FemaleGeneralIndiaNewsSambad Matamat

বাল্যবিবাহ রুখতে আরও কৈলাশ সত্যার্থী চাই : স্মৃতি ইরানি

শুভাশিস ব্যানার্জী, নয়া দিল্লি 

এ এক অন্য যুদ্ধের কাহিনী। মঞ্চে আছেন নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত একজন, সঙ্গে রয়েছেন এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও। তবু অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করছে এক দঙ্গল মেয়ে। তাদের কেউ বালিকাবেলায়, কেউ বা সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে। এই এক ব্যতিক্রমী দৃশ্যপটই বলে দিচ্ছিল, হয়তো এখানে লড়াইয়ের অতীত প্রেক্ষাপট আলাদা।  

      এবং বাস্তবেই, অতীতের সেই রিলশটে আছে অসম সংগ্রামের একের পর এক ছবি। ছোট বয়সেই নিজের আর অন্য অনেক মেয়ের অকাল বিবাহ রুখে দিয়েছে এই মেয়েরা। বাবা-মায়ের রাগ, পরিবারের ‘বুজুর্গ’দের ধমক ধামক আর সমাজের কড়া ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে নিজের বিয়ে আটকে দিয়ে, স্কুলে যেতে চেয়েছিল এই মেয়েরা। তাদের সেই জেদের কাছে অবশেষে হারও মানতে হয়েছে সবাইকে। রাজস্থানে, ছত্তিশগড়ে কিংবা হরিয়ানায় এদের হাতেই থমকে গেছে অনেকগুলি বাল্যবিবাহ। ‘ন্যাশনাল কনসালটেশন অন চাইল্ড ম্যারেজ ফ্রি ইন্ডিয়া’র অনুষ্ঠানে এই খুদে বীরাঙ্গনাদের হাতেই সেজন্য উদ্বোধনী প্রদীপ জ্বালানোর দায়িত্ব তুলে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন্দ্রের নারী ও শিশুকল্যান মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি এবং নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত কৈলাশ সত্যার্থী। 

      স্মৃতি সর্বভারতীয় পরিচিত নাম। শিশুদের নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে দেশে ও আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিতি রয়েছে কৈলাশেরও। কিন্তু কৈলাশের কাজ ছাপিয়ে গেছে তার নামকে। বচপন বাচাও আন্দোলনের নামের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা জানেন, শিশু শ্রমের গভীর অন্ধকার গর্ত থেকে শত শত বাচ্চাকে টেনে তোলা, তাদের পুনর্বাসনে জন্য ছোটাছুটি, চাইল্ড ট্র্যাফিকিং বা শিশু পাচার রুখতে নিরন্তর যুদ্ধ চালানো এবং বাচ্চাদের যাবতীয় অধিকার রক্ষার জন্য সুদীর্ঘদিন, ১৯৮০ সাল থেকে মাঠে ময়দানের মাটি কামড়ে কাজ করে আসছে বচপন বাচাও আন্দোলন নামের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি। এটি কৈলাশ সত্যার্থীরই হাতে গড়া। শিশু অধিকার নিয়ে নিরলস কাজের স্বীকৃতে ২০১৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন সত্যার্থী। পরে তাঁর নামেই গড়ে উঠেছে কৈলাশ সত্যার্থী চিলড্রেন্স ফাউন্ডেশন।  

      শিশু শ্রমিকদের উদ্ধার করা, বাচ্চাদের শিক্ষার অধিকার রক্ষা, যৌন হেনস্থা ও পাচারের হাত থেকে শিশুদের বাঁচানোর জন্য দশকের পর দশক কাজ করার মাঝে কৈলাশরা দেখেছিলেন আর্থ সামাজিক কাঠামোয় বাচ্চাদের জীবনে প্রভাব ফেলা আরেকটি দিক। বাল্যবিবাহ।  আর সেই বিষয়টি নিয়েই গত বছরের অক্টোবরে সারা দেশ জুড়ে এক অভূতপূর্ব অভিযানে নেমেছিল সত্যার্থীর নেতৃত্বাধীন এই দুটি সংগঠন। ২৬টি রাজ্যের ৩১৩টি জেলাতে ৭৬,৩৭৭ মহিলা নেত্রীকে সাথে নিয়ে সত্যার্থীরা ১৬ অক্টোবরে প্রায় দু’কোটি মানুষের এক বিশালাকার সচেতনতামূলক প্রচার অভিযানে নেমেছিলেন। বাল্যবিবাহ-রোধী আন্দোলন শুরুর ওই পরিপ্রেক্ষিতের আবহেই দিন কয়েক আগে দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাবে চাইল্ড ম্যারেজ ফ্রি ইন্ডিয়া গড়ার লক্ষ্যে জাতীয় স্তরের এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হল। স্মৃতি ছিলেন মুখ্য অতিথি, কৈলাশ পৌরহিত্য করেছেন সেই সভাতে।  

