গরম ট্রাম্প হটাৎ নরম হলেন কেন?
উক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে বিধ্বস্ত হয়েছে স্বীকার করার পর হাজার হাজার ইরানী তেহরানের রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভে ফেটে পরে। এতকাল তাঁরা শ্লোগান দিয়েছে, ‘ডেথ উইথ আমেরিকা’, এখন শ্লোগান দিচ্ছে, ‘মোল্লাতন্ত্র নিপাত যাক’। জনতা ইরানের প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনী’র পদত্যাগ দাবি করছে। তাঁরা বলছে, শত্রূ বাইরে কোথায়, শত্রূ তো ঘরের ভেতরে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিক্ষোভকারীদের সমর্থন জানিয়েছেন এবং তাদের ওপর পুলিশী অত্যাচার বন্ধের আহবান জানিয়ে বলেছেন, ‘ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়াচিং’। ইরানী পুলিশ বিক্ষভকারীদের ওপর গুলি ছুড়ছে, এ ভিডিও ইতিমধ্যে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। ট্রাম্প আরো বলেছেন, ইরান আলোচনা করতে চাইলে তিনি বিবেচনা করবেন, কিন্তু ‘নো নিউক্লিয়ার ওয়েপন’ এবং ‘বিক্ষাভকারীদের হত্যা করা চলবে না। মার্কিন প্রশাসন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানে সরকার পরিবর্তনের কথা ভাবছে না। মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে বিশ্ব পরিস্থিতি এখন অনেক ঠান্ডা। যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়ানো গেছে। তবে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শেষ হয়ে যায়নি। জেনারেল কাসেম সুলেইমানি হত্যার পর ইরান বেশ ‘ফাও’ হুমকি-ধামকি দিয়েছে। এরপর যা ঘটেছে, তা অনেকের মতে ‘পাতানো খেলা’। ইরান ২২টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার একঘন্টা আগে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছিলো বলে জল্পনা রয়েছে; বলা হচ্ছে, তাই কেউ মরেনি, ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ইরান বলেছে, সৈন্য মারা তাদের লক্ষ্য ছিলোনা। যদিও জনগণকে ধোঁকা দিতে ৮০জন মার্কিন সৈন্য নিহত ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি’র ভুয়া খবর প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের কিছু মিডিয়া এবং কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা ইরানের প্রপাগান্ডা ছাপিয়েছে। বিশ্বের কোন মিডিয়া কোন মৃত্যু’র খবর দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর আরো ব্যাপক অবরোধ আরোপ করেছে। ইরানের ওপর ট্রাম্প যাতে পুনরায় আক্রমন করতে না পারেন সেই লক্ষ্যে মার্কিন কংগ্রেস একটি ‘নন-বাইন্ডিং’ বা ঐচ্ছিক প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। বলা হচ্ছে, জেনারেল সুলেইমানি হত্যার পেছনে ভেতরের কারো হাত ছিলো তাই সবগুলো মিসাইল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। তাই গরম ট্রাম্প হটাৎ নরম হয়ে গেছেন। খবরের পেছনের খবরে ট্রাম্প খুশি হয়েছেন। তবে ট্রাম্পের নরম হওয়ার পেছনে মার্কিন ‘কংগ্রেস’ ও ‘সিনেট’ কার্যকরী ভূমিকা ছিলো। ট্রাম্প বুধবার (০৮ই জানুয়ারি ২০২০) সকালে জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের জবাবে অবরোধ আরোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। ট্রাম্প বলেছেন, ইরানি হামলায় মার্কিন বা ইরাকী কোন সেনা হতাহত হয়নি। দৃশ্যত, ইরান পিছুটান দিয়েছে। এটা সবার জন্যে ভালো। ট্রাম্প ওবামাকে একহাত নিয়ে বলেছেন, ওবামা ইরানকে যে অর্থ দিয়েছে,
তা দিয়ে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার বক্তব্যে সাবেক ছয়জন প্রেসিডেন্টকে মৃদু ভৎসনা করে বলেছেন, ১৯৭৯ সন থেকে এ পর্যন্ত তারা ইরানের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সহ্য করেছেন, আর নয়? ওবামা’র পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরী বলেছেন, আমরা ইরানকে সামান্য অর্থ দিয়েছি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শনিবার (১১জানুয়ারি ২০২০) নিউজম্যাক্স’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, ইরানী জেনারেল কাসেম সুলেইমানি বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্রসহ চারটি দূতাবাস দখল করতে চেয়েছিলো, তাই তাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তিনি বিশদ ব্যাখ্যা দেননি। মার্কিন প্রশাসন বলেছে, মার্কিন স্বার্থ ও সেনার ওপর আসন্ন হুমকীর কারণেই ঐ নির্দ্দেশ। বিদেশমন্ত্রী মাইক পম্পিও’র একই সুর। নিউজম্যাক্স ট্রাম্পকে ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের আহবান সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ইরাকি নেতারা প্রকাশ্যে যে কথা বলছেন, একান্তে আমাদের সেই কথা বলছেন না! ওয়াশিংটন
