টাটার উল্টোরথে মোদির মিত্র আদানি এলেন বাংলার মন জয় করতে
দেবারুণ রায়
দৃশ্যপট শুধু বদলেছে। বদলেছে স্থান আর কাল। পাত্র সব বদলায়নি। কেউ কেউ একেবারেই অবিকৃত। বিষয়বস্তু রঙ্গমঞ্চ সবই প্রায় এক। বদলেছে সময় আর মানুষ। কুশীলবদের মধ্যে অবশ্যই বিরাট বদল ঘটেছে। সময়ের ফারাক অনেকটাই। দেড় দশক। বঙ্গের কপাল সঙ্গেই আছে। অতীতের সেই ট্র্যডিশন সমানে চলেছে। এস ওয়াজেদ আলির কথার নড়চড় হয়নি। তবে বাংলার বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চের দৃশ্যপটে দুদিন ধরে অবোধ বা সুবোধ বঙ্গবাসীর মনে যে আশা জাগানিয়া শব্দবন্ধগুলো রণিত হয়েছে সেগুলো আশঙ্কায় মোড়া। একটু পাংচুয়েশন পাল্টে নিলেই ২০০৭ আর ২০২২ কে অভিন্ন লাগছে। মুখ্যমন্ত্রীর পদে থেকে বুদ্ধদেব রাজ্যের যে রূপোলি রূপরেখা এঁকেছিলেন তার সঙ্গে মমতার মৌলিক স্বপ্নের কোনও পার্থক্য নেই। শুধু পরিবর্তনের অব্যবহিত আগে আর এক দশক পরে, এই যা তফাৎ। মানুষ গুলো বদলেছে সময়ের মতো করেই। কিন্তু সঙ্গ প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ সব এক। বাংলার ছেলেমেয়েরা যাতে রাজ্যেই কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়, দীর্ঘ বন্ধ্যা দশার পর বাংলা যেন শিল্পায়নের আলো দেখতে পায়। শিল্পের জন্যে প্রয়োজনীয় শান্তি শৃঙ্খলা, কম খরচে শিল্পায়নের সুযোগ এবং আর্থিক স্বনির্ভরতা ও প্রগতির নবযুগ। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরে লগ্নি নিয়ে দরবার করতে জ্যোতি বসু ফি বছর বিদেশে পাড়ি দিতেন। তার কিছু ফলবতী হতে দেখা গেলেও বেশিরভাগই হবে হচ্ছে করে কেটে গেছে আশায় আশায়। বাংলায় মিডিয়ার মিঠেকড়া থেকে তিক্ততম সমালোচনা বর্ষণের ইতিহাস এখনও অম্লান। পুরনো কাগজের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে সেকালে সরকারের শিল্পায়নের ঢক্কানিনাদ চাপা পড়েছে বারবারই সংবাদপত্রের তীব্র সমালোচনার কষাঘাতে। লগ্নি বা বিনিয়োগের মতো শব্দগুলো বদলে হল শিল্পায়ন বুদ্ধবাবুর আমলে। নির্বাচনী ইস্তাহারের ঘোষণা ও তার ভিত্তিতে বামফ্রন্টের পাওয়া ভোটের ম্যানডেট সর্বোচ্চ আসন দেওয়ার পর থেকেই পাহাড়ের চূড়া থেকে অবতরণের শুরু তাদের। চব্বিশ বছরে শিল্প নিয়ে মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছে অনেক, শিল্পোন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান “মৌ দাদা” নামে খ্যাত হয়েছেন, কিন্তু হলদিয়া পেট্রোকেম আর বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পর বাংলা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই। শেষ দশ বছরে শিল্পায়ন গল্প থেকে সত্যি হয়ে উঠছে বলে মনে করেছিল বাঙালি। কিন্তু সেই মনে করাটাই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল সিঙ্গুর থেকে সিঙ্গাপুরে। এবং বাম জমানার কফিনের শেষ পেরেক মনমোহন সরকারের দেওয়া নন্দীগ্রামের কেমিক্যাল হাব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পঁচিশ বছর ধরে বামবিরোধী গণ আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠার পথে যে স্ট্রিট ফাইটারের অভিধা পেয়েছিলেন তার পূর্ণাহূতি শুরু সিঙ্গুরে টাটাকে তিনফসলী জমি দেওয়ার বিরোধিতা থেকে। তারপর সালেম এবং সবশেষে নন্দীগ্রামের গুলিচালনা। সব দেওয়াল লিখন । নন্দীগ্রামে বিজেপির নির্বাচনী কালোয়াতি নিয়ে তৃণমূল-বিজেপির দ্বৈরথে সব ঐতিহাসিক সত্য প্রতিভাত ও প্রমাণিত। মমতাই তাঁর ঐতিহাসিক লড়াই লড়তে গিয়ে গত ভোটের সময় নন্দীগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্রের আদ্যন্ত মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। যাতে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক মিথ্যার মিথ কেটেছে।
