটি তালিকা তো সরকারের হাতে থাকা উচিত। না, এমন লিষ্ট করা সম্ভব নয়, কারণ গত দেড় দশকে সরকার কিচ্ছু করেনি। সত্য হচ্ছে, ১৯৪৭-র পর কোন সরকার হিন্দুদের জন্যে কিচ্ছু করেনি। এটাই বাস্তবতা। বর্তমান সরকার হিন্দুদের জন্যে যা করেছে তা ‘মুখে মুখে’। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের এই সরকার শুধু হিন্দুদের জন্যে কিচ্ছু করেনি তা নয়, এই সরকার প্রগতিশীল শক্তির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চ-সহ সকল সাংস্কৃতিক আন্দোলন ধ্বংস করে দিয়েছে।
এজন্যে এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হেফাজতের সাথে আপোষ করতে হয়? অথচ প্রগতিশীল শক্তি মাঠে থাকলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এমনিতেই পালাতো। প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিটি সংঘাতে সরকার মৌলবাদীদের পক্ষ নিয়েছে। মুক্তমনারা খুন হয়েছে, দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, অথবা ভয়ে ঘরে বসে গেছে। এতে মাঠ খালি হয়েছে, সেই জায়গা দখল নিয়েছে মৌলবাদী শক্তি। সরকার যাদের দুধকলা দিয়ে পুষেছে, সামনের নির্বাচনটি সুষ্ঠূ হলে তাঁরা সেই ঋণ শোধ করবে এবং সরকারকে পথে বসিয়ে দেবে। আজকের বাংলাদেশের চেহারাটা অনেকটা আফগানিস্তানের মতো? মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এটি ঘটেছে। দু:খটা সেখানে, শেখ হাসিনা’র আমলে দেশটা একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হলো! আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যতটা উন্নতি হয়েছে, ঠিক ততটা নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। পুরো দেশ চোর, বাটপার, তোষামোদকারীতে ভরে গেছে। এথেকে মুক্তির কোন রাস্তা আপাতত: দেখা যাচ্ছেনা। নির্বাচন নিয়ে দেশে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে, সামনে হয়তো অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হবে? গুজবে দেশ ছয়লাব, সকল পক্ষ গুজব ছড়াচ্ছে। ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার এই সংগ্রামে সংখ্যালঘুরা ভীত, কারণ সংখ্যালঘু হিন্দুরা ‘স্কেপ-গোট’। তাঁরা বলছেন, কে ক্ষমতায় গেলো বা না-গেলো তাতে আমাদের কি, হামলা তো হবে হিন্দুর ওপর? সদ্য রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, ‘সরকার চাইলে দুর্গাপূজায় হামলা হবে, না চাইলে হবেনা’! নির্বাচনের জন্যেও একথা প্রযোজ্য। রাশেদ খান মেনন কিছুকাল আগে বলেছেন, ‘হিন্দু শিক্ষককে জুতার মালা পড়ানোই যায়’! চারণ কবি হিন্দু রাধাপদ রায় (৮০)-কে পিটানোই যায়? এই কবিকে হিন্দু বললে অনেকে ‘মাইন্ড’ করেন, বলি এই কবি হিন্দু না হলে কি তার গায়ে হাত পড়তো? বাগেরহাটের রামপালে গ্রাম্য হিন্দু মহিলা রূপালী দাস, ৪৫-কে ইসলাম অবমাননার দায়ে ফাঁসিয়ে দেয়াই যায় (মামলা নং পেনাল কোডের ১৫৩/২৯৮/৫০৬ ধারা)। জিএমকাদের-এর ভাষ্যমত (৭ই অক্টবর ২০২৩) সরকারি দলের নেতারা হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করতেই পারেন! দুর্গাপূজার আগে একের পর এক মূর্তি ভাঙ্গাই যায়? ভাইজান, সংখ্যালঘু আছে বলেই আপনারা এখনো নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি করছেন না! কাজেই ‘সংখ্যালঘু’-দের অস্বীকার করে লাভ নেই, আপনাদের প্রয়োজনেই ‘সংখ্যালঘু’ থাকাটা প্রয়োজন। Pic courtesy : Scroll.in