জমি আন্দোলনের পথে কি আবার নকশালবাড়ি ?

অরুণ কুমার, শিলিগুড়ি
দীর্ঘদিন পর এবার আবার চাষের জমির অধিকার নিয়ে আন্দোলনের মেঘ ঘনাতে আরম্ভ করেছে নকশালবাড়িতে। উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং জেলার তরাই এলাকার ভারত-নেপাল সীমান্তে, মেচি নদীর সংলগ্ন সুরজবর মৌজায় জমি অধিগ্রহণ করে গোর্খা ব্যাটালিয়নের অফিস এবং পুলিশ ট্রেনিং ক্যাম্প বানাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এদিকে, ওই জমিতে চাষ করে সংসার চালান এলাকার হাজার দেড়েক কৃষক ও তাদের পরিবার। সরকারি এই সিদ্ধান্তে সেই কৃষকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণকে ঘিরে আবার অসন্তোষ বাড়ছে একসময়ে সারাবিশ্বে নজির তৈরি করা নকশালবাড়ি। এই যেন ফের জমি আন্দোলনের ছায়া নকশালবাড়িতে ঘনীভূত হতে আরম্ভ করেছে।আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগেই স্মৃতি যাদের মনে আছে সেই ষাটের দশকের আগুনঝরা দিনগুলির কথা? “লাঙল যার জমি তার” – এই স্লোগান তুলে আন্দোলনে নেমেছিলেন নকশালবাড়ির কৃষকরা। উত্তরের দার্জিলিং জেলার তরাই এলাকার নকশালবাড়ি থানার ভারত নেপাল সীমান্ত থেকে কিছুটা দূরে কয়েকবছর আগেও এখানে আস্ত একটা গ্রাম ছিল। কিন্তু ১৯৭৬ সালের মেচি নদীর বন্যায় পুরো গ্রামে জল ঢুকে যায়। ঘরবাড়ি ভেসে যায়।এই গ্রামের অন্যতম প্রবীণ বাসিন্দা বাবুল রায়। এখন তাঁর বয়স ৬৫। তার সাথে কথা বলে জানা গেল এই গ্রামের গড়ে ওঠার কথা। তিনি জানালেন,এতদিন ধরে আমরা এই মেচি নদী লাগোয়া জমিকে উর্বর করেছি। সেখান থেকেই আমাদের সারা বছরের খোরাকি আসে। এ দিয়ে আমাদের জীবিকার সংসার চলে।আরেক প্রবীণ কৃষক বিলাতু রায় জানালেন, আমরা জায়গায় বাড়ি বানাই। জল কমে গেলে আমরা সেখানে চাষ-আবাদ শুরু করি। । এখন শুনছি, সেই জমি সরকার আমাদের কাছে থেকে কেড়ে নেবে। অফিস হবে। তাহলে আমরা পরিবার নিয়ে কোথায় যাব? কী খাব?- এই কথা বলে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিলারামের বাসিন্দা । বহুবার বয়স্ক ভাতার জন্য আবেদন করেও তা মেলেনি। সংসার পালতে শেষ সম্বল সুরজবর মৌজায় বিঘা তিনেক জমি।এই গ্রামের বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বললে ফুটে উঠছে ভীটে হারানোর ভয় আর আতঙ্ক।নিজের জমিতে কোদাল দিয়ে আল তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন পদম দাস। কাজ করতে করতেই বলেন, ৪৫ বছর ধরে এখানে চাষ-আবাদ করছি। এত সহজে আমরা জমি ছাড়ব না। দরকারে প্রাণ দেব, কিন্তু জমি দেব না। তিনি আরও বলেন, কৃষিজমির পাট্টার জন্য বহুবার আবেদন জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি।অপরদিকে,নকশালবাড়ি ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক শুভঙ্কর সাহা জানান, সুরজবর মৌজায় প্রায় সাড়ে তিনশো একর সরকারি জমি রয়েছে। স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরেই সেখানে বেআইনিভাবে কৃষিকাজ করে আসছেন। সেখানে আগে কোনও বসতি ছিল, এমন কোনও তথ্য আমাদের কাছে নেই। কোনও পাট্টাও তাঁদের দেওয়া হয়নি।এদিকে স্থানীয়দের দাবি, পাট্টা চেয়ে বহুবার দরবার করেছেন তাঁরা। আর তার সুযোগ নিয়েছে স্থানীয় নেতারা। এই এলাকায় প্রায় সাড়ে পাঁচশো কৃষকের কাছ থেকে জমির পাট্টা দেওয়ার নাম করে কয়েক লক্ষ টাকা তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ। কিলারামের মেচ বস্তির বাসিন্দা ভারতী শৈব্য জানান, স্থানীয় নেতারা পাট্টা দেওয়ার নাম করে কারও কাছ থেকে ৫০০, কারও থেকে ১০০০ টাকা করে নিয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ পাট্টা পায়নি। ওই জমি যাতে কেউ নিতে না পারে সেজন্য ইতিমধ্যে কৃষিজমি রক্ষা কমিটি তৈরি করে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, গোর্খা ব্যাটালিয়নের অফিস এবং পুলিশ ট্রেনিং ক্যাম্প তৈরির জন্য স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুরজবর মৌজায় ১০৫ একর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই জমি যে কোনও সময় অধিগ্রহণ করা হতে পারে, সেজন্য আগে থেকেই কৃষকদের সেখানে চাষ করতে নিষেধ করা হয়েছে। অন্যান্য বছর জুন মাস নাগাদ মেচি নদীর তীরে প্রায় সাড়ে তিনশো একর জমিতে চাষ করতে ব্যস্ত থাকেন কৃষকরা। এবারও তাই। অনেকেই ধানের বীজ রোপণ করে জমিতে হালও দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু সোমবার প্রশাসনিক আধিকারিকদের জমি অধিগ্রহণের নির্দেশে সকলের মাথায় হাত পড়েছে। এমন পরিস্থিতি বড় মণিরাম, কিলারামজোত এবং সুরজবর এলাকার প্রায়দেড়েক হাজার কৃষক তাঁদের কৃষিজমি হারানোর আশঙ্কায় ভুগছেন।এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভূমিহারা ভিটেমাটি ছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় ভূমি রক্ষা কমিটি তৈরি করে একত্র করছেন বলে জানা গিয়েছে। প্রয়োজনেব্যাপক আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তাঁরা।আগামীতে দেখার বিষয় অতীতের সেই নকশালবাড়ি আন্দোলনের ছায়া কি আবার অন্যরূপে অন্য দিশায় আত্মপ্রকাশ হতে চলেছে নাকি সরকার এই সমস্যার সমাধানের পথ অন্যভাবে খুঁজে বের করবে।