GeneralNewsPoliticsSambad MatamatWorld

আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ার পর আমেরিকার বিদায়।। এবার কি ভারত-চীনের পালা? 

শিতাংশু গুহ, ১৮ই জুলাই ২০২১, নিউইয়র্ক।।

মহাভারতের গান্ধার রাষ্ট্রের কথা অনেকে না জানলেও হিন্দুকুশ পর্বতমালার নাম সবাই জানেন। গান্ধার রাষ্ট্র বা হিন্দুকুশ পর্বতমালা এখন আফগানিস্তান নামে পরিচিত। বিশ্ব রাজনীতিতে এ সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ধূসর মরুভুমি পাহাড় অধ্যুষিত আফগানিস্তান। কি হবে? এ প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই? তবে এর কারণ সবাই জানেন, আমেরিকা বা ন্যাটো সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেন ৩১শে আগষ্ট ২০২১’র মধ্যে সকল সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা করে বলেছেন, ‘এখন সৈন্যদের ঘরে ফেরার সময় হয়েছে’। মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) এ সিদ্ধান্তকে ‘ভুল’ হিসাবে অভিহিত করে বিশেষত: আফগান নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। খবরে প্রকাশ, তালেবানরা তাঁদের অধিকৃত অঞ্চলে ১৫-৪৫ বছরের সকল অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত, বা স্বামী পরিত্যক্ত, বিধবা নারীদের তালিকা চেয়েছে।

এরপর কি? দি প্রিন্ট মিডিয়া বলেছে, আফগান প্রশ্নে ভারত ও চীন কি একসাথে কাজ করতে পারবে? এসসিও (সাংহাই কোঅপারেশনে অর্গানাইজেশন) ভুক্ত দেশগুলোর এক বৈঠকে তাসখন্দে সদ্য ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন, ভারত শান্তির লক্ষ্যে আফগানিস্তানকে সহায়তা করবে। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিকে তিনি এ আশ্বাস দেন্। ডব্লিউপিআর (ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স রিভিউ) প্রশ্ন তুলেছে, ভারত-চীন কি আফগানিস্তানে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে? সাম্প্রতিক সময়ে হিমালয়ে  ভারত-চীন সংঘাতের পর দুই দেশের সহযোগিতা কি সম্ভব? বলা হচ্ছে, দিল্লি হয়তো স্থায়ীভাবে আফগানিস্তানে থাকার কথা ভাবছে না, চীন কি প্রত্যক্ষভাবে জড়াবে? আফগানিস্তানে শান্তি হয়তো দুই দেশের জন্যেই দরকার, তাই সহযোগিতা কি একেবারেই অসম্ভব? 

‘দি হিল’ মিডিয়া বলেছে, রাশিয়া ও আমেরিকার পর পরাশক্তি চীন কি আফগান বধ্যভূমিতে প্রবেশ করবে? অন্য দুই পরাশক্তির চেয়ে আফগানিস্তানে চীনের কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। আফগানিস্তানের সাথে চীনের সীমান্ত আছে। অনেকদিন ধরে চীন আফগানিস্তান কব্জায় নিতে চাচ্ছে, কারণ সেদেশের রুপার খনি, এবং সাথে রয়েছে সোনা, ইউরেনিয়াম ও লিথিয়াম। ওআরএফ (ওভারসিজ রিসার্স ফাউন্ডেশন) একধাপ এগিয়ে প্রশ্ন করেছে, ভারত-চীন-পাকিস্তান কি আফগান প্রশ্নে একসাথে কাজ করতে পারে? আফগান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার ঐ অঞ্চলে ‘শূন্যতা’ সৃষ্টি করবে তা সত্য, সেই শূন্যস্থান পুরণ করবে কে? মোল্লা ওমরের তালেবান সরকারের বর্বরতার কথা বিশ্ব জানে, আবার কি তালেবান সরকার আসছে? কাবুলে ক্ষমতাসীন আফগান সরকার গত কুড়ি বছর কি করেছেন? 

