ভারতে মমতার অটুট অঙ্গীকার
দেবারুন রায়
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের প্রাক্কালে মনে হচ্ছে, তিস্তার জলের মমতা না পেলেও ভারত সরকারের চিরায়ত মমতায় বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে না। আমাদের বাংলার অনেকটাই অনগ্রসর উত্তরবঙ্গের শীর্ণকায়া তিস্তার জলভাগ করে উন্নয়নের ঢেউ তোলা কাল্পনিক। কিন্তু তিস্তা নিয়ে দিস্তা দিস্তা সরকারি নথির পাহাড় সরিয়ে দুদেশে বহতা আরও অন্তত সাতটি নদীর জল ভাগ করে নিলে অনায়াসেই বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ হতে পারে। দুদেশের সরকারের প্রস্তুতি আলোচনা প্রক্রিয়ায় এই বিকল্প সমাধানের সূত্র মিলেছে। তথ্যসূত্র অনুযায়ী মনে করা যেতে পারে হাসিনার ভারত সফরকালে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সাতটি কম আলোচিত নদীর জলবণ্টনের কাঠামো নিয়ে চুক্তিতে কোনও বাধা থাকবে না। ছোট বড় মিলে দুই বাংলার মধ্যে প্রবহমান মোট ৫৪টি নদীর জল নিয়ে সামগ্রিকভাবে আলোচনা চলছে দুদেশের কূটনৈতিক চ্যানেলে। সদ্য অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিকল্প পথের বিষয়ে সবুজ সংকেত স্পষ্ট। অসম ও ত্রিপুরায় বিজেপি সরকার থাকায় সাতটি নদীর জলবণ্টনের প্রশ্নটি সহজেই সমাধান করতে পারবে বলে মনে করছে ভারত সরকারের বিদেশ ও জলসম্পদ মন্ত্রক। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের সরকারের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির সম্ভাবনা কম থাকলেও অন্য দু একটি নদীর জল নিয়ে মমতা ব্যানার্জির সরকারের কোনও আপত্তি নেই বলেই ভারত সরকারের ধারণা। কারণ, রায়ডাক বা সঙ্কোশের জল আগেই রাজ্য সরকারের তরফে ঘরোয়াভাবে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কারণ তিস্তার যে জলাভাব তা সঙ্কোশ, রায়ডাক বা অন্যান্য শাখানদীগুলির ক্ষেত্রে নেই। দু দেশের দ্বিপাক্ষিক পরিসরে বাংলাদেশ এখনও বেশ ফিল গুড মনোভাব নিয়ে এগোচ্ছে। বিশেষ করে এক যুগ পর যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের বিষয়ে ভারত অনেকটাই উদারনৈতিক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে। যেটা চিরকালই ঘটে এসেছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। কেন্দ্রে যে সরকারই থাকুক বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের বিদেশনীতির দিশা একটুও বদলায়নি। এবিষয়ে অনেক বড় দেশ হিসেবে ভারতের কিছু আনুষঙ্গিক ও আঞ্চলিক স্বস্তি ও সুস্থিতির প্রশ্ন জড়িত। আঞ্চলিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে চীনের অবস্থানের দিকে সর্বদা নজর দিতে হয়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক – রাজনৈতিক অবস্থান আরও বাড়তি গুরুত্বের দাবিদার। ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সেই দায়িত্ব মাথায় নিয়ে চলতে হয়। যেদিকে তাকিয়ে সবচাইতে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর দাবি দাওয়া আবদার রক্ষা করে চলাটাই ভারতের চিরাচরিত দস্তুর। স্পর্শকাতর চিকেন নেকের ২২ কিমির কথা ভেবে চীনের চোখ রাঙানির পাশাপাশি বাংলাদেশের মত স্বাভাবিক মিত্রকে ভারত কখনও হারাতে চায় না। তাছাড়া বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সদর্থক বন্ধুর ভূমিকাকে ভারত সদাসর্বদা মনে রাখতে চায়। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেই প্রকৃত মিত্রের ভূমিকা পালন করে আসছে বাংলাদেশ। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স এর অভ্রান্ত নীতি অনুযায়ী তাঁর সরকার ২০০৬ এ ক্ষমতায় ফিরে এসেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান অনমনীয় রেখেছেন। আলফা জঙ্গিদের গ্রেপ্তার ও ভারতের হাতে তুলে দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের মাটি ভারতবিরোধী কোনও কার্যকলাপে ব্যবহৃত হতে দেব না। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেমন নৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেছেন, তেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রীও সদর্থক সাড়া দিয়েছেন। এই ধারাবাহিকতার কারণেই ২০১৭ র পর এবার ভারত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদের নেতৃত্বে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও বেশ কিছু জটিলতা কাটিয়ে নিয়ে কিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত ও পুরনো চুক্তির নবীকরণ হতে চলেছে। দুদেশের মাটিতে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক ছাড়াও অন্যান্য দেশে বা আঞ্চলিক শীর্ষ বৈঠকের পরিসরে নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার দেখা ও কথা হয়েছে অন্তত বার দশেক। বিজেপি সরকারের আমলেই স্থল সীমান্ত চুক্তি ও সমুদ্র সীমানা চুক্তির মতো জটিল আন্তর্জাতিক চুক্তির জট ছাড়ানো সম্ভব হয়েছে। অতীতের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির ভিত্তিতেই দুদেশের মধ্যে লাগাতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে যেমন , এবারেও তার ঋজুতা খর্ব হবে না। দুদেশের মধ্যে রেল যোগাযোগও বাড়ছে। ট্রানজিট নিয়েও বাংলাদেশের ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে চায় না ভারত। সবটাই ধীরে ও সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে হাসিনা আসছেন ভারতে। দীর্ঘদিন শাসনযন্ত্র পরিচালনার ফলে তিনি দিনে দিনে আরও সমাহিত ও পরিণত ভাবে লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন। কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার দক্ষতার পাশাপাশি তাঁকে সাহায্য করে এসেছে ভারত বাংলাদেশের রক্তের সম্পর্কের ঐতিহ্য ও পারস্পরিক নির্ভরতা। তাঁর প্রথম প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলেই তিনি দিল্লিতে এসে গঙ্গাজল চুক্তির মতো মাইলফলক হাসিল করেছিলেন। সেই মাইলফলকে লেখা আছে ভারতের তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়া, বিদেশমন্ত্রী আই কে গুজরাল ও শেখ হাসিনার পাশাপাশি বাংলার তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ও ঐ চুক্তির মূল রূপকার জ্যোতি বসুর নাম। ভারত ঐ চুক্তিতে ঔদার্যের স্বাক্ষর রেখেছিল এবং তার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতি বসুর নিজের ও দলের সরকার সাকুল্যে আরও চোদ্দ বছর ক্ষমতায় ছিল। গঙ্গার জলের টানে ভোট ভেসে যাওয়া তো দূরের কথা আরও উজানে উজিয়ে এসেছিল। এবার সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ ও নবীকরণের সময় এসেছে। ২০২৬ এ চুক্তির ৩০ বছরের মেয়াদ শেষ হলে পুনর্নবীকরণ নিয়ে ফের তিস্তার মতো বিভ্রাট বাধতে পারে বলে সরকারের শঙ্কা। সুতরাং চারবছর হাতে নিয়েই এবিষয়ে কথা শুরু হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পরিসরেও কথা হবে বলে আশা। সরকারের উপদেষ্টারা বলছেন, এটাতো আর নতুন কোনও চুক্তি স্বাক্ষর করার ব্যাপার নয়। শুধুমাত্র নবীকরণের আনুষ্ঠানিকতা। সুতরাং দিল্লিই এটা করতে পারে এককভাবে।
তবে, দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে যেখানে যেখানে উভয়ের জাতীয় স্বার্থ জড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে দুদেশের নেতাই ঘর গোছানোর কথা মাথায় রেখেছেন।
এবং সেই বৃহত্তর স্বার্থে কিছু ক্ষুদ্রস্বার্থ ছাড়তেই হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের নিরিখে তারা স্বল্প উন্নত দেশের তকমা খুলতে পেরেছে। সেই জায়গায় তারাও এখন উন্নয়নশীল দেশের শ্রেণীতে। এই কারণে তারা ডিউটি ফ্লি বা শুল্ক ছাড়ের সুযোগ আর পাবে না সাধারণ ভাবে। কিন্তু ২০২৯ থেকে যাতে বাংলাদেশ এই সুযোগে যাতে পুরোপুরি বঞ্চিত না হয় সেই আবেদন আগেও এসেছে প্রধানমন্ত্রীদের আলোচনার পরিসরে। এবার দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেও বিষয়টি উত্থাপন করবেন হাসিনা। এবং সবমিলিয়ে যে সদর্থক বার্তা নিয়ে ঢাকায় ফিরবেন তাতে পদ্মা বেয়ে তরতরিয়ে গিয়ে তার নৌকা এবারও পাড়ের নাগাল পাবে অনায়াসে। Pic courtesy: Dhaka Tribune