NewsPoliticsSambad MatamatWorld

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিতর্ক: একটি বাস্তব সমীক্ষা

নিউইয়র্ক।। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম বিতর্ক হয়ে গেলো মঙ্গলবার ২৯শে সেপ্টেম্বর ২০২০। কে জিতেছেন এই বিতর্কে? কেউ বলছেন, ট্রাম্প জিতেছেন, কেউ বলছেন, বাইডেন জিতেছেন। আসলে কেউ জেতেননি, আমেরিকা হেরেছে। মার্কিন ইতিহাসে এমন নিন্মমানের বিতর্ক এই প্রথম। উভয় প্রার্থী আক্রমণাত্মক হবার প্রস্তুতি নিয়েই লাইভে এসেছেন, তবে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। উভয় প্রার্থী একে অপরকে কথা বলতে বাধা দিয়েছেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আক্রমন করেছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার জো বাইডেনের কথার ওপর কথা বলতে চেষ্টা করেছেন। রাগে এক পর্যায়ে বাইডেন বলেই বসেন, ‘ইউ স্যাট আপ ম্যান’। মডারেটর দু’জনকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন এবং ট্রাম্পকে বলেন, আপনি বেশি বাঁধা দিচ্ছেন। বাইডেন ফাঁকে ফাঁকে ক’বার ট্রাম্পকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলেছেন এবং একবার ‘ক্লাউন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ট্রাম্প বারবার বাইডেনকে বাঁধা দিয়েছেন বটে, কিন্তু বাইডেন-এর কিছু মন্তব্য মোটেও প্রেসিডেনশিয়াল ছিলো না?

প্রথম বিতর্ক হয়েছে ক্লিভল্যান্ডে। আরো দু’টি বিতর্ক আছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিতর্ক ১৫ এবং ২২ অক্টবর ২০২০। প্রশ্ন উঠেছে, বিতর্ক কি হবে? অথবা এমন বিতর্কের কি প্রয়োজন আছে? একজন টিভি এঙ্কর মন্তব্য করেছেন, বিতর্ক থেকে বাইডেন তেমন সুফল পাবেন না! কিছু মিডিয়া চাচ্ছে, বাইডেন বিতর্ক থেকে সরে দাঁড়াক। বাইডেন ক্যাম্পাইন অবশ্য বিতর্কের পক্ষে। ট্রাম্প ক্যাম্পেইন কিছু না বললেও বোঝা যায়, তাঁরা বিপক্ষে নয়। একটি মাত্র ভাইস প্রেসিডেন্ট বিতর্ক হবে বুধবার ৭ই অক্টবর উটাহ ইউনিভার্সিটিতে। ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং ডেমক্রেট ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সিনেটর কমলা হ্যারিস এতে অংশ নেবেন। প্রথম বিতর্ক নিয়ে এ মুহূর্তে মার্কিন মিডিয়ায় চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে এটি আলোচনার বিষয়। কারণ যাই হোক, পাল্লা ট্রাম্পের বিপক্ষে। তাই হয়তো ট্রাম্প মডারেটরকে সরাসরি বলেছেন, ‘আমি ফক্স নিউজ এবং বাইডেনের বিরুদ্ধে বিতর্ক করছি’। তিনি অভিযোগ করেন, মডারেটর জো বাইডেনকে ফেভার করেছেন। যাঁরা বিতর্ক দেখেছেন, তাঁরা এটি স্বীকার করবেন। 

বিতর্কের শুরুতে ট্রাম্পকে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিলো এবং জো বাইডেনকে মনে হচ্ছিলো ‘জ্বর থেকে উঠে এসেছেন’। বাইডেন বেশ ক’বার আমতা আমতা করেছেন। মাঝে-মধ্যে তাঁর কথা আটকে যাচ্ছিলো। শুরু থেকেই ট্রাম্প ছিলেন আক্রমণমুখী এবং সম্ভবত: তাঁর স্ট্রেটেজি ছিলো প্রতিদ্ধন্ধী জো বাইডেনকে রাগিয়ে দেয়া। হয়তো তিনি কিছুটা সফল হয়েছেন, যখন বাইডেন বলে উঠেন, ‘ইউ স্যাট আপ ম্যান’। এটি অভদ্রতা, বেমানান। ট্রাম্প হয়তো ইচ্ছে করেই বাইডেন পুত্র হান্টার বাইডেন-র প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন, মস্কোর মেয়র তাঁকে সাড়ে তিন মিলিয়ন ডলার দিয়েছেন কেন? বাইডেন তা অস্বীকার করেন। পরে সুযোগ বুঝে পুত্রের প্রশংসা করে বলেন, হান্টার বাইডেন মিলিটারিতে কাজ করেছেন, দেশের সেবা করেছেন। ট্রাম্প সুযোগ পেয়ে বলেন, মিলিটারি থেকে তাকে অসম্মানজনক ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে। ট্রাম্প বলেন, এরপর হান্টার বাইডেন অনেকদিন বেকার ছিলেন এবং জো বাইডেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট হবার পর কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই তেল কোম্পানীর এক্সিকিউটিভ হয়ে যান এবং রাশিয়া, চীন থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার রোজগার করেন। 

