জয় হল জয় বাংলার, গদিতেই গদ্দারের টান
দেবারুণ রায়
সবাই দেখছে তৃণমূলের জয়জয়কার। আর বিজেপি গোহারা। ঘটনাও তাই। আসলে যে কোনও ঘটনা যেমনই হোক, মানে ভালো বা মন্দ, আম জনতা যা মনে করে সেটাই আসল । বাকিটা তো বিশ্লেষণ। মানে যা ঘটল তার আসল মানে। সেটা নিয়ে আম জনতার তেমন মাথাব্যাথা নেই। তারা দুয়ে দুয়ে চারটাই বোঝে। কিন্তু সবাই সবটা যদি বুঝতে চাইত,তবে হয়ত তাদের দুর্গতি কিছুটা দূর হত।ভোটের বোতাম টেপার সময় ভুল জায়গায় হাত পড়তনা।
এবারের বাংলার ভোট এমনি একটা বার্তা এনে দিয়েছে, যে সোনার বাংলার স্বর্ণকাররা সপাটে বঙ্গজননীর থাপ্পড় খেলেও স্কোর তাদের ৭৬। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বাংলায় কুখ্যাত। আনন্দমঠে তার দৃশ্য পাওয়া যায়। আর ‘৭৬ ছিল পুরো জরুরি অবস্থার কালো বছর। এই অঙ্কটা বাংলা বা ভারতের কাছে শুভ নয়। আগন্তুকের স্রষ্টা সত্যজিতের শতবর্ষে অন্তত “কূপমণ্ডুক” আর “গণশত্রু” চেনাল বাংলা। মমতা যত ভুলভাল করুন, বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফলটা বোঝেন এবং তার মার্কেটিং টাও জানেন, নাহলে মোদি = মহাশূন্যে বাজারের মহান আওয়াজ রুখতেন কীকরে ?
মার্কসবাদে মার্কেটিং নেই। কিন্তু চিনেরা এখন চিনচিন চিন্তায় ফেলেছে বিশ্বের বেচুবাবুদের। ওরা কমিউনিস্টি নয়। গায় পুঁজিবাদের জয় । তবু আমেরিকার ভয়। কেন ? শি জিন কি জিনিস মোদিজি জানেন। তাই তার কাছে প্যাটেল কেনেন।কী অসাধারণ ! “বিবেকামুন্নন” বলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি। আহা কি আনন্দ সেদিন। বামফ্রন্ট ভুল কিছু করেনি আব্বাসকে নিয়ে। কিম্বা কংগ্রেসের সঙ্গে গিয়ে। কিন্তু এই তিন শক্তি, মানে ত্রিশূল বাংলায় সব পাপ ধুয়েমুছে আদর্শের উসুল তুলে সরকার গড়ার মত জোট। কিন্তু এটা সময়ের বিপরীতমুখী। তাই এই অসময়ে নিরুপায় মানুষের ভালোবাসা শূন্যে মিশে গেছে। আর যদি আজানের আল্লাহ্ আকবরের সুরে মিলে যেত আব্বাসের মসনদি চাল, যদি হাল বুঝে সর্বহারা মানুষের কথা ছেড়ে ধর্ম হত ঢাল, তবেতো কামাল হয়ে যেত মোর্চায় ছিলেন যারা মালামাল হয়ে যেত তাদের সকাল। হ্যাঁ, অবশ্যই রাজা হত বিজেপি, তাদের সবার সুরে সুর, সেতো হত বিভাজন বিজেপি বিরোধী ভোট , বিজেপি শাসক হত , হতনা নাকাল।
