BusinessGeneralNewsPoliticsSambad MatamatWorld

নেপালও চলেছে শ্রীলঙ্কার পথে: অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই প্রতিবেশী দেশ

অরুণ কুমার

ভারতের দুই প্রতিবেশী দেশে ক্রমেই আর্থিক সংকটের কালো মেঘ দেখা যেতে শুরু করেছে। শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যেই নিজেকে ঋণ খেলাপী বলে ঘোষণা করে দিয়েছে। অন্যদিকে, নেপাল প্রবলভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে অর্থকষ্ট ঘিরে। সেদেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের গভর্নরকে ইতিমধ্যেই সাসপেন্ড করা হয়েছে। এদিকে রাস্তা খোঁজা হচ্ছে সংকট থেকে বের হওয়ার।এদিকে রকেট গতিতে বেড়ে চলেছে জ্বালনির দামসমগ্র নেপাল জুড়ে । এই পরিস্থিতিতে দেশে জ্বালানি-খরচ রুখতে নেপালের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ও নেপাল অয়েল কর্পোরেশন সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে দুই দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করার। আর এর ফলে  রাস্তায় মানুষ কম বের হবেন, যাবেন না অফিসে। এতে তেলের খরচা কমানো যাবে বলে অভিমত দুই প্রতিষ্ঠানের। উল্লেখ্য, ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের জেরে বিশ্ব জুড়ে বেড়ে গিয়েছে জ্বালানির দাম। সবচেয়ে বড় তৈল উত্তোলক ইরান ও ভেনেজুয়েলাও পেট্রোলিয়াম বিক্রির ক্ষেত্রে বিধির আওতায় থাতায় বিশ্ব জুড়ে দাম বাড়ছে জ্বালানির। তারই মাঝে নেপালে দুই দিনের ছুটি ঘোষণার প্রস্তাব এসেছে সরকারের কাছে। বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেননি প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদবর দেউবা। তবে এই নিয়ে তাঁর সরকার বিবেচনা করছে বলে সংবাদ সংস্থা সূত্রে জানা গেছে।  এবিষয়ে উল্লেখ করতে হয় যে,আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই ততটা স্বচ্ছল নয়। নিজস্ব কোনও সম্পদ না থাকায় ৯০ শতাংশের বেশি প্রয়োজনীয় জিনিসই নেপাল বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে। ঝাড়ু এবং আদা ছাড়া নেপালের নিজস্ব কোনও সম্পদ নেই বা এর বাইরে কিছু রপ্তানিও করে না। পর্যটনের ক্ষেত্রে কিছুটা সহায়ক নয় তাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে। কিন্তু এদিকে পরিস্থিতির কারণে নেপালের অর্থনৈতিক কাঠামো ক্রমশ ভেঙে পড়ছে। সে দেশের অর্থনীতি এতটাই খারাপ যে, সমস্ত ব্যাংক বিদেশি লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে। পরিস্থিতির চাপে পড়ে ভারত, বাংলাদেশ থেকে নেপালে সমস্ত পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।  তা সরাসরি সে দেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মারাত্মকভাবে প্রভাব পড়েছে। 

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা,শ্রীলঙ্কার পথেই এগোচ্ছে নেপালও। আমদানি বন্ধ থাকায় মাথায় হাত পড়েছে নেপালের ব্যবসায়ীদের। এদিকে, এই পরিস্থিতির জেরে ভারতের বাজারেও ব্যাপক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কেননা পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারের বহু এলাকার ব্যবসা অনেকটাই নেপাল নির্ভরতা রয়েছে।
নেপালের অর্থনীতি মূলত নির্ভর করে বিদেশি মুদ্রা লেনদেনের উপরে। এখানকার সরকারি, বেসরকারি ব্যাংকগুলিও বিদেশি মুদ্রা কারবারেই টিকে রয়েছে। এদিন কাঁকরভিটায় এক ব্যবসায়ী সম্মিলনির অফিসে বসে  সেখানকার প্রবীণ ব্যবসায়ী উমাশংকর সিং বলছিলেন, নেপালের সিংহভাগ পরিবারের অন্তত দুজন বিদেশে থাকে। বেশিরই কুয়েত, দুবাই বা আরব আমিরশাহিতে বিভিন্ন কাজে যুক্ত। এছাড়া আমেরিকা, কানাডাতেও নেপালের কিছু ছেলেমেয়ে কাজ করে। বিদেশে কাজ করে সেখানকার উপার্জন করা মুদ্রা দেশে এনে তাঁরা ভাঙাতেন। এই বিদেশি মুদ্রার উপরই নেপালের অর্থনীতি অনেকটা নির্ভরশীল ছিল।অপরদিকে, পর্যটন নির্ভর দেশ নেপাল কোভিডের জেরে পর্যটনের ক্ষেত্রে বিপুল ধাক্কা খাওয়ার পর বড়সড় আর্থিক সংকটের মুখে। এই পরিস্থিতি থেকে দেশকে রক্ষা করতে নেপালের প্রবাসী বাসিন্দাদের প্রতি অনুরোধ করেছে নেপাল সরকার। নেপাল সরকারের অনুরোধ যাতে, নেপালের ব্যাঙ্কগুলিতে বিদেশে বসবাসকারী নেপালিরা বিনিয়োগ করেন। নেপালের অর্থমন্ত্রী জনার্দন শর্মা বলেছেন, সেদেশের ব্যাঙ্কে ডলারের অ্যাকাউন্ট খুলতে ,তাতে দেশের আর্থিক সংকট মোকাবিলায় কার্যকরী ফল দেবে।

বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পরে ২০২০ সালের এপ্রিল, মে মাস থেকেই লকডাউন এবং বিভিন্ন কারণে কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন নেপালের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা। করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হলেও এখনও সেই দেশগুলি আর এই কর্মীদের  ফেরাতে রাজি হচ্ছে না। যার জেরে নেপালে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে বিদেশি মুদ্রার জোগান প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে  গত এক দেড় বছরে এভাবেই নেপালের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

সংবাদ সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে,প্রতিবেশী নেপালের এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেদেশের সরকার বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। ইতিমধ্যেই নেপালের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রক নেপাল রাষ্ট্র ব্যাংক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ব্যাংকের বিদেশি লেনদেন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আর এই নির্দেশের পরেই নেপাল সরকার ভারত, বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। সেই তালিকায় চাল, চিনি, চকোলেট, জুতো, সিমেন্ট এবং সিমেন্ট তৈরির উপকরণ, জামাকাপড়, খেলার সামগ্রী, শাকসবজি, চিকিৎসা ও সার্জিক্যাল সরঞ্জাম,  বৈদ্যুতিক সামগ্রী রয়েছে। নেপালের সরকারি সূত্রের খবর অনুযায়ী, ৯০ শতাংশ ধান এবং চালই ভারত এবং বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে তারা।  দেশের নয়া নির্দেশিকার জেরে দেশে খাবারের আকাল দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও ক্রমশ তীব্র হতে আরম্ভ করেছে সূত্রের খবর।

এভাবে নেপালের বর্তমান পরিস্থিতিতে চিন্তার ভাঁজ সেদেশের ব্যবসায়ী মহলেও। আমরা এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম ভারত-নেপাল সীমান্ত ভর্তি পানিট্যাঙ্কি মেচিনগর লাগোয়া বেশ কিছু ব্যবসায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে। তাদের কথার মধ্যে  ফুটে উঠেছে আগামীদিনের আশঙ্কার কথা। এবিষয়ে বিরতা মোড়ের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সঞ্জয় কার্কী জানিয়েছেন, আমাদের পুরো ব্যবসাই শিলিগুড়ি নির্ভর। মাসে কোটি টাকার মালপত্র শিলিগুড়ি থেকে আসে। আমরা এখান থেকে ভারতীয় ব্যাংকের নামে ড্রাফট কেটে এখানকার ব্যাংকে জমা দিই। এখানকার ব্যাংক ভারতীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার ওই অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের এখানে ব্যাংকগুলির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাওয়ায় এই ধরনের লেনদেন অর্থাৎ রেমিট্যান্স বন্ধ করে দিয়েছে। যার জেরে কোনও সংস্থাই আর আমাদের পণ্য সরবরাহ করছে না।

একই পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন বিরাটনগরের আরেকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক অনুরাগ দেওয়ান। তাঁর মতে, আমাদের সাইকেলের ব্যবসা। দিল্লি, কলকাতা এবং শিলিগুড়ি থেকে আমাদের গাড়ি গাড়ি সাইকেল আসে। কিন্তু গত মার্চ মাস থেকে টাকা লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে এখানকার ব্যাংক। যার জেরে আমরা কোম্পানিকে টাকা পাঠাতে পারছি না। কোম্পানিও আর আমাদের মাল দিচ্ছে না। আমাদের ব্যবসা মাঠে মারা গিয়েছে। ভবিষ্যৎ আরও খারাপ বলে শুনছি। শ্রীলঙ্কার মতোই আমাদের দেশও অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার পথে।

গোটা পরিস্থিতি নিয়ে যতটা উদ্বেগ নেপালে, ঠিক ততটাই উদ্বেগ  বিহার তথা আমাদের রাজ্যেরশিলিগুড়ি সহ উত্তরবঙ্গের একাধিক বাজারে। এখান থেকে যে বিপুল পরিমাণ পণ্য নেপালে রপ্তানি হত তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু ব্যবসায়ীর মাথায় হাত পড়েছে। আগামীদিনে উত্তরবঙ্গের অর্থনীতিতেও তার প্রভাব পড়বে বলেই তাঁদের আশঙ্কা।নেপালে পণ্য আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায় যুক্তনকশাল বাড়ী-পানিটাঙকীর ব্যবসায়ী পান্নালাল সাহা বলেন, আমাদের ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমরা প্রচুর জিনিসপত্র প্রতিদিন নেপালে পাঠাতাম। সে দেশ থেকে ঝাড়ুও নিয়ে এসে এ দেশে বিক্রি করা হত। কিন্তু নেপালের অর্থনীতিতে এতটাই ধস নেমেছে যে সেখানকার ব্যাংকগুলি লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে।এই রকম অবস্থার  পরিপ্রেক্ষিতে নেপালের আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত উন্নতি না ঘটে তাহলে সীমান্তবর্তী বাণিজ্য হবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন উভয় দেশের বাণিজ্যিক মহল।

Leave a Reply

Your email address will not be published.