এই পটভূমিতে দশবছর সরকার চালানোর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পায়নের কর্মসূচিকে ক্রমাগত জোরালো করে তুলেছেন। দুদিনের শিল্প সম্মেলনের সমাপ্তিতে কৃষির উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিল্পে বিনিয়োগের ওপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এবং বুধবার সম্মেলনের সূচনায় গৌতম আদানির উচ্ছসিত ঘোষণা শিল্পায়নের অ্যাজেন্ডা বেঁধে দিয়েছে। ২০০৭-০৮ এ রতন টাটার আরও আশা জাগানো বক্তব্যগুলো শিল্প বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে সিলমোহর দিয়েছিল। সুতরাং বাংলা ও বাঙালির মনে আশার সঙ্গে আশংকা জড়িত শিল্পায়ন নিয়ে।
কারণ, তখন বিরোধীরা কৃষিজমি বাঁচানোর জন্যে রামধনু জোট করে সরকারকে কোণঠাসা করেছে। সেই জোটের সঙ্গে সঙ্গেই কার্যত ভেস্তে যায় বাম সরকারের শিল্পায়নের প্রতিশ্রুতি। এবার অতীশতে আন্দোলনের নেতা হিসেবে মমতা যা বলেছিলেন সেই কথাই এখন বলছেন বিরোধীরা। আর সরকার যা বলতো সেটাই বলছে শাসক। কিন্তু ইতিবাচক ও নেতিবাচক চেনার ক্ষমতা রাখে বাংলার মানুষ । সেটা আর কেউ না বুঝলেও প্রধানমন্ত্রী বোঝেন। তাই নিজে হাজির হয়ে রাজনীতির মুখরোচক বিষয়বস্তু তৈরি না করে শিল্প সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য সফল করার পথে হাত বাড়িয়েছেন। এই হাত যে অদৃশ্য নয় তার প্রমাণ রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের আপ্লুত মুদ্রায় সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা এবং শরিরী ভাষা। এই ঘটনা থেকেই রাজভবনের রাজনীতি নতুন মোড় নেবে কিনা দেখার । বিশেষ করে দেখার বিষয় হল, শিল্পজগতে প্রধানমন্ত্রীর বেস্ট ফ্রেন্ড বা সবচেয়ে অনুগত আদানির প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের অক্ষরে অক্ষরে ছড়ানো ছেটানো মণিমুক্তো। কার্যত এই শিল্প সম্মেলনে আদানির দশ হাজার কোটির লগ্নি আশ্বাস বাংলাকে লগ্ন ভ্রষ্টা হওয়া থেকে বাঁচার সুযোগ দেবে আশা করা যায়। এই শুভ লগ্নে সংশয়ের মেঘ ভেবে লাভ নেই। বাংলাকে কেন্দ্র করে টাটা যে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের রথে চড়েছিলেন , রাজনৈতিক ঝড় তা উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল গুজরাতে। আজ উল্টোরথে চেপে গুজরাতের কর্পোরেটের সর্বোচ্চ মহারথী বাংলার মমতার কাছে নতজানু। সুতরাং ইতিহাসের প্রত্যাবর্তন না হলেও আবর্তন যে হয় এটাও তার প্রমাণ। মুখ্যমন্ত্রী যে আশার বাণী শুনিয়েছেন, আগামী দশ বছরে বাংলা সব রাজ্যের থেকে এগিয়ে যাবে, ফেব্রুয়ারিতে ফের শিল্প সম্মেলনের ডাক তাকে সিলমোহর দিতেই। এবার মোদি জমানার উপলব্ধি অনুযায়ী রাজনীতির পিছু পিছু অর্থনীতি এগোবে , না মনমোহন জমানার সূত্র মাফিক অর্থনীতিই রাজনীতিকে পথ দেখাবে , তা লক্ষ্য করার মতো বিষয়। কেন্দ্রীয় এজেন্সির মাধ্যমে বিরোধী রাজ্যকে সযুত করার অভিযোগ অনবরত উঠছে, সেই রাজনীতিই কায়েম থাকবে, না শিল্পায়নে মদত দিয়ে বাংলার মন জয় করবে কেন্দ্রীয় শাসকদল ? আদানির আগমন এরকম চমৎকার কিছু ভাবনার উপাদান রেখে গেল দুদিনের শিল্পযজ্ঞে।