প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ‘ইম্পিচমেন্ট’ বা অভিশংসন অথবা অফিস থেকে অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এবং সেটি ধামাচাঁপা দেয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ঘটনা ২৫ জুলাই’র একটি ফোন-কল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টেলিফোনে কথা বলেন ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলদাইমার জেলেনস্কি’র সাথে। ডেমোক্রেটদের অভিযোগ, এ সময় ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে চাপ দেন ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ফ্রন্ট রানার জো বাইডেন ও তার পুত্র হান্টার বাইডেন-কে নিয়ে তদন্ত করতে। পিতার সুবাদে বাইডেন পুত্র ইউক্রেনের একটি তেল কোম্পানির বোর্ডে আছেন। হোয়াইট হাউস এ সংক্রান্ত টেলিফোন কথোপকথন ইতিমধ্যে প্রকাশ করেছে। তাতে জো বাইডেন প্রসঙ্গ আছে, কিন্তু তদন্ত না করলে সামরিক সাহায্য বন্ধ করা হবে, এমন কিছু নেই? অভিশংসন পত্রে বলা হচ্ছে, ট্রাম্প ব্যক্তিগত স্বার্থে তাঁর পদ ব্যবহার করে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছেন এবং হোয়াইট হাউসের কিছু কর্মকর্তা সবকিছু ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
নিউইয়র্কে যখন জাতিসংঘ অধিবেশন শুরু হয়েছে, বিশ্ব নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হয়েছেন, ঠিক তখন এই ঘটনার শুরু। ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলদাইমার জেলেনস্কিও এসেছেন অধিবেশনে যোগ দিতে। অভিযোগ শুনে তিনি বলেছেন, আমরা স্বাধীন দেশ, আমাদের কেউ চাপ দিতে পারেনা, আমাকে চাপ দিতে পারে শুধুমাত্র আমার ছয় বছরের পুত্র। ট্রাম্প রেগে বলেছেন, এই সামান্য ব্যাপারে ‘ইম্পিচমেন্ট? তিনি এতে অতি বামদের ষড়যন্ত্র দেখছেন। বৃহস্পতিবার ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ জাতীয় নিরাপত্তা অস্থায়ী ডিরেক্টর জোসেফ ম্যাকগায়ার কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, হোয়াইট হাউস তাঁকে কিছু ধামাচাপা রাখতে নির্দেশ দেয়নি। কংগ্রেসের স্পীকার ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেট কংগ্রেসওমেন ন্যান্সি পেলোসি অভিশংসন অভিযোগ পত্রের কিছুটা অংশ পড়ে শোনান। তিনি বলেন, ‘দেয়ার ইজ এ কাভার-আপ’। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধু যে ইউক্রেনে সীমাবদ্ধ থাকবে তা নয়, বরং এর সাথে যুক্ত হবে, অসদাচরণ, প্রেসিডেন্সি থেকে ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জন, ক্যাম্পেন ফাইন্যান্স আইন অমান্য, বর্ডার ওয়ালের জন্যে বেআইনি ভাবে ফান্ড সংগ্রহ ইত্যাদি।
এসব কিছুর পেছনে একজন সিআইএ কর্মকর্তা। ১২আগষ্ট নিউইয়র্ক টাইমস ওই সিআইএ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এক রিপোর্টে বলেছিলো, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিদেশী রাষ্ট্র দিয়ে আমেরিকায় তাঁর প্রতিদ্ধন্ধিকে তদন্ত করাতে চান, যা দেশীয় নির্বাচনে বিদেশী হস্তক্ষেপের সামিল। প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত এটর্নি সাবেক নিউইয়র্ক সিটি মেয়র রুডলফ জুলিয়ানি এবং সম্ভবতঃ এটর্নি জেনারেল উইলিয়াম পি বার এতে জড়িত। ওই সিআইএ কর্মকর্তা কে তা এখনো প্রকাশ পায়নি, তবে একসময় তিনি হোয়াইট হাউসে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে বলা হচ্ছে ‘হুইসেলব্লোয়ার’। ট্রাম্প জানতে চান কে এই ‘হুইসেলব্লোয়ার’। জানা গেছে, তিনি সাক্ষ্য দেবেন। এই ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়ার তিন প্রধান হচ্ছেন, ন্যান্সি পেলোসি, এডাম ছিফ এবং জেরি ন্যাডলার। বলা হচ্ছে, রেডিক্যাল লেফট বা ‘বোল্ড ডেমোক্রেটরা’ এর পেছনে। পেলোসি বলেছেন, ৬টি কংগ্রেশনাল কমিটি ট্রাম্পের অপরাধগুলো তদন্ত করবেন। এদের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে জুডিশিয়ারি কমিটি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইম্পিচমেন্ট ড্রাফট বানাবেন এবং তা অনুমোদন করবেন। এরপর এটি হাউসে যাবে। হাউস অনুমোদন করলে তা সিনেটে যাবে ভোটাভুটি’র জন্যে। সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে এটি পাশ হলে প্রেসিডেন্ট অপসারিত হবেন।
মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণা দেন। রিপাবলিকানরা ইম্পিচমেন্ট ধারণা বাতিল করে দেন। সিনেট মেজরিটি লিডার মিচ ম্যাককনেল বলেছেন, আমরা ইম্পিচমেন্ট ঘোষণায় ন্যান্সি পেলোসির সাথে নাই? প্রবীণ রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, প্রকাশিত টেলিফোন কথাবার্তায় ইম্পিচমেন্টের মত কিছুই নেই। অপর প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর জন করনিন এমনকি ‘হুইসলব্লোয়ার’ রিপোর্ট না পড়েই বলে দিয়েছেন, সিনেট কখনোই প্রেসিডেন্ট ট্রামকে কনভিক্ট করবেনা। রিপাবলিকানরা অবাক হয়েছেন, কেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টেলিফোন কথাবার্তা প্রকাশ করলেন, কিন্তু একই সাথে তাঁরা অভিশংসন ধারণা বাতিল করে দেন। তবে একজন প্রাক্তন রিপাবলিকান সিনেটর আরিজোনার জেফ ফ্লেক বলেছেন, ৩৫জন রিপাবলিকান সিনেটর ট্রাম্পকে অপসারণের পক্ষে ভোট দেবেন। তিনি আরো বলেছেন, ২০২০ নির্বাচনে ট্রাম্প হারুক তাই তিনি চান? নভেম্বর ২০২০-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ন্যান্সি কি নির্বাচনকে সামনে রেখে ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করলেন? কেউ কেউ বলছেন, এতে বিচারে বিঘ্ন সৃষ্টি হলো কিভাবে? প্রেসিডেন্ট কি সুবিধা পেলেন? ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করে ডেমোক্রেট শিবিরে কি ভাঙ্গন সৃষ্টি হবে? রিপাবলিকান শিবিরের কেউ কেউ কি ডেমোক্রেটদের সাথে যোগ দেবেন? শেষ পর্যন্ত কি হবে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ পর্যন্ত কোন প্রেসিডেন্ট অভিশংসিত হয়ে ক্ষমতা হারাননি। প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জনসন’র বিরুদ্ধে ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়া পূর্ণতা পায়, কিন্তু তিনি এক ভোটে রক্ষা পান। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারীতে ফেঁসে যান, এবং পদত্যাগ করেন। নিক্সনের সময় রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটরা যৌথভাবে তাঁকে অভিশংসিত করার পক্ষে ছিলেন এবং পদত্যাগ না করলে তিনি অভিশংসিত হতেন। মনিকা লিউনস্কি কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে বিল ক্লিন্টনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিচারে বিঘ্ন সৃষ্টির অভিযোগ ওঠে। পার্টি লাইনে ভোটে ক্লিন্টন রেহাই পান। এন্ড্রু জনসন ১৮৬৮ এবং বিল ক্লিন্টন ১৯৯৮ সালে ইমপিচড হ’ন এবং দু’জনই ভোটে রক্ষা পান। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন কংগ্রেসের ভোটাভুটি’র আগেই পদত্যাগ করেন। অর্থাৎ তিনি অভিশংসিত হননি।