বিজনেস ষ্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা জানায়, বৃহস্পতিবার ১৫ই জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন যে, ৩১শে আগষ্ট সম্পূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্যে দিয়ে তিনি ২০ বছরের আফগান যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানতে চান। বিবিসি নিউজ বলেছে, ইতিমধ্যে ইউএস ও ন্যাটো জেনারেলরা ক্ষমতা হস্তান্তর বা পদত্যাগ করেছেন। ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশ, এমনকি ইংল্যান্ড ইতিমধ্যে তাঁদের সকল সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। এনপিআর বলছে, মার্কিন ইনটিজেন্স ধারণা করছে, ৬মাসের মধ্যে কাবুলের পতন ঘটবে। আফগান সৈন্যরা নিজেদের পরিত্যক্ত ও নি:সঙ্গ ভাবছেন। 

আফগান যুদ্ধের কারিগর ডিফেন্স সেক্রেটারি ডোনাল্ড রামসফিল্ড গতমাসে মারা গেছেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ৯/১১’র ২০বছর পূর্তির আগেই দুই দশকের যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান ২৯শে ফেব্রুয়ারি ২০২০ দীর্ঘস্থায়ী আফগান যুদ্ধে শেষ করতে এক চুক্তিতে পৌঁছে। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ২ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়, এবং ২৪শ মার্কিন প্রাণহানি ঘটে। ওই চুক্তির আলোকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ১১ই সেপ্টেম্বর ২০২১’র মধ্যে সকল সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন্। ১৬ই মে ২০২১ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং যি এত দ্রুত সৈন্য প্রত্যাহারের সমালোচনা করে বলেন যে, এতে এতদাঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হবে।     

মাস দুই আগে সৈন্য প্রত্যাহার শুরুর পর তালেবানদের অগ্রগতি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদেড় বিস্মিত করেছে।  পাকিস্তান অবাক হয়ে দেখছে যে, অল্প সময়ে তালিবানরা বেশ ক’টি শহর তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহারের পর এক মাসের মধ্যে তালেবানদের কাছে রাজধানী কাবুল’র পতন ঘটবে। তালেবানদের কাছে ক’টি তারিখ বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেপ্টেম্বর ১১, ২০০১ যেদিন ‘ওয়াল ট্রেড সেন্টার’ ধ্বংস হয়েছিলো; ০৭ই অক্টবর ২০০১ যেদিন মার্কিন নেতৃত্বে আফগানিস্তানে আক্রমন শুরু হয়েছিলো অথবা ১৩ই নভেম্বর ২০০১, যেদিন ‘কাবুল’-এর পতন ঘটেছিলো। অর্থাৎ এ তিনটি দিবসে যেকোন একটিতে তালেবানরা কাবুল পুনর্দখল করতে চাইবে?  

আলজাজিরা জানাচ্ছে, কাতারের রাজধানী দোহায় আফগান সরকার ও তালিবানদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে, যদিও তালিবানদের অগ্রগতিতে আলোচনা থমকে পড়ছে। এরমধ্যে দিল্লিভিত্তিক রয়টারের পুলিৎজার বিজয়ী ফটোসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকী শুক্রবার আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে তালেবানদের গুলিতে নিহত হ’ন। রয়টার প্রেসিডেন্ট মাইকেল ফ্রেডিনবার্গ এবং প্রধান সম্পাদক আলেসান্দ্রো গ্যালোনি বলেছেন, আমরা বিস্তারিত সংবাদ নিতে খোঁজ নিচ্ছি, তবে দানিশ সিদ্দিকী ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী সাংবাদিক, একজন ভালো স্বামী ও পিতা, যাঁকে সবাই ভালোবাসতো। যদিও ভারতে করোনায় হিন্দু মৃতদেহ দাহ’র ছবি প্রকাশ করে তিনি কিছুটা সমালোচিত। তালেবানরা দানিশ সিদ্দিকী হত্যার দায় অস্বীকার করেছে। 

