আনিস খুন: বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে, পুলিশি তদন্তে আস্থা রেখে বুঝিয়ে দিল হাইকোর্ট
— প্রসূন আচার্য
ঠিক সাত দিন আগে রাতে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবের বাড়ি যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হটাৎ করেই। তার আগে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে একের পর এক রাজ্য সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রায় বা সিবিআই দিচ্ছিল হাইকোর্ট। মমতার সঙ্গে প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবের কী কথা হয়েছে, সেই সম্পর্কে আমরা, পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকেরা কিছুই জানি না। সরকারের তরফে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়েছে বলে আমি অন্তত জানি না। এখনও পর্যন্ত দেশ বা রাজ্যে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের সংবিধানের ধারা মত গনতন্ত্র চলছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, হাইকোর্ট এর বিচারপতি থেকে জেলা কোর্টের বিচারক সবাই আমার, আপনার মত নাগরিকের দেওয়া কর বা tax এর টাকায় মাইনে পান। এমনকি তাঁরা যে গাড়ি করে আদালত থেকে বিভিন্ন জায়গায় যান, দরকার বা দরকারে তার তেল থেকে ড্রাইভারের মাইনেও আমাদের টাকাতেই হয়। তাই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান বিচারপতির কী কথা হলো, তা জানার অধিকার আমাদের মত কর দাতা নাগরিকদের আছে। কারণ, আমরা কেউই রাজার প্রজা নয়। প্রধানমন্ত্রী থেকে আমি, একজন সাধারণ কলমজীবি, আইনের চোখে সবাই সমান। সংবিধান এ সেকথা স্পষ্ট করে লেখা আছে।
এত কথার বলার একটাই কারণ। আজ কিছুক্ষণ আগে হাইকোর্টের বিচারপতি রাজশেখর মান্থা আনিস খান হত্যায় রাজ্যের তৈরি করা সিট বা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমের উপরেই আস্থা রেখেছেন। নিহত আনিসের বাবা সালেম খান যে সিবিআই তদন্তের আবেদন করেছিলেন, আদালত তা খারিজ করে দিয়েছে। আদালত এ কাজ করতেই পারে। সেই জন্যই তো মানুষ বিচারালয়ের কাছে যায়। বিচারপতি যা বলবেন, সেটাই ফাইনাল।
বিচারপতির এই রায়ের উপরে আনিস খানের পিতা সালেম কতটা ভরসা রাখতে পারবেন, আদৌ পারবেন কিনা, সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার মত তাঁর আর্থিক সঙ্গতি আছে কিনা, সেই প্রশ্ন ভিন্ন।
বিচারপতি মান্থার রায়ের প্রতি কোনো সন্দেহ না রেখে এবং সিবিআই হলেই যে সাত তাড়াতাড়ি অপরাধী ধরা পড়বে, এমন আশা না করেও বলা যায়, এই যে বিগত প্রায় চার মাস ধরে সিট তদন্ত করছে, তাতে কি আদৌ পরিষ্কার হয়েছে, আনিসের মৃত্যু কি আসলে খুন? নাকি আত্মহত্যা ? নাকি দুর্ঘটনা?
একটা বিষয় কিন্তু রাজ্যের আম জনতার কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। পুলিশ এবং সিভিল ভলেন্টিয়াররা মিথ্যে কথা বলে জোর করে, বেআইনি ভাবে , সালেম খানের বাড়ি গিয়ে, তাঁর বাধা উপেক্ষা করে আনিসকে খোঁজার নামে ছাদে যায়। এর কিছুক্ষণ পরে, ধপ করে ছাদ থেকে কিছু পড়ার শব্দ হয়। পুলিশ ছাদ থেকে নেমে চলে যায়। কোনও কিছু না বলেই। তারপরে দেখা যায়, আনিসের রক্তমাখা দেহ নিচে মাটিতে পড়ে আছে।
এই রাজত্বে যেখানে তৃণমূলের ব্লকের চুটকো নেতার কথা ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না, সেখানে কেন, কি কারণে, কি করতে অন্য থানার পুলিশ ওখানে গেল, কেন আনিসের মৃত্যুর পরে বার বার থানায় ফোন করা হলেও পুলিশ এলো না পরের দিন সকাল পর্যন্ত, এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
সিভিল ভলেন্টিয়াররা তো পুলিশ নয়! মোদি যেমন অগ্নীবীর এর মাধ্যমে দলের অনুগত ঠিকা সেনা তৈরি করতে চাইছেন, সেই রকমই সিভিল ভলেন্টিয়ারররা শাসকের নির্দেশ পালনের পাশাপাশি পুলিশকে সাহায্যকারী হিসেবে নিযুক্ত কিছু ঠিকা কর্মী। তাঁদের কোনও অধিকারই নেই কোনো সার্চ বা অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট ছাড়া কারো বাড়ি যাওয়া। এমনকি ওয়ারেন্ট নিয়েও তারা কারও বাড়ি যেতে পারে না। কিন্তু সেটাই হয়েছে এক্ষেত্রে।
যে পুলিশ একজন দরিদ্র মুসলিম পরিবারের প্রতি এই ধরনের জঘন্য কাজ করেছে, এবং মৃত আনিসের বিরুদ্ধে নানা সাজানো অভিযোগ তুলে সেই কাজকে জাস্টিফাই করতে চাইছে, সেই পুলিশের তদন্তের উপরে কি করে বিচারপতি মান্থা আস্থা রাখলেন তা বোধগম্য হল না। কারণ, পুলিশের মাথা এক জনই, যাঁরা ওই রাতে আনিসের বাড়ি গিয়েছিল এবং যাঁরা তদন্ত করছেন।
হিন্দিতে একটা কথা আছে। উল্টা চোর কোতোয়াল কো ডাঁটে। অর্থাৎ কোথায় পুলিশ চোরকে ধমকাবে, উল্টে চোর পুলিশকে ধমকাচ্ছে! মান্থা সাহেব, ব্যাপারটা তেমন হয়ে গেল না? এই রায়ের পরে যদি রবীন্দ্রনাথের কথা ধার করে কেউ বলেন, “বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে, ” খুব কি মন্দ হবে?
আর একটা কথা। এই রায়টা এল ওই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারের ঠিক সাত দিনের মাথায়। যেখান আনিসের বৃদ্ধ বাবা সব প্রলোভন এমনকি রাজ্য সরকারের দূত বলে পরিচয় দেওয়া এক প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের মালিকের প্রস্তাব ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে বার বার টিভির সামনে একটাই কথা বলছেন, রাজ্যের পুলিশ তাঁর ছেলেকে মেরে ফেলেছে। তাই তাঁর তাদের তদন্তের উপর কোনও ভরসা নেই। তিনি চান সিবিআই। কিন্তু হাইকোর্ট সিবিআই দিল না।
পরিশেষে একটা কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আজ যিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তিনি ১৯৮৪ সাল থেকে ২০১১ সাল, এই সুদীর্ঘ ২৭ বছরে এই ধরনের ঘটনায় ১০৮ বার তো বটেই, কত বার যে সিবিআই তদন্ত চেয়েছেন, তাই নিয়ে রীতিমত গবেষণা করা যায়। একটা আনিসের মৃত্যু, সেই কথাই আবার মনে করিয়ে দিল।
ফেসবুক থেকে সংগৃহীত । Pic courtesy: The Statesman