আতঙ্কে সংকটমোচন
দেবারুণ রায়
মানবাধিকারের সংকট ব্যাপক আকার নিয়েছে। কিন্তু এবিষয়ে বিরোধী দলগুলোর আচরণ সবচেয়ে বেশি হতাশার। যখন যে দল সরকারে থাকে তাদের সম্বিৎ সবসময়ই ফেরাতে বাধ্য করে বিরোধীরা। হিন্দুত্ববাদীরা চিন্তিত হবে এমন পরিস্থিতি নেই। এর পিছনে যে কারণগুলো রয়েছে তা নিপুণ কৌশলে বিরোধীদের ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখেছে। স্পষ্ট মতাদর্শগত দিক থেকে বিরোধী কংগ্রেস ও কমিউনিস্টরা এতটাই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে তাদের সংসদীয় বা পরিষদীয় শক্তিতে যে এককভাবে কোনও সর্বভারতীয় আন্দোলনের পথে যাওয়া তাদের পক্ষে অকল্পনীয়। সুতরাং আন্দোলনের বা সর্বভারতীয় জোটের কথা উঠলেই ফোকাসে আসছে আঞ্চলিকরা। কোথাও তৃণমূল, কোথাও আরজেডি, কোথাও এসপি, কোথাও এনসিপি, শিবসেনা, কোথাও আপ, কোথাও টিআরএস বা বিজেডি, অথবা মায়াবতী, জগনমোহন কিংবা চন্দ্রবাবুর দল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মোদির নেতৃত্বে বিজেপির ঘুঁটি সাজানো এমনই নিপুণ যে মমতা ব্যানার্জিও বলেছেন, এই নামে কালামের মতো সর্বসম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হতে পারত বিজেপি আগে থেকে বললে। এই কথাতেও নিপুণ রাজনীতির বার্তা আছে কিন্তু বিরোধী প্রার্থীর লড়াই বেশ কঠিন হয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মানবাধিকার নিয়ে যে যার এলাকায় বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদের বেশি কিছু করার কথা ভাবছেনা। ফলে সরকারের উদ্বেগের প্রশ্ন নেই। এই ভয়ংকর বাস্তবতার মধ্যে সারা বিশ্বের মানবাধিকার আন্দোলনের ঢেউ ভারত মহাসাগরে এসে তার গতি হারিয়ে ফেলছে। প্রাকৃতিক নিয়মের মতো কিছু আন্তর্জাতিক ঘটনার স্ফুলিঙ্গ উড়ে এলেও বিরোধী অনৈক্যের জল তাকে নিভিয়ে দিচ্ছে। ফাদার স্ট্যানস্বামীর ঘটনা, ভারাভারা রাওয়ের ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুললেও তার পরিণামে দেখা যাচ্ছে বুদ্ধিজীবীরা দুই শিবিরে বিভক্ত। রাজনৈতিক দলগুলো যে যার ক্ষমতার এলাকা নিয়ে মুখর। সবই সোশ্যাল মিডিয়ার পরিসরে বিপ্লবের গর্ভপাতে শেষ হচ্ছে। এই ছন্নছাড়া বিরোধী শক্তির দুর্দশা জরুরি অবস্থা ও তার প্রাক সময়ের থেকেও হতাশার বার্তা দিচ্ছে পরিবর্তনের পক্ষে সক্রিয় সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের।
অধ্যাপক নোম চমস্কির উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া গোটা বিশ্বকে সজাগ করলেও দেশে এই সদর্থক ভাবনার হাল ধরবে কে ? শনিবার সকালে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন শান্তিনিকেতন থেকে এক ভিডিও ভাষণে চমস্কির কথার প্রতিধ্বনি করেছেন। যে ভাবে ও ভাষায় তিনি করে থাকেন সেভাবেই। গণমাধ্যমের একাংশের সদর্থক ভূমিকা কে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু যে বিপুল অংশ তার বাইরে তাদের তো নেতিবাচক ভয়ংকর ভূমিকা। সে বিষয়ে বলার অবকাশ অধ্যাপক সেনের
ছিল না সেই ফোরামে। কে না জানে গোদি মিডিয়ার মানসপ্রতিমা শুধু সর্বভারতীয় গণমাধ্যমে নয় সমস্ত রাজ্যের রাজধানী থেকে জেলার ছোট ছোট চ্যানেল ও পত্র পত্রিকায় বিরাজমান। ছোট বড় লাভের অঙ্ক মেলাতে ও টিকে থাকার অমোঘ অজুহাতে গণমাধ্যমের বিপুল অংশ প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে এস্টাব্লিশমেন্টের। ফলে যুক্তিবাদী আন্দোলনের পুরোধা কয়েকজন ব্যক্তিত্ব থেকে সাংবাদিক গৌরি লংকেশের খুনের কিনারা হয়নি। মহারাষ্ট্রের পাঁচমিশেলি জোট আড়াই বছর সরকারে থাকলেও দাভোলকরের খুনের কিনারা দুর অস্ত। কর্নাটকের বিজেপি সরকারের কাছে এ আশা দুরাশা। দিল্লির নখদন্তহীন সরকারের কোনও ক্ষমতা নেই জেএনইউয়ের ছাত্রছাত্রীদের দাবি পূরণের। কিন্তু উমর খালিদ প্রসঙ্গে চমস্কি ও অমর্ত্য সেনের উদ্বেগের ছায়াও পড়ে না উচ্চ শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের রাজনীতিতে আনার প্রবক্তা ও নিজে উচ্চ শিক্ষিত কেজরিওয়ালের কথায়। তিনি কানহাইয়া কুমারের মামলায় জমি তৈরি করে কেন্দ্রকে বড়সড় স্বস্তি দিয়েছেন এই অভিযোগ তাঁর বন্ধু বিরোধী নেতাদের মুখে শোনা যায়।
