GeneralIndiaNewsPoliticsSambad Matamat

কংগ্রেসের খড়্গ ধারালো না ভোঁতা

দেবারুণ রায়

মল্লিকার্জুন খড়্গের সাংগঠনিক নেতৃত্বগুণের ও জনপ্রিয়তার খড়্গে ধার কতটা আছে তার অ্যাসিড টেস্ট হবে হিমাচল ও গুজরাতের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে। তিনি ২৪ বছর পর কংগ্রেসে পরিবারের বাইরের সভাপতি। রক্তের রং নীল নয়, নির্ভেজাল লাল। তাই পরীক্ষা তাঁকে দিতে হবে। যদিও পরিবারের উত্তরপুরুষ রাহুল গান্ধীকেও পরীক্ষায় বারবার জেরবার হতে হয়েছে।  জি ২৩ এর জন্ম হয়েছে কংগ্রেসের মতো প্রশ্নাতীত পরিবারতান্ত্রিক দলে। এমনকি  যে প্রিয়াঙ্কাকে প্রিয়দর্শিনীর প্রতিরূপ বলে উত্তর প্রদেশের উচ্চ বর্ণের কংগ্রেসিরা ভোটের তুরুপ মনে করত, হত্যে দিত প্রিয়াঙ্কা লাও দেশ বঁচাও নারায়, তাদের কাছেও পরীক্ষায় পাস করেননি রাজীবকন্যে। যে সনিয়া ক্ষমতা থেকে কংগ্রেসের  আট বছরের নির্বাসন কাটিয়ে দলকে নবকলেবরে ফিরিয়ে এনে দশটা বছর সাউথ ব্লকের শিখরে রেখেছেন, তাঁকেও জনভিত্তিহীন  রাজ্যসভার কংগ্রেসি কাগুজে বাঘেদের হুঙ্কার শুনতে হয়েছে। জমিদারি খোওয়ানো জমিদারের তালপুকুরে যখন ঘটি ভোবে না তখন তো কাঁকড়াবিছের কামড় খেতেই হয়। যদিও সনিয়ার ছেলে মেয়েরা অমেঠি হারানোর পর আর পরিবারতন্ত্রের গদা বিজেপির হাতে রেখে দল চালাতে চাননি। পাঞ্জাবের  চান্নিই তাঁদের চিনিয়ে দিয়ে গেছেন নিজে গো হারা হেরে।  মানের কাছে মান খুইয়ে, পরিবার দেখেছে সিধুজ্যাঠা শেষে কিনা কোনকালের ক্রিমিনাল কেসে ফেঁসে ঘানি পিসিং পিসিং আর পিসিং ! অমরত্বের দাবিদার অমরিন্দারেরও হাড়ির হাল হল ভোটে। এরপর আর পরিবারের কর্তৃত্ব চালাতে চাননি সনিয়া। পরিবারের চেয়ে দরবারি শ্রেয়। আর চিরকালীন গান্ধী পরিবারের ভক্ত মল্লিকার্জুন তো একদম দরবারি কানাড়া।  