উত্তরবঙ্গ আলাদা রাজ্য আর বিহারে নীতীশের বিদায়ের তোড়জোড় ?

দেবারুণ রায়
২০০৬ এই তো স্লোগান দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি : এবার নয়তো নেভার । বিজেপি সেটা দেয়নি। কিন্তু তৃণমূলের প্রাক্তনীদের পেটে পেটে দিদির এই ধরতাইটা বেশ মোচড় দিচ্ছিল। বেশ এক বিপন্নতা তাদের তাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল রাজনীতির উল্টোরথে। তারা তো বটেই বেশ নামি দামি রথী মহারথী। তৃণমূলের মূল থেকে মগডালে উঠেও তাদের মনে হয়েছিল, যে ডালেই বসে থাকুন না কেন সেটাতে আর রসকষ নেই। সুতরাং অমন রুক্ষু ডালপালা কেটে ফেললেই ল্যাঠা চুকে যায়। অতএব মুকুলদা, বর্গী স্যার, দিলিপদার হুকুমবরদার হয়ে দিল্লি দরবারের বড় বড় অমুক জি, তমুক জির পায়ের ধুলো নিতে রাতবিরেতে স্পেশ্যাল ফ্লাইটের ডেলি প্যাসেঞ্জারি। হুঁ হুঁ, দেখেছ দিদি আমি কতবড় হনু। কোন্নগরে কোণঠাসা করে রাখবে আমাকে ? আমি হীরে। হিরো থেকে জিরো হয়েছি । চির কাল কি এল এ বেল এ থাকব বলে ? তাও টিকিট পেতে পিকের কাছে টিকি বাঁধা দিতে হবে এই শর্মাকে ? ডোমজুড়ের ডোমেস্টিক ডামাডোলে ধামাধরা হতে হবে ? আমি তমুক বান্দা নই। রাজীব বন্দ্যো কোনও পরিবারতন্ত্রের বন্দি হবেনা। কিংবা আমি সল্টলেকে দত্তাবাদে আবাদ করেছি। আমি তৃণমূলের ধনুর্ধর অর্জুন। সব্যসাচী কি ডরায় শ্রীভূমি সুজিতে ? আর,অধিক কী,অধিকারী ? পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির। তাহাতে কি আসে যায় আমার পিসির ?
সব “এবার নয়তো নেভার” স্লোগান পেটে পেটে রাখা নেতাদের ধুলোর মতো উড়িয়ে দিল বাংলার মাটি, দুর্জয় ঘাঁটি। শুধু বাংলার বহিরাগত বনাম নন্দীগ্রামের বহিরাগত লড়াইয়ে বিরোধীনেতার বঙ্গবিজয়। মমতাকে হারানোর আশা পূর্ণ হল।তবে আধ লাখ হলনা। হল বারোশ। এবং বারোটা বাজল সুনার বাংলার। কেমন দেখতে সেই সুনার বাংলা ? যা টিনের বাংলার মতো। মন্ত্রিসভার চৌকাঠ ডিঙতে পারেনি বাংলা। চারজন মন্ত্রী গৌরবে বহুবচন।কেউ ক্যাবিনেট মিটিঙেও ঢুকতে পা,বেন না। প্রতিমন্ত্রী মানে হাফমন্ত্রী। পূর্ণমন্ত্রী নয়। অপূর্ণ থাকল সুনার বাংলার আকাঙ্খা। তিন থেকে সাতাত্তর জন এমএলএ দিয়েও বাংলা মোদি সরকারে এলেবেলে। এটাই বিজেপির বাংলার বার্তা। সবচাইতে পপুলার বাংলার এমপি বিজেপিতে, বাবুল সুপ্রিয়। কিন্তু আরএসএসের অপ্রিয়। হাফ প্যান্ট পরেননি কখনো। রামদেবের সুপারিশে কর্তা বলেছিলেন, মুঝে বাবুল চাহিয়ে। ঊনিশ থেকে একুশে পৌঁছে ভবানীপুরে গোঁত্তা খাইয়ে বাবুল হাফমন্ত্রী থেকেও খারিজ। কিন্তু তৃণমূলের মূল গন্ধ গায়ে মাখা নিশীথের জুটল একটা আধা মন্ত্রক। সেটাই উত্তরবঙ্গে নাকি আধার বিজেপির।