কোভিড-১৯ প্রসঙ্গে জো বাইডেন এত মৃত্যু’র জন্যে ট্রাম্পকে দায়ী করেন। ট্রাম্প বলেন, বাইডেন ক্ষমতায় থাকলে ২লক্ষ নয় ২০লক্ষ মানুষ মারা যেতো। তিনি বলেন, বাইডেন ও রেডিক্যাল ডেমক্রেটরা আমেরিকায় লক-ডাউন’ করে রাখতো, অর্থনীতি খুলতো না, দেশকে ধ্বংস করে দিতো। তিনি কোভিড-১৯-কে ‘চায়না প্লেগ’ বলে মন্তব্য করেন। ট্রাম্প করোনার মধ্যে বড়বড় সমাবেশ করেছেন-এ প্রসঙ্গ টেনে জো বাইডেন ট্রাম্পকে ‘ইরেস্পন্সিবল’ বলে মন্তব্য করেন। ট্রাম্প উত্তরে বলেন, এমন জনসমাগম পেলেও আপনিও সমাবেশ করতেন, কিন্তু আপনার শো-তে তো মানুষ আসেনা, আপনি তো তিনজনের সামনে বক্তিতা দেন? ‘হেলথ কেয়ার’ প্রসঙ্গে জো বাইডেন বলেন, ‘হি ডাজ নট হ্যাভ এ প্ল্যান’। এ সময়ে ট্রাম্প কিছু বললে, বাইডেন আবার বলেন, ‘হি ডাজ নট নো হোয়াট হি ইজ টকিং এবাউট’? এক পর্যায়ে বাইডেন আরো বলেন, ‘এভরি বডি নোজ হি ইজ এ ল্যায়ার’। এ সময়ে ট্রাম্প উচ্চস্বরে বাইডেনকে ঠেকাতে সচেষ্ট ছিলেন। প্রসঙ্গান্তরে ট্রাম্প বলেন, ওবামাকেয়ার ইজ এ ডিজাষ্টার। তিনি জোরের সাথে এটি বাতিলের সংকল্প ব্যক্ত করেন। এটি ঠিক ট্রাম্প কথার জোরে বাইডেনকে থামাতে চেয়েছেন, কিন্তু বাইডেন ভদ্রতা দেখতে ব্যর্থ হয়েছেন। 

মডারেটর ‘ফিলিবাস্টার’ সংক্রান্ত একটি সরাসরি প্রশ্ন করলে জো বাইডেন তা উত্তর দিতে অস্বীকার করেন। মূলত: বাইডেন চেষ্টা করেছেন, মডারেটরের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে নিজের কথা বলতে এবং তিনি সরাসরি ভোটারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। এসময় আবারো তার কথা আটকে যায়! ট্রাম্পের সাথে বিতর্কে বাইডেন আবারো বলেন, ‘ইট ইজ হার্ড টু টক উইথ হিজ ক্লাউন’। আইন-শৃঙ্খলা প্রশ্নে ট্রাম্প তাঁর প্রসাশনের প্রশংসা করেন। বাইডেন এ সময় বাধা দিলে ট্রাম্প তার প্রতিদ্ধন্ধীকে প্রশ্ন করেন, ‘একটি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাম বলুন যারা আপনাকে সমর্থন জানিয়েছে? বাইডেন উত্তর না দিলে তিনি আবারো একই প্রশ্ন করেন। বাইডেন উত্তর দিতে পারেননি, নীরব থেকেছেন। মডারেটর সরাসরি ট্রাম্পকে ২০১৬/২০১৭ সালে ৭৫০ ডলার ফেডারেল ট্যাক্স দিয়েছেন রিপোর্ট সত্য কিনা প্রশ্ন করলে ট্রাম্প বলেন, আমি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ট্যাক্স দিয়েছি। তিনি এ সময় ৩৭মিলিয়ন ডলার ট্যাক্স দেয়ার কথাও উল্লেখ করেন। মডারেটরের প্রশ্নবাণ ট্রাম্পকে জর্জরিত করলেও তিনি জো বাইডেনকে তেমন কঠিন প্রশ্ন করেননি, এমনকি হান্টার বাইডেন প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন। 