একজন প্রেসিডেন্ট বিশ্বাসঘাতকতা, ঘুষগ্রহন, বা অন্যকোন গুরুতর অপরাধ এবং এমনকি ছোটখাট কারণেও অভিশংসিত হতে পারেন। মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী বিচারকরাও অভিশংসন হতে পারেন এবং বেশ ক’জন বিচারক এ পর্যন্ত অভিশংসিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট জনসন গৃহযুদ্ধের পরপরই যুদ্ধমন্ত্রীকে অপসারণ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের বিরুদ্ধে বিচারে বিঘ্নসৃষ্টি ও মনিকা লিউনিস্কির বিষয়ে ফেডারেল জ্যুরিকে মিথ্যা বলা বা ‘পারজারির’ অভিযোগ ছিলো। নিক্সনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো, বিচারে বিঘ্নসৃষ্টি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং কংগ্রেসের সাপিনা অগ্রাহ্য করা। পদত্যাগ না করলে তিনি যেকোন একটিতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ক্ষমতা হারাতেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যে ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু হলো তা কতদূর যায়, এখনই বলা যাবেনা। তবে তিনি অভিশংসিত হয়ে ক্ষমতা হারাবেন, তা পাগলেও ভাবেনা।
এ সময়ে কংগ্রেস বা হাউস ডেমোক্রেটদের দখলে, সেখানে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্টতারর জোরে অভিশংসন প্রস্তাব পাশ হতে পারে। ৪৩৫ আসনের কংগ্রেসে ২৩৫ ডেমোক্রেট ১৯৯ রিপাবলিকান সদস্য আছেন (১১৬ তম কংগ্রেসের নর্থ ক্যারোলিনার একটি আসন রিপোর্ট হয়নি, সেখানে রিপাবলিকানরা জিতেছেন)। কিন্তু একজন প্রেসিডেন্ট ইম্পিচইড হন সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে। রিপাবলিকানরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ট। ১০০ আসনে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটদের অবস্থান ৫৩-৪৭ (২জন নিরপেক্ষসহ) ট্রাম্পকে সরাতে ৬৭ ভোট দরকার হবে? অর্থাৎ অন্তত: ২০জন রিপাবলিকান সিনেটরকে পক্ষ ত্যাগ করে ডেমোক্রেটদের সমর্থন করতে হবে, যা এক রকম অসম্ভব। এমনিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অনেক রিপাব্লিকানও পছন্দ করেন না, কিন্তু দলের বাইরে তাঁরা যেতে পারবেন কি? ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়া রাজনৈতিক অপরাধের রাজনৈতিক সমাধান। দুইপক্ষ মিলে উদ্যোগ না নিলে ইম্পিচমেন্ট ব্যর্থ হতে বাধ্য। এবারকার উদ্যোগ দলীয়। রিপাবলিকানরা তাদের প্রেসিডেন্টকে অভিযুক্ত এমনটা আশা করা যায়না, এবং প্রেসিডেন্ট অভিযুক্ত হলে পার্টি ভেঙ্গে পড়ার সম্ভবনা থাকবে, নেতারা সেই রিস্ক নেবেন কেন? সুতরাং, পার্টি লাইন ভোটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বেঁচে যাবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়া কি ওই পর্যন্ত গড়াবে?
ডেমোক্রেটরা প্রক্রিয়াটি দ্রুত এগিয়ে নিতে চাচ্ছেন, এর প্রমান ইতোমধ্যে তাঁরা আটঘাট বেঁধে নেমে পড়েছেন। কংগ্রেসের তিনটি শক্তিশালী কমিটি, ফরেন, ইন্টিলিজেন্স ও ওভারসাইট কমিটি বিদেশমন্ত্রী মাইক পম্পিও-কে ইউক্রেন সংক্রান্ত নথিপত্র জমা দেয়ার নোটিশ দিয়েছে। ৪ঠা অক্টবরের মধ্যে এসব দিতে হবে। এও বলেছে, না দিলে সেটা অভিশংসন প্রক্রিয়ায় বিঘ্নসৃষ্টি বলে বিবেচিত হবে? একই প্যানেল সোমবার জ্যুলিয়ানিকে ইউক্রেন সংক্রান্ত সকল দলিলপত্র ১৫ই অক্টবরের মধ্যে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। রুডি জুলিয়ানি বলেছেন, ট্রাম্প যদি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে বাইডেন সম্পর্কে তদন্ত করার কথা না বলতেন, তাহলে তিনি আবার কিসের প্রেসিডেন্ট? এদিকে আর্মেনিয়াতে জুলিয়ানির একটি সেমিনারে পয়সার বিনিময়ে ভাষণ দেয়ার কথা ছিলো, তিনি তা বাতিল করেছেন। বলেছেন, পুতিন সেখানে থাকবেন তা তিনি জানতেন না! আসলে ট্রাম্পের কপালটাই খারাপ। ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই তিনি পদে পদে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন। ডেমোক্রেটরা তাঁকে এক প্রকার টেনে নামাতে চাইছেন। মাত্র ক’দিন আগে তিনি ‘মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ান হস্তক্ষেপ’ সংক্রান্ত স্পেশাল কাউন্সিল রবার্ট মুলারের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন, এরই মধ্যে আবার