এই আত্মত্যাগটাই করেছে বাম ও কংগ্রেস। দধিচীর অস্থি দিয়ে তৈরি বজ্র বিজেপি রুখেছে। তৃণমূল বলছে দিদির জয়। মোদির মহান কর্ম “দিদি ও দিদি ” কে বাংলার সজাগ ধিক্কার। যেদিন ভিক্টোরিয়ার মাঠে জয়শ্রীরাম হল, নীরব মোদি বুঝিয়ে দিলেন, তিনি চান ধর্ম দিয়ে মেরুকরণ। মমতা সবিনয়ে বক্তৃতা বর্জন করলেন। কিন্তু মোদি এত বুদ্ধিমান হয়েও বোঝেননি, সেদিনই রচিত হল বাংলায় মমতার জয়রথ আর বিজেপির এপিটাফ। সাধারণ মেরুকরণ শুরু সেদিন থেকেই। তারপর বিজেপি মমতাকে যত মেরেছে, ততই বাংলা তাকে আড়াল দিয়েছে। যখন জয়শ্রীরাম নিয়ে নোংরা কথা ছোঁড়া হল, তখনই মুজিবের কণ্ঠ ধার নিয়ে মমতা বললেন ” জয় বাংলা ।” মনে হল, সেদিনই সম্পূর্ণ হল অস্মিতার অঙ্গীকার বাংলার বাঙালির। এই বাঙালি শুধু বাংলাভাষী নয়, যাদের জন্ম জন্ম কর্ম ভূত ভবিষ্যত বাংলায়, তারা সবাই।
বোঝা যায়না, এর পরেও মোদিরা কোন মদিরাবশে মমতাকে এত আক্রমণ করলেন ? কমিশন বন্ধ করে দিলেন তাঁর প্রচারাভিযান ? ফলে বাংলার
স্বাভিমান মমতার বেশে দেখা দিল।তখন বাম কং ভাইজান তৃণমূল নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলার মান বাঁচানোর সঙ্কল্প নিয়ে। এবার আশিতে আসিওনা বিজেপি।অমিত শাহের দুশো কোনও নতুন কথা নয়। এটাই মার্কেটিং। নাহলে ভোটের শেষে প্রেসক্লাবের সাংবাদিক বৈঠকে শমীক ভট্টাচার্য ভোটে বিজেপিকে জেতানোর জন্য সবাইকে ধন্যবাদ দেন ? এ দৃশ্য চোখে দেখা দিল্লিতে। শীলা দীক্ষিতের জয়ের প্রাক্কালে আডবাণী বিজেপি সরকার হচ্ছে বলে ঘোষনা করেছিলেন ১১ নং অশোক রোডের সাবেক সদর দপ্তরে ডাকা সাংবাদিক বৈঠকে। সুতরাং এটাই সংঘ বিজেপির পরিচিত ও স্থায়ী মার্কেটিং স্ট্রাটেজি। দিল্লি গত পঁচিশ বছরের ওপর এই আওয়াজে কান দেয়নি। বাংলা এবার বিরল শঙ্খনাদে বুঝিয়ে দিল, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি।
একটা খোঁচা রয়ে গেল নন্দীগ্রামে। ওখানে টাগ অফ ওয়ার পুরনো তৃণ ঘরানার। “শুভেন্দুরা ১০ টা বুথে রিগিং করেছে। তারপর বেলা দেড়টা থেকেই তৃণমূলের ধপাস ধপাস ধপাস। ” বললেন মমতা। তবে তৃণমূল কিন্তু কোনও পুনর্নির্বাচন বা ফের কিছু বুথে ভোট গোনার দাবি তোলেনি। এটাই ছিল মমতার স্বস্তির প্রমাণ। তাহলে এখন কেন বৎস ? অবশ্য মমতা বললেন, একটা আসন ছেড়ে দেবেন তেমন পরিস্থিতি হলে। বললেন, এত বড় জয়, একটা আসন ছেড়ে দেবেন মানুষের রায় মেনে। পরে মামলার কথা বলেছেন। দেখা যাক। বাংলা এবার সব দিক থেকেই আলো দেখালো। বিজেপির অসঙ্গত নীতি খারিজ। এবং যে সরকারের বিরুদ্ধে এত কাঠ কাঠ অভিযোগ, তাকে কাট করে কাটমানিকে পাশ কাটিয়ে তৃণমূলের মাস্তুলের মাথার পতাকা পতন ? এটা কি শুভেন্দুর ছক, নাকি হরতন নয় ইস্কাবনের টেক্কা ? এই নিয়ে টেক্কা নন্দীগ্রামে না দিলেও নবান্নে দেবেন তৃণমূল সুপ্রিমো। জিতে আসবেন অনায়াসেই খড়দা থেকে। কিন্তু নন্দীগ্রাম তো কাঁদবে ! নাকি একটা খটকা থেকেই যাবে ! বিভীষণ কী ভীষণ শত্রু । গদিটাই আসলে যে গদ্দার !