অকৃতজ্ঞ মৃণালিনী
গেট দিয়ে বাড়িতে ঢোকবারবআর বের হবার সময় প্রায়ই মহিলাটির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। পরনের শাড়িতে দারিদ্র্যের ছাপ। করুন চোখ যেন তারই সাক্ষ্য বহন করে।
পূজার বাড়ির উল্টোদিকে তার বাড়ি। দিনে কয়েকবার দেখা হয়। না চাইলেও চোখাচোখি হবেই। পূজার মা অসুস্থ হবার পর থেকে তার বৌদি সংসারের সমস্ত দায়িত্ব হাসি মুখে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। সংসারের সমস্ত কাজ, এমনকি বাইরে বেরিয়ে বাজারটা পর্যন্ত। কাজের জন্যে বৌদিকে দিনে কয়েকবার বাইরে বের হতে হয়। বাইরে বের হলেই উল্টোদিকের বাড়ির সেই মহিলাটির সঙ্গে গেটে দেখা হয়। সকাল বিকেল মহিলাটি, তার বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে থাকে।
একদিন বৌদি কোলে মেয়েকে নিয়ে গেট দিয়ে বের হচ্ছে, মহিলাটি ছোট মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নিজে থেকেই কথা বলল, ‘মায়ের সঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছ বুঝি‘।
বৌদি হেসে বলল, ‘না। ওর দাদুভাইয়ের কাছে যাবে জেদ ধরেছে‘ বলে একটু হেসে চলে গেল।
একটি ছোট কথা দিয়ে শুরু হলেও কয়েকদিনের মধ্যে কথায় কথায় বৌদির সঙ্গে মহিলাটির আলাপ হয়ে গেল। নিজেই তার অতীতের সঙ্গে বর্তমানের নানা সমস্যার কথা জানালেন। স্বামী নেই, হাতের অবশিষ্ট টাকা দিয়ে এই বাড়ির পিছনে দু‘কাঠা জায়গা কিনেছেন। দুই ছেলেই তার বেঁচে থাকবার একমাত্র অবলম্বন। বড় ছেলে টেবিল টেনিস খেলায় ভালো। স্যারের অনুরোধে কোচিং সেন্টার কোন টাকা নেয় না। কিন্তু শুধু ভালো খেললেই তো হবে না, মাধ্যমিক পাশ করা চাই অথচ বই কেনবার টাকা নেই।
মহিলাটির সব কথা শুনে বৌদি পূজার দাদার সঙ্গে আলোচনা করল। দাদ ছেলেটির জন্যে বই কিনে দিল।এমনকি প্রাইভেট টিউটরের টাকা দিতেও রাজী হয়ে গেল। মহিলাটির আনন্দের সীমা থাকল না। দিন যেতে লাগল। দেখতে দেখতে তার বড় ছেলে কলেজের পরীক্ষায় পাশ করল। যেহেতু, ভালো খেলোয়াড়, সুতরাং তাড়াতাড়ি চাকরি পেতেও কোন অসুবিধে হল না।
পূজার দাদার ছোট্ট মেয়েটিও বড় হয়ে টেবিল টেনিস শিখছে কোচিং সেন্টারে।কিন্তু কিছুতেই সে স্যারের শেখানো বুঝে উঠতে পারছে না।খেলার ট্রিক্স কিছুতেই আয়ত্ত হচ্ছে না। ফাইনালে জুনিয়র লেভেলে বারবার হেরে যায়,সে। খেলার প্রতি একটা আতঙ্ক আর ভয় জন্ম নিল তার মনে।
বাধ্য হয়ে বৌদি একদিন মহিলাটিকে বলল, ‘ আপনার ছেলে তো খুব ভালো খেলে, যদি আমার মেয়েটাকে একটু প্র্যাক্টিশ করায়‘।
বৌদির কথা শেষ না হতেই মহিলাটি বলল, ‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ। বাবু এবার ছুটিতে এলেই আমি পাঠিয়ে দেব।‘
বাবু ছুটিতে বাড়িতে এল। মুখরক্ষার জন্যে একদিন ছোট মেয়েটিকে প্র্যাক্টিশও করালো। একদিনেই ছোট মেয়েটি নতুন অনেক কিছু শিখে গেল । শুধু তাই নয়, বাবুর কথায় খেলা নিয়ে মনের আতঙ্কটাও অনেকটা কমে গেল।
এরপর প্রায় রোজই বৌদি মহিলাটিকে ডেকে অনুরোধ করতে লাগল, ‘ বাবুকে একবার বলো, ছোট্ট বোনটাকে যেন আরও কয়েকদিন শিখিয়ে দেয়। এতে ওর ভয় অনেকটা কমে যাবে। ভালো করে শিখবে। নাহলে ওর খেলা বন্ধ করে দিতে হবে। ফাইনাল ম্যাচে হারতে হারতে ভয়ে ওর চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে।‘
‘ছেলে বাইরে চাকরি করে, একদিনের জন্যে আসে। ও নিজেই সময় পায় না‘, মহিলাটি বৌদিকে এড়িয়ে যায়।
এদিকে রোজ মেয়ের খেলাতে হেরে যাওয়া, তার কান্না– চোখের জল, ভয়, আতঙ্ক শুধু দাদা– বৌদি নয়, পূজার মনেও শেলের মতো বিঁধতে লাগল।
বাড়িতে শোকের পরিবেশ নেমে এলে পূজা দৌড়ে গেল সেই মহিলাটির কাছে। হাত জোড় করে মা ও বাবুর কাছে অনুরোধ করল, ‘সময় পেলে যদি একটু যদি বাচ্চা মেয়েটির সঙ্গে খেলো তাহলে ওর হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস আবার হয়তো ফিরে আসবে। যত টাকা চাও আমি তোমাকে দেব ভাই।‘ ছেলেটি কিছু না বলে পাশের ঘরে চলে গেল।
মহিলাটি একবার বসতেও বলল না। নরম গলায় বলল, ‘আপনি তো স্কুল টিচার। জানি, আপনি বেশি বাড়ি থেকে বের হন না। আপনাদের তো কত ঋণ আছে আমার বাবুর ওপর। ও অবশ্যই যাবে।‘
পূজা হাত জোড় করে অনুরোধ করবার সময় ভুলেই গিয়েছিল একটি ছাত্রের বয়সী বাচ্চা ছেলের কাছে অসহায় ভাবে সে সাহায্য ভিক্ষা করছে। মহিলাটির কথায় বিশ্বাস করল সে।
বাড়ি ফিরে সবাইকে জানাল কথাটা। কিন্তু এক সপ্তাহ চলে যাবার পরও বাবু আর এল না।
একদিন আদরের মেয়েটি খেলায় হেরে যাবার পর কান্নায় লাল হয়ে গেল। পূজা বলল, ছেলেটি আজও এল না।
বৌদি বলল, ‘ আসবে না।‘
‘মানে?’
মহিলাটির সঙ্গে গেটে দেখা হয়েছিল কিছুদিন আগে। আমি কিছু বলবার আগেই বলল, ‘বাবু বলছিল, একজনকে শেখালে ওর পোষাবে না। তুমি যদি কয়েকজন ছাত্র–ছাত্রী জোগাড় করতে পারো, তাহলে ওর শেখাতে কোন আপত্তি নেই।‘
কথাটা কানে যেতে
————– মৃণালিনী মৃনাল