BusinessGeneralIndiaNewsSambad MatamatWorld

মোদীর সফরে মূল সুর বিরোধীদের ইস্যু গণতন্ত্র

দেবারুণ রায়

হয়তো ভারতবাসীর বুকের গভীরে নিহিত চৈতন্যই কাকতালীয় ভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদীর আমেরিকা সফরের মূল সুর হয়ে উঠল। ন’বছর টানা ভারত শাসনের সুযোগ পেয়েছেন মোদী। অনায়াসেই তিনি একটি সম্পূর্ণ দশকের মেয়াদ পাথেয় করে আগামী বছর নির্বাচনে যাবেন। এক দশকের বেশি টানা প্রধানমন্ত্রী থাকার সুযোগ পেয়েছেন ভারতের মাত্র দু’জন প্রধানমন্ত্রী, যাঁরা জগৎসভাতেও ভারতকে শ্রেষ্ঠত্বের সরণীতে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। এক দশকের মুখে মোদী এই দশক পেরনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীদের ক্লাবে একমেবাদ্বিতীয়ম হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রনেতা। আগের দুজনই কংগ্রেসের মহীরুহ, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের যথাক্রমে পুরোধা ও শরিক, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ও তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী। কংগ্রেসমুক্ত ভারত ও অচ্ছে দিন আনার মোদ্দা প্রতিশ্রুতির মালা গলায় প’রে মোদী মোদী মোদী রবে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে নরেন্দ্রভাই ২০১৪-য় বসেছিলেন দিল্লির মসনদ। সাউথ থেকে নর্থ ব্লকে তারপর থেকেই নানা ইস্যুর তুফানে কংগ্রেসমুক্ত ভারতের স্বপ্নপথে হেঁটে বিজেপি ভারতবাসীকে অচ্ছে দিনের যে চেহারা দেখাতে চেয়েছে, তা আম আদমির কল্পিত দিনের সঙ্গে মেলেনি। ফলে প্রতিশ্রুতির সঙ্গে প্রাপ্তির অনেক তফাত থেকে গেছে বলেই বিরোধী দলগুলো তাদের ভাঙা সংসার জোড়া দেওয়ার রসদ পেয়ে গেছে। ‘১৪-য় মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির অভিযান ছিল যেমন অনায়াস, আজ এক দশক বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সরকারের শাসনকালের উত্তরণপত্র নিয়ে সেই হাল আর নেই। তখন মোদীর আখ্যায়িত মনমোহন সিং ছিলেন “মৌনমোহন।” আর আজ তাঁর বিরুদ্ধে সরব বিরোধী জিগির “নীরব নরেন্দ্র মোদী।” মুম্বইয়ের হীরে ব্যবসার হীরো হীরালাল নীরব মোদী পিএন বির অনেক হাজার লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে চম্পট দেওয়া ইস্তক বিরোধী তূণীরের পাশুপত হয়ে উঠেছেন। মোদীকে সচরাচর নীরব ও তাঁর সহকর্মীদের সরব হতে দেখা যায়। সমস্যা তো অন্তহীন। অভিযোগও। ললিত মোদী, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সি তো আছেনই। আছে বেকারদের বছরে দু’কোটি করে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থেকে অর্থনীতিতে প্রগতির ঝড় তোলা, পাকিস্তানের বেআদবি বন্ধ করতে কূটনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা, চীনের সঙ্গে সমস্যা মেটাতে সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি এবং ভারতকে বিশ্বগুরু করে সারা দুনিয়াকে দেখিয়ে দেওয়া মোদীত্ব কাকে বলে।

কিন্তু কার্যকরী করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেল বিজেপি তথা আরএসএসের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা। রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি রূপায়ণে কোনও সমস্যার প্রশ্ন ওঠে না। সব দলের পক্ষেই তা স্বাভাবিক। কিন্তু বিরোধীদের বক্তব্য, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে বিজেপি ও সংঘের হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের মতো অ্যাজেন্ডা। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চাইছেন আইনমন্ত্রী, এঘটনাও ঘটেছে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, নাগরিকদের ব্যক্তিগত পরিসরের অধিকার সবকিছু নিয়েই সরকারে আসীন দলের ভিন্নমত বলে মনে করছে বিরোধীরা। অভিযোগে বলছে, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ইস্যুতেই জোর দিয়ে মানুষের জীবনযাপনের মূল সমস্যাগুলোকে ভুলিয়ে দিতে চাইছে। এই অবস্থায় শেষ রাজ্যের ভোটে মোদীর মরিয়া প্রচারেও বিজেপির পক্ষে হাওয়া ওঠেনি। পাল্টা ঝড়ে কর্নাটকে হিন্দুত্বের রাজনীতি নিয়ে বিজেপির অগ্রগতির রথচক্র বিধ্বস্ত।