উভয় প্রার্থী আক্রমণাত্মক খেলেছেন, যা ইতোপূর্বে ভোটার দেখেনি। উত্তেজনাপূর্ণ এ বিতর্কে ট্রাম্প এক পর্যায়ে ১৯৯৪ সালে বাইডেনের কৃষ্ণাঙ্গ বিরোধী মন্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেন? স্মর্তব্য যে, অনেক কৃষ্ণাঙ্গ বাইডেন-কে এ কারণে অপছন্দ করেন, যদিও কালো ভোট তিনি বেশি পাবেন। ভোটার তাঁকে কেন পুন্:নির্বাচিত করবে এমন এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, আমি ৪৭ মাসে যা করেছি, জো বাইডেন ৪৭ বছরে তা করতে পারেননি। বাইডেনকে সমার্থক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে তিনি ট্রাম্পের ব্যর্থতা তুলে ধরে তাঁকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। বিতর্কের এক পর্যায়ে স্মার্টনেস নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, ট্রাম্প প্রতিদ্ধন্ধী বাইডেনকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘ডোন্ট ইভেন ইউজ দি ওয়ার্ড স্মার্ট টু মী’! এ প্রসঙ্গে বাইডেনকে তিনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে আক্রমন করেন। ফক্স নিউজের মডারেটর ক্রিস ওয়ালেস স্পষ্টত: বিতর্ক নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিতর্কে উভয় প্রার্থীর প্রতি ভোটার হয়তো বিরক্ত, তাঁরা কাউকে ভোট দিতে আগ্রহী নাও হতে পারে? ট্রাম্প হয়তো তাই চেয়েছেন, ভোটারকে নিরুৎসাহী করা হয়তো তাঁর লক্ষ্য থাকতে পারে? সুপ্রিমকোর্টে নুতন বিচারক প্রসঙ্গ ট্রাম্প এক কথায় ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, আমি ৩ নয় ৪ বছরের জন্যে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট।  

বিতর্কে পলিসি নিয়ে তেমন কথা শোনা যায়নি, গালমন্দ শোনা গেছে। একজন রাজনৈতিক কমেন্টেটর ফ্র্যাঙ্ক লুঞ্জ সিএনবিসি-কে বলেছেন, মডারেট ক্রিস ওয়ালেস টয়লেট পেপারের মত দুই প্রার্থীর নোংরা পরিষ্কার করতে চেয়েছেন। কিন্তু উভয় প্রার্থী এসেছেন ফাইট করতে, পলিসি নিয়ে কথা বলতে নয়? নিউজম্যাক্স বলেছে, কিছু মিডিয়া বলেছে, বিতর্কে ট্রাম্প হেরেছেন, আসলে কি তাই? ট্রাম্প তো ঠিকই বলেছেন, তিনি শুধু বাইডেন নন, ফক্সের ক্রিস ওয়ালেসের (মডারেটর) সাথেও বিতর্ক করছেন। ট্রাম্পের প্রতি মডারেটরের প্রশ্ন ছিলো শত্রুতামূলক, কিন্তু বাইডেনের জন্যে প্রশ্ন ছিলো সহজ। ক্রিস ওয়ালেস ট্যাক্স প্রশ্নে ট্রাম্পকে চেপে ধরেছেন, কিন্তু হান্টার বাইডেনের ইউক্রেনে মিলিয়ন ডলার ব্যবসা বা চিনে দেড় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিলোনা। বিতর্কে ট্রাম্পকে বহিরাগত হিসাবে ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়েছে, কারণ তিনি এদের শর্তে রাজি নন। কারণ, ট্রাম্প পুরানো ব্যবস্থা ভেঙ্গে ওয়াশিংটনে অনেক নুতন, যুগোপযোগী, ইতিবাচক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন এবং আরো করতে চান, যা এদের অ-পছন্দ? প্রশ্ন হলো, বিতর্কে কি ভোট বাড়ে বা কমে? মনে হয়না। (Pic Courtesy indianexpress.com)

Leave a Reply

Your email address will not be published.