হাভাতে মানুষগুলোর কী দুর্ভোগ। এবং আরও এক অর্ধেক মন্ত্রী হলেন জন বার্লা। যিনি উত্তরবঙ্গকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার আওয়াজ তুলেছেন। আর নিশীথ প্রামাণিক তাকে সমর্থন করেছেন। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী বাছলেন দুজনকেই। দিলিপ ঘোষ থতমত। বলেছিলেন, ওটা ওদের ব্যক্তিগত অভিমত। দলের নয়। কিন্তু বিজেপির বিধাতা আরএসএস এবং অবশ্যই যা দলের হাইকমান্ড তারা ওঁদের প্রতি যে কতটা প্রসন্ন তা বোঝালেন প্রতিমন্ত্রী করে। বার্লা আর প্রামাণিকের মাথায় বিজেপির ঈশ্বরের হাত। দিলিপ তাঁর যতটুকু ব্রিফ ততটাই করেছেন। এটাই সিস্টেম। আর এটা বাংলা। যেখানে আছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্যাথলজিক্যাল হেট্রেড, রক্তসঞ্জাত ঘৃণা। সুতরাং উহাদের পথে নিতে হবে সাথে , কিন্তু অধিকার নয়। ডানা ছেঁটে দিয়ে উড়তে বলতে হবে। সোনার বাংলার এই মডেলের পেছনে ১৮জন এমপি, ৭৭জন এমএলএ। যা বিজেপির চেয়ে তৃণমূলের কৃতিত্বই বেশি। এই পারফরম্যান্স দিয়ে বাংলা কিন্তু কেন্দ্রে একজনও পূর্ণমন্ত্রী পেলনা। বাংলার প্রতি বিমাতার নজর এতটাই। অথচ, কংগ্রেস জমানায় ৪ বা ৬ জন এমপি দিয়েই বাংলা পেয়েছে প্রণব, প্রিয়, বা অধীরের মত জাঁদরেল মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী। এমনকি রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রী করেনি ,তার পেছনে বাংলা ও বাঙালির অবদান অবশ্যই ছিল। আর মোদি যখন প্রণবদার ” উংলি পকড় কর ” দিল্লিতে নর্থ সাউথ ব্লকের গলিঘুঁজি চিনলেন , সেই প্রণবকে আরেকবার রাষ্ট্রপতি করার জন্য সোনিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। খেতাব দিয়ে কংগ্রেসকে এক হাত নিয়ে দেখালেন প্রণবের জন্যে তাঁর আকুলিবিকুলি । অথচ সাংমাকে নামিয়ে প্রণবকে আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন তাঁরাই। এনডিএ ভেঙেছে ওই ইস্যুতে,অথচ বিজেপি তীব্র অসাম্প্রদায়িক ও কট্টর কংগ্রেসি প্রণবকে রাইসিনা হিলসের দরজায় রুখতে আদালতে পর্যন্ত গিয়েছে। বিজেপির কালাম কং সমর্থনে রাষ্ট্রপতি হলেও কংগ্রেসের প্রণব, বাংলায় সর্বসম্মত প্রণবকে বিজেপি নখ দাঁত দিয়ে রুখতে চেয়েছে। মমতার বিরোধিতার পেছনেও ছিল বিজেপির স্বস্তি। কারণ আরএসএস,বিজেপির পছন্দের নিরামিষাশি কালাম ছিলেন মমতার প্রার্থী। অন্যরা মেনে নিলে বিজেপি সাংমা নামক খোলস খুলে কালামকে সমর্থন করত। এটাই ছিল জলমাপার আর বাঙালি রাষ্ট্রপতিকে রোখার জন্য কালাম খুড়োকে শিখণ্ডী করার কল। এই হল বাংলার প্রতি বিজেপির ভালবাসার অল্প ইতিহাস।