অনেক ক’টা রাজনৈতিক উৎকর্ষের পালক আছে তাঁর সভাপতির মুকুটে। ১) তিনি দলিত। ৫০ বছর পর গান্ধীজির পার্টির প্রথম দলিত সভাপতি। শেষ দলিত সভাপতি ছিলেন বিরাট ব্যাপ্তির এক ঐশ্বর্যশালী নেতা। তিনি বাবুজি জগজীবন রাম। তাঁর অভিষেক ১৯৭০ এ। বাবুজি ছিলেন বিহার থেকে উঠে আসা শানদার জননেতা। আবার পরিবারের বাইরের শেষ সভাপতি সীতারাম কেশরীও ছিলেন বিহারের। দশ নম্বর জনপথের অনুগত দরবারি ছাড়া কেশরীজির আর কোনও প্লাস পয়েন্ট ছিল না। কিন্তু খড়্গের তেমন দৈন্যদশা নয়। ৫৩ বছর তিনি কংগ্রেসের মূলস্রোতে থাকা গান্ধী পরিবারের অনুগত নেতা। মাত্র একবারই দলে বিদ্রোহী দাগ লেগেছিল তাঁর সাদা আস্তিনে। তাও কি । যাঁর নেতৃত্বে তিনি ১৯৭৯ তে দল ছেড়েছিলেন তিনি তো ইন্দিরার অসময়ের সবচেয়ে বড় আশা ভরসা। তিনি দেবরাজ আরস্। কর্নাটকের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কর্ণধার। এই মুখ্যমন্ত্রীই সাতাত্তরে রায়বেরিলিতে হারের পর ইন্দিরাকে জিতিয়ে এনেছিলেন তাঁর রাজ্যের চিকমাগালুর থেকে।  সেই আরস ছিলেন মল্লিকার্জুন খড়্গের মেনটর। কিন্তু তাঁর সঙ্গে দল ছাড়লেও একবছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফিরে আসেন কংগ্রেসে। এহেন নেতার কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কের বয়স ৫৩। লোকসভায় কংগ্রেসের আসন সংখ্যাও ৫৩। এবং শেষ ভোটেই প্রথম হার তাঁর।  কং সভাপতি নির্বাচন সহ মোট তেরটি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন সারা জীবনে। ১২ টিতেই জিতেছেন তিনি। ৮০ পাল করেও শারিরীক সক্ষমতায় সবাইকে টেক্কা দিতে পারেন। তবে আনুগত্য নিয়ে কোনও ছুপা রুস্তম হতে চান না। খোলাখুলিই বলেছেন, সনিয়া-রাহুলের পরামর্শ নিয়েই তিনি কাজ করবেন। এতে যে যাই ভাবুক সবাই বোঝেন, এটাই ঠিকঠাক বন্দোবস্ত।  