সাংবাদিক সান্না ইরশাদের দেশের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জুবেরের গ্রেফতার নিয়ে মুখর হয়েছেন কিছু কিছু বিরোধী নেতা। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ আঞ্চলিকরা কার্যত নীরব। এরা প্রত্যেকেই তাদের সংখ্যালঘু সমর্থনভূমি সম্পর্কে যথেষ্ট স্পর্শকাতর। কিন্তু কপ্পন থেকে জুবের তাদের ফোকাসে কোথায় ? শাসকদের কাছে এটাই তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের রূপোলি রেখা। কিন্তু কথায় বলে মানুষ যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব থাকে তখন ঈশ্বর সরব হন। এই ঈশ্বর কোনও অতিজাগতিক ঈশ্বর নন। রীতিমত জাগতিক। তার বিচ্ছিন্ন কিছু সংকেত পাওয়া যাচ্ছে বিচারবিভাগের মধ্যে। গণতন্ত্রে বিবেকের ভূমিকা পালন করে বিচারবিভাগ। সমস্ত স্তম্ভগুলোই যখন সচেতন নাগরিকদের স্তম্ভিত করে দিচ্ছে তখন একেকটি আলোকরেখা পরিদৃশ্যমান সর্বোচ্চ আদালতের পরিসরে। একটি বেঞ্চের প্রশ্নে সরকার রীতিমত বেসামাল। নূপুর শর্মা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত জনজীবনের সর্বব্যাপী হতাশাকে এক লহমায় আশায় রূপান্তর করেছে। বলা হয়েছে ধর্ম নয়, ক্ষমতাই এই ধরনের মন্তব্যের উৎস। অন্যদিকে, প্রাক্তন বিচারপতি দীপক গুপ্তা বলেছেন, বিচারবিভাগেও আতঙ্ক ও অস্বস্তির পরিবেশ। তাঁর অভিযোগ, রায় দিতেও স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন না তাঁর সহকর্মীরা। এই পরিস্থিতি মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থা জারির আগের ঘটনাবলি। এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিপাকে পড়ার পরবর্তী আতঙ্কের অধ্যায়। বিচারব্যবস্থাও সেই আতঙ্কের বাইরে ছিল না। এদিকে উদয়পুরের দর্জি কানহাইয়ালালের নৃশংস হত্যা সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। কথা উঠেছে খুনি হিসেবে অভিযুক্ত দুই আসামির বিজেপি যোগ নিয়ে। কংগ্রেস ও বিজেপি এনিয়ে তুমুল তর্কে অবতীর্ণ। এই তর্কের নির্যাস বিজেপির সুবিধা করে দিচ্ছে। কারণ, রাজস্থান কংগ্রেসের রাজ্য। এবং কেন্দ্রের যাবতীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নারাজ মানুষকে সাম্প্রদায়িক ইস্যু দিয়ে ভাঙানোই সবচেয়ে সোজা। প্রশ্ন হল, এই ধরনের নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটল তো একটা বিরোধী শাসিত রাজ্যে। খুনিরা বিজেপির হোক বা বিজেপিতে অনুপ্রবেশকারী হোক তারা বস্তুত সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী। মৌলবাদীদের মৌলবাদ ছাড়া কোনও ধর্ম নেই। তারা মৌলবাদ বা সাম্প্রদায়িকতাকে দেশজুড়ে জাগিয়ে তুলতে সক্রিয়। এবং মুসলিম মৌলবাদ হিন্দু মৌলবাদকেই মদত দেয় আবার বিপরীতমুখী মদতেই দাঙ্গার মতো ঘটনা ঘটে। তার ফলে ভোটে লাভবান হয় উভয় পক্ষের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিই। উদয়পুরের ঘটনা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
দারুন লেখা।কি অবস্থা দাড়াল ভাবলেই গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। কি হবে কি করব ভেবে উঠতে পারছি না।