      সামাজিক কুপ্রথা বাল্যবিবাহ ঠেকাতে আইন আছে, তার রূপায়নের পথও জানা আছে রাজ্যগুলির। তবু কোন এক নিভৃত কারনে অসমের মত এক-আধটি রাজ্য ছাড়া অগ্রনী সক্রিয়তা দেখিয়ে নাবালকদের বিয়ে রুখতে তেমনভাবে এগিয়ে আসেনি কোন রাজ্যই। অসমে বাল্যবিবাহের বিরোধিতায় জানুয়ারি থেকে ধরপাকড় অভিযান শুরু হয়েছে রাজ্যজুড়ে। শিশুদের অধিকার রক্ষায় দেশের শীর্ষ মঞ্চ, ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রোটেকশন অফ চাইল্ড রাইটস নাবালক বিবাহ রুখতে অসমের নেওয়া কড়া পদক্ষেপের প্রশংসা করে এধরনের পথ অনুসরন করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিল অন্য রাজ্যগুলিকে। তবে স্বামীদের গ্রেফতারির ফলে বালিকা বধূরাই সঙ্কটে পড়ছেন এবং বাল্যবিবাহে জড়িত থাকার অপরাধে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করার বদলে শিক্ষা ও সমাজ সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা অনেক বেশী জরুরী বলে বিরোধী শিবিরগুলি থেকে মতও উঠে এসেছে অসমকে কেন্দ্র করে। দেশে এধরনের মানবিক সমস্যার সমাধানে গ্রেফতার হওয়া স্বামীদের অবর্তমানে তাদের বালিকা বধূদের আর্থিক ও আইনী সহায়তা দেওয়া এবং তাদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা নিতে সবাইকে আবেদন জানিয়েছে কৈলাশ সত্যার্থী চিলড্রেন্স ফাউন্ডেশন। 

      দেশে এখন ২০ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে বয়সী এমন ২৩ শতাংশ মহিলা আছেন যারা নাবালিকা অবস্থাতেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছেন। সেই সংখ্যা ২০২৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশে এবং তার পরের পাঁচ বছরে শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে কৈলাশ সত্যার্থী চিলড্রেন্স ফাউন্ডেশন বা কেএসসিএফ। কনস্টিটিউশন ক্লাবের অনুষ্ঠানে একথা জানিয়ে সত্যার্থী বলেন, সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাল্যবিবাহের শিকারদের পুনর্বাসন, আর্থিক সহায়তা ও আইনী সাহায্য দেওয়ার প্রয়োজন আছে। কৈলাশের পরে কি-নোট ভাষণ দিতে উঠে স্মৃতি ইরানি বলেন, এই সামাজিক অপরাধকে সম্পূর্ন নির্মূল করতে হবে আমাদের সবাইকে মিলে। বাল্যবিবাহকে ইতিহাসে পরিণত করা হবে বলে সেদিন ঘোষনা করেছেন কেন্দ্রের নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি জুবিন ইরানি। তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ রোধের অভিযানে কৈলাশ সত্যার্থী চিলড্রেন্স ফাউন্ডেশন বা কেএসসিএফের পাশে থাকবে কেন্দ্রীয় সরকার। বাল্যবিবাহের মত কুপ্রথাকে অবলুপ্ত করতে সকলকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার জন্য আবেদন জানান স্মৃতি। তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ অপরাধ এবং আমাদের এই সামাজিক অভিশাপকে পুরোপুরি শেষ করতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে বাল্যবিবাহকে ২৩ শতাংশ থেকে শূণ্যে নামিয়ে আনা হবে। সরকার এব্যাপারে দায়বদ্ধ। তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে আইন আছে এবং আইন তার কাজও করছে। তবে এই কুপ্রথাকে পরাজিত করতে সরকারের সঙ্গে সাধারন মানুষকে, বিশেষত পুরুষদের এগিয়ে আসতে হবে। স্মৃতি সেদিনের অনুষ্ঠানে শিশু রক্ষায় নোবেলজয়ী কৈলাশ সত্যার্থীর ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন। মন্ত্রী বলেন, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়ার জন্য আমাদেরকে আরও অনেক কৈলাশ সত্যার্থী গড়ে তুলতে হবে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published.