টাইমস বলেছে, যেদিন যুক্তরাষ্ট্র জেনারেল সুলেইমানিকে হত্যা করেছে, একই সময়ে তাঁরা ইয়েমেনে অপর এক ইরানী কুদস ফোর্স সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিলো, সফল হয়নি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মার্কিন লক্ষ্য ছিলো ইরানের ইসলামী রিভ্যুলুশনারি গার্ড কর্পস’র ওপর বড় ধরণের চাপ প্রয়োগ? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, আমাদের বিশ্বে সন্ত্রাসী’র কোন জায়গা নাই।চাপের কাছে হার মেনে ইরান শেষপর্যন্ত স্বীকার করে যে, এর সৈন্যরা ‘অনিচ্ছাকৃতভাবে’ ইউক্রেনের ১৭৬ যাত্রীবাহী বিমানটি ভূপাতিত করেছে। ইরান এটিকে ‘হিউম্যান এরর’ বলে অভিহিত করেছে। বিমানে ১৩০জন ইরানি নাগরিক ছিলেন। ‘গাধা জল খায়, তবে ঘোলা করে’, ইরানের বেলায় তা-ই সত্য হলো। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো শনিবার (১১ জানুয়ারি ২০২০) বলেছেন, ইরানকে যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংসের দায় বহন করতে হবে। টরন্টোয় বাংলাদেশী সাংবাদিক সওগত আলী সাগর সঠিক প্রশ্ন তুলেছেন, মার্কিন মিসাইল ভেবে ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমানে ইরানিরা একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে, এরপর এটি ‘হিউম্যান এরর’ হয় কি করে? পূর্বাহ্নে জাষ্টিন ট্রুডো বলেছিলেন, ইরান থেকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইউক্রেনের বিমান বিধ্বস্ত হয়। বিমানে ৬৩জন কানাডীয় যাত্রী ছিলো। ট্রাম্প বলেছেন, কেউ হয়তো ভুল করে থাকবেন। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, ইরানের এয়ার ডিফেন্স সিষ্টেমের কারণে বিমানটি ধ্বংস হয়েছে। ইরান এসব দাবি অস্বীকার করে এবং ব্ল্যাক বক্স ফেরত দেয়না? গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস নামের একটি নিউজ পোর্টাল বলেছে, ভুলক্রমে ১৭৬জন হত্যা, ভাগ্য ভালো যে ইরানের হাতে পারমানবিক অস্ত্র নেই? ট্রাম্প তাই বলেছেন, ইরানকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হতে দেবোনা। ক্লারিয়ান প্রজেক্ট নিউজ পোর্টাল বলেছে, ইরানের প্রতিশোধ নাটক কি সাঁজানো ব্যর্থতা? মুখরক্ষার এই রাস্তা নিলো ইরান? এটি আরো বলেছে, ট্রাম্পের কৌশল কাজ করেছে, ইরান পিছুটান দিয়েছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেত্তনাহু বলেছেন, ইসরাইলে হামলা হলে ইরানের ওপর ধ্বংসাত্বক আক্রমণ চালাবো। ভারত পারস্য উপকূলে যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করেছে; বলেছে, সামুদ্রিক বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা পরিকাঠামো রক্ষায় এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দিল্লিতে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ভারত যদি ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি স্থাপনে মধ্যস্থতা করে ইরান তাতে সম্মত আছে। টাইম ম্যাগাজিন বলেছে, ট্রাম্পের বক্তব্য হচ্ছে, ইরান পিছুটান দিয়েছে। ইতিহাস বলে, বিষয়টি ততটা সহজ নয়! ইরাক তাঁর ভূখণ্ডে ইরানী ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের তীব্র প্রতিবাদ করেছে। ইরাক ভয় পাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সংঘাতে ‘ইসলামিক ষ্টেট (আইএস) না আবার ফিরে আসে? যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েক ঘণ্টা পর এক টুইটে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ লিখেছেন, ‘আমাদের জনগণ ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ওপর যে ঘাঁটি থেকে কাপুরুষোচিত সশস্ত্র হামলা করা হয়েছে, জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদ অনুসারে আত্মরক্ষায় ইরান সেখানে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে এর সমাপ্তি টেনেছে। আমরা যুদ্ধ বা উত্তেজনা বাড়াতে চাই না। ইরান বলেছে তাঁরা আর আক্রমণ করবে না! এরআগে ইরান মঙ্গলবার (০৭ জানুয়ারী ০২০) ইরাকের দু’টি মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে ২২টি ব্যালাষ্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। পেন্টাগন এই হামলার কথা স্বীকার করে বলেছে, মিলিটারি সতর্ক ছিলো। ক্ষয়ক্ষতি সামান্য। সামরিক সূত্র বলেছে, ইরাকের পশ্চিমে ‘আল-আসাদ’ মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে ৬টি রকেট পড়েছে। আক্রান্ত অপর ঘাঁটি হচ্ছে, ‘ইরবিল’। হোয়াইট হাউস বলেছে, পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ইরানী ষ্টেট মিডিয়া ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের কথা স্বীকার করেছে। আইআরজিসি (ইরানিয়ান রিভ্যুলুশনারি গার্ড কর্পস) বলেছে, তাদের ওপর পাল্টা আঘাত হলে তাঁরা দুবাই ও ইসরাইলী শহর ‘হাইফা’ আক্রমণ করবে। রাজনৈতিক মহল বলছেন, নিহত জেনারেল সোলেইমানি গত চল্লিশ বছর ইরানী নেতৃবৃন্দকে ভুল বুঝিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রূ বানিয়ে রেখেছিলো, তার মৃত্যু’র পর দিন পাল্টাবে। মার্কিনিরা ১৯৭৯ সালের ৫২জন পণবন্দির কথা ভুলেনি। আজ হোক বা কাল হোক যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতিশোধ নেবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরানের দখলে থাকা হরমুজ প্রণালীর ৩০মাইল জলপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ। ইউরোপের তেল ও গ্যাস লাইনের নিরাপত্তাও দরকার। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় এলে সেই সম্ভবনা বাড়বে, এবং তিনি নির্বাচিত হবার সম্ভবনা প্রচুর। মতামত লেখকের নিজস্ব-সমপাদক)