এছাড়া একটা দুরন্ত রূপান্তর ঘটেছে এবারের রদবদলে। সেটা হল, বিজেপিতে বাজপেয়ীর প্রায় পৃর্ণগ্রাস এবং মোদির চতুর্দশী। পনেরো কলা পূর্ণ হল। আর মাত্র বাকি থাকলেন রাজনাথ সিং। বাজপেয়ী জমানার সব দীপ একে একে নিভেছে বা নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেঙ্কাইয়াকে উপসর্গের মতো রেখে সপ্তম স্বর্গ থেকেই দূরে সরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি সুষমা স্বরাজ আর অরুণ জেটলির মৃত্যু এবং তার আগে শারীরিক কারণে স্বেচ্ছায় সরে থাকা। আডবাণী, জোশি, শান্তাকুমার, যশবন্ত সিং ও যশোবন্ত সিনহা, কলরাজ মিশ্র, শত্রুঘ্ন সিনহা, অরুণ শৌরী, নাজমা হেপতুল্লাদের আগেই বিদায় করা গিয়েছে বয়সজনিত কারণ সামনে এনে। এবারের বিদায় নীতির শর্ত বয়স নয় ,আরও সরেস। বোঝা যায় নামে। প্রকাশ জাওড়েকর, রবিশংকর প্রসাদ, হর্ষবর্ধন এবং বেরিলির সন্তোষ গঙ্গোয়ার। মোদির দেশোয়ালি ভাই মনসুখ ভাইকে স্বাস্থ্যে বসিয়েঅস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে চান।মনে সুখ তো হলই। প্রশ্নাতীত আনুগত্যই জমানার সবচেয়ে বড় যোগ্যতার সার্টিফিকেট। হ্যাঁ সংখ্যালঘু মুখ রামপুরের মুক্তার আব্বাস নাকভি কিন্তু টিকে গেছেন এই দফাতেও। ছিলেন আডবাণীর সন্তান। সেতো খোদ ঈশ্বরও ছিলেন। আসলে রূপান্তরটাই বড় কথা। শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি। এবং আরেকটি প্লাস পয়েন্ট হল, রামপুরের আজম কে হারিয়ে সাংসদ নন। নেতার ইচ্ছেয় রাজ্যসভায়। যে সৌভাগ্যে বঞ্চিত বাজপেয়ী জমানার সর্বকনিষ্ঠ পূর্ণমন্ত্রী শাহনওয়াজ হুসেন। তাঁকে রাজ্য রাজনীতির গণ্ডিতে বন্দি রাখা হয়েছে। কিন্তু রবিশংকর প্রসাদকে আইন থেকে সরানোর কারণ দলসূত্রে যা জানা গেছে তাও প্রধানমন্ত্রীর মূল লক্ষ্যের অনুসারী। সামনে যেকোনো কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় আইন মন্ত্রক আরও চাঙ্গা ও উপযোগী করতে হচ্ছে। তাছাড়া অদূর ভবিষ্যতে বিহারের নেতৃত্ব বদলের কোনও সংকেত নয় তো ? বিজেপি তাদের সংখ্যালঘু শরিকদলের নেতাকে মাথায় রেখে আর কতদিন চলবে ? সুতরাং তেমন কিছু , অর্থাৎ নীতীশের বিকল্প নেতার ভাবনা বিজেপির মাথায় এলে আরএসএসের পছন্দের স্বয়ংসেবক হিসেবে রবিশংকর বেশ মানিয়ে যাবেন। নাহলে জাত ও রাজনীতির সমীকরণে সংঘের অনুগত রবিকে শুধু শুধু সরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনার দায় নেবেন না শীর্ষ নেতৃত্ব। সুতরাং, কেন্দ্রে রদবদল কি বিহারে নীতীশকুমার জমানার অবসানের সংকেত ? Pic courtesy RBharat