খড়্গে দলিত হলেও তাঁর দলিত রাজনীতির নেতা হিসেবে কোনও আইডেন্টিটি নেই।  সেজন্যই বারবার অন্য  জাতিগত আইডেন্টিটির তিন নেতাকে তাঁর ছেড়ে দিতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর আসন। এঁরা হলেন,  এস এম কৃষ্ণ,  ধরম সিং ও সিদ্ধারামাইয়া। তাঁর দলিত সমর্থনের ভিত্তি থাকলে তিনি এভাবে বারবার শীর্ষপদে বঞ্চিত হতেন না। সুতরাং দলিত সভাপতি হলেও তেমন কোনও লাভ নেই কংগ্রেসের। উত্তরে তো বটেই।  কারণ তিনি হিন্দী বলয়ের কেউ নন। দক্ষিণেও জাতিগত আধার কোথায় ? অবশ্যই প্রভাবশালী কিছু পকেটে।  

তবে মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকের মাঝখানের এলাকার প্রতিনিধি হিসেবে তিনি কন্নড়ের পাশাপাশি মারাঠিও জানেন। মোট পাঁচটি ভাষায় অনায়াসে কথা বলতে পারেন। হিন্দি,  উর্দু,  মারাঠি , কন্নড় ও ইংরেজি। শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে আন্দোলনের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলার সূত্রে তাঁর পরিচিতি একজন শ্রমিক হিসেবে। সভা সমাবেশ মিছিলের আয়োজন ও সংগঠনে তাঁর অবদান থাকেই সবসময়।  যদিও হাইকমান্ডের মুশকিল মেটানোর  দূত হিসেবে এখনও পর্যন্ত তাঁর কোনও সাফল্য হাতে লাগেনি। অসমে তরুণ গগৈ  বনাম হিমন্ত বিশ্বশর্মার সংঘাত তিনি থামাতে পারেননি। রাজস্থানে গেহলোত-পাইলট সংঘাতও  সামলাতে ব্যর্থ হয়ে গেহলোতের জাদুকরির সঙ্গে পেরে ওঠেননি। এবং পাঞ্জাবে গিয়ে দলের গোষ্ঠীতন্ত্রে লাগাম পরানো তো দূরের কথা পাঞ্জাবের পাততাড়ি গোটাতে হয়েছে কংগ্রেসকে। এখন তিরিশটি রাজ্যের ভেতরে কংগ্রেসের শাসন শুধু  রাজস্থান আর ছত্তিশগড়ে। বাংলা ওডিশা সহ আরও কয়েকটি রাজ্যে কংগ্রেস মাথা তোলার দশায় নেই। খড়্গের ক্ষমতা কি ওই দুটি রাজ্যে ক্ষমতায়  থাকার বা ফেরার জন্য  কোনও জনসশ্রংযোগে যান ? তবে তাঁর দুটি রাজনৈতিক অর্জন আছে। প্রথম হল, দলিত ও পরিবারের বাইরের বলে তাঁকে সরাসরি কুকথা বলা কঠিন।  বললে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মহল থেকে  পাবেন সমুচিত জবাব।  তাতে বিরোধী বিজেপির হিতে বিপরীত হবে। আর ২) গান্ধী পরিবারের কাউকে নেতা হিসেবে পেলে সমালোচনা  বা ফুট কাটার যে সুবিধে, খড়্গের মতো একজন প্রবীণ নেতার নামে তেমন  মুখরোচক গপ্পো বিজেপির কাছে নেই।  ব্যাপক খোঁজা চলছে চারদিকে।

যে রাজ্যগুলোতে বিজেপির মুখোমুখি লড়াই হয় শুধু কংগ্রেসের, সেই বিস্তৃত ভূখণ্ডে লোকসভার মোট আসন রয়েছে ১০০টি। আর যেসব এলাকায় কংগ্রেসের প্রভাব  ক্রমাগত কমছে সেই বিরাট অংশে আছে লোকসভার ২৭০ টি আসন। যা প্রায়  গরিষ্ঠতার ম্যাজিক নম্বর। সুতরাং হারানো তাড়ানো এই চত্বরে ক্যারিশমা ছাড়া ভোটক্যাচার হওয়া সম্ভব নয়। শুধু ক্যারিশমাতেও  চিঁড়ে ভিজবেনা। চাই কাজের নমুনা আর ভোটের অঙ্ক।  অঙ্ক ঠিক করা কঠিন কংগ্রেসে। কারণ সভাপতির কাজের নেপথ্যে থাকবেন গান্ধী পরিবারের ত্রিমূর্তি । হিমাচল আর গুজরাতের ভোট রাহুলের  পদযাত্রার লক্ষ্য নয়। লক্ষ্য ২০২৪। এই যুক্তি দেখিয়ে কংগ্রেসের ভারত জোড়ো যাত্রা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে এই দুই সম্ভাবনার দ্বিদলীয় রাজ্য। মোদীর পক্ষে এটা যথেষ্ট স্বস্তির। আদিবাসীদের কংগ্রেস পাছে খুঁচিয়ে তোলে ,তাই  আদিবাসীদের কার্যত পাহারা দিচ্ছে বিজেপি।  কিন্তু  রাজস্থানের গেহলোতের গুজরাত নিয়ে শিরঃপীড়া থাকলেও রাহুলের এই ছোট ভোটের জন্যে কেন মাথাব্যথা নেই সেটা বড় প্রশ্ন। এটা আসলে সভাপতি  খড়্গের  পরীক্ষা।   প্রথম পরীক্ষাই অনুরাগের  হিমাচল আর মোদীর গুজরাতের হিন্দুত্ব-হাটে ! অগ্নিপরীক্ষা ! Pic courtesy The Business Standard

Leave a Reply

Your email address will not be published.