রয়টার জানাচ্ছে, পাকিস্তানে আফগান রাষ্ট্রদূতের কন্যা সিলসিলা আলিখিল শুক্রবার বাড়ি ফেরার পথে ইসলামাবাদে অজ্ঞাত আততায়ীদের হাতে অপহৃত হ’ন। দূতাবাস জানায় সিলসিলার সাথে নিতান্ত খারাপ আচরণ করা হয়েছে, তাঁকে অত্যাচার করা হয়েছে, তবে কয়েকঘন্টা পর তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়, এবং তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এরমধ্যে খবর বেরোয় যে, আফগান মহিলারা অস্ত্রহাতে তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে গেছেন, যদিও এর সত্যতা কতটুকু তা বলা মুশকিল। তবে ইয়াজদি মহিলাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না, আফগান মহিলারা কি পারবেন ইয়াজদি মহিলাদের মত সাহসী ভূমিকা নিতে? অসমর্থিত সূত্র জানায়, তালেবানরা চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে রাজি। ইরানের সাথে আফগানিস্তানের সীমান্ত রয়েছে, তবে শিয়া-সুন্নি বিভক্তির কারনে এদের মধ্যে সু-সম্পর্কের সম্ভবনা কম! 

উইকিপিডিয়া জানায়, আফগানিস্তানের সাথে পূর্ব ও দক্ষিণে পাকিস্তান; পশ্চিমে ইরান, তুর্কমেনিস্তান,উজবেকিস্তান; উত্তরে তাজাকিস্থান এবং উত্তরপূর্বে চীনের সাথে সীমান্ত রয়েছে। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র এ দেশটি’র জনসংখ্যা ৩৯মিলিয়ন বা ৩কোটি ৯০লক্ষ, ৯৯.৭% মুসলমান, ০.৩% অন্যান্য। ২৫২হাজার বর্গমাইলের এ দেশটি মূলত: পশতু, তাজিক, হাজারা ও উজবেকদের নিয়ে গঠিত। এসোসিয়েটেড প্রেস এপি) জানায়, জর্জ বুশ জার্মান মিডিয়া ‘ডয়েচে ভেল’-কে এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে আফগানিস্তানের অবস্থা বিপর্যয়কর হবে বলে মন্তব্য করেছেন। উল্লেখ্য যে, প্রেসিডেন্ট বুশ ৯/১১-পর ক্ষমতাসীন তালিবান মোল্লা ওমরকে আফগানিস্তানের সকল সামরিক স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী ‘বিন লাদেন’কে হস্তান্তর করার আল্টিমেটাম দেন, মোল্লা ওমর তা মানতে অস্বীকার করেন, ফলে অক্টবরে ন্যাটো আফগানিস্তান আক্রমন করে। ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলেছে,  তালেবানদের অগ্রগতি এবং নিরাপত্তা বাহিনীর পশ্চাদপরতায় কাবুল সরকার বিস্মিত। এরমধ্যে ১হাজারের বেশি সৈন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে, আরো কয়েকশ’ তালেবানদের কাছে তাঁদের অস্ত্র সমর্পন করেছে।  

কি হবে? কেউ জানেনা কিহবে! তবে ভারত-চীনের দিকে সবার নজর। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এরফলে ভারত বিপদে পরবে, অন্যরা বলছেন, ২৪শে ভারতে নির্বাচন, আফগানিস্তান মোদির জন্যে আশীর্ব্বাদ হতে পারে? রাশিয়া ও মার্কিনীদের বিদায়ের পর ‘বল’ এখন ভারত-চীনের মাঠে, দেখা যাক, খেলার মোড় কোনদিকে ঘুরে। তবে যাই হোক, আফগান জনগণ আরো দীর্ঘদিন রাজনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হবেন তা বলা বাহুল্য। Pic Courtesy Scroll.in

Leave a Reply

Your email address will not be published.