এই পটভূমিতে মোদীর মতো জাঁকজমকের রাজনীতির নায়কের হোয়াইট হাউসে বাইডেনের বিরল নৈশভোজে উপস্থিতি এক অসাধারণ যোজনায় মোড়া ছিল। প্রথম সফরের চেয়েও বেশি সাফল্য ছিল আশাপ্রদ। ভিনি ভিডি ভিসি হয়েই ভারতকে বিশ্বগুরুর পেডেস্টালে তুলে দিতে আর দেরি নেই, এমনটাই ভারতবাসীর ধারণা। বাইডেনের মতো মৃদু মেজাজে গুছিয়ে খেলুরে বিশ্বনেতার ওপর মোদী যে অনায়াসেই প্রভাব বিস্তার করতে পারেন এনিয়েও কারও সন্দেহের অবকাশ নেই। সেইসঙ্গে যে অস্ত্রে অনায়াসেই মাত হন মার্কিন নেতা সেই অস্ত্র তো মজুত ছিলই ভারতের বাস্কেটে। ২৪,০০০ কোটি টাকায় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনা নিয়ে ভারত কথা বলছিলই আমেরিকার সঙ্গে। বাইডেনের ডিনার আয়োজনে এজন্যই একটা উদার অভ্যুদয় চোখে পড়ছিল। ক্যালিফোর্নিয়ার প্রসিদ্ধ গুজরাতি ওয়াইন প্রস্তুতকারক কোম্পানি প্যাটেলের ডাক পড়েছিল। খুব বিরল ব্যাপার স্যাপার। মোদী আপেল জুসের গ্লাসটি তুলে টোস্ট করবেন কূটনৈতিক কেতায়, এটা জেনেও কেন বেছে বেছে প্যাটেল কোম্পানিকে তলব করলেন হোয়াইট হাউসের ওয়াইন পরিবেশক, সেটা রহস্যাবৃত রেখে দারুণ গল্প বললেন গুজরাতের মদ্যবণিক প্যাটেল। যদিও বাইডেন জানতেন না, ক্যালিফোর্নিয়ার কালো আঙুর আর কফিতে জারিত রেড ওয়াইনেও মজবেনা মার্কিন রাজনীতির মজবুরি। তাঁর নিজের দলের সেনেটর বা দুই কক্ষেরই সাংসদরা তাঁকে দু’কথা শুনিয়ে দিলেন। রিপাবলিকান ডেমোক্রেটিক মিলিয়ে ৭৫ জন মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য পত্রাঘাত করলেন বাইডেনকে। হুমকি দিলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈষম্যের দেশ বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে যে ভারতের বিরুদ্ধে তার নেতার সম্মানে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজ তাঁরা বয়কট করবেন। বাইডেনের এসব অজানা ছিল না। তাই তিনি নিজের সিদ্ধান্ত দুটি বিষয়ে অপরিবর্তিত রাখলেন। এক) মোদীর সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে নৈশভোজের আয়োজন হবে। এবং দুই) মোদীর সঙ্গে তিনি যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁকেও প্রশ্নের উত্তর দিতে বলবেন। সেইমতো মার্কিন বিদেশ দপ্তর অগ্রসর হল। দিল্লির মোটেই সাংবাদিকদের প্রশ্ন নেওয়ায় গা ছিল না। সঙ্গী সাংবাদিকদের মাধ্যমে যৌথ বিবৃতি প্রচারিত হবে, তার বেশি কিছু নয়। ইন্ডিয়ান লিডার মাইট নট বি এক্সপোজড টু দ্য ভলি অফ কোয়েশ্চেনস। দ্যাটস নট রিকয়ার্ড অর ওয়ারান্টেড অ্যাট দ্য হাই প্রফাইলড ভেনিউ। এতৎসত্ত্বেও দ্য টল হোস্ট টললেন না তাঁর মোদ্দা গণ্ডি ছেড়ে। বললেন, আমাদের দুই দেশ গণতন্ত্রের পীঠস্থান হিসেবে চিহ্নিত। সুতরাং গণতান্ত্রিক দেশের পরম্পরায় কোনও বৈষম্য বা ব্যতিক্রম নয়। অতঃপর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের অভিজ্ঞ মহিলা সাংবাদিক সিদ্দিকির প্রশ্ন পেশ মোদীকে। ন’বছরের পরিসরে এমন প্রশ্ন এড়াতে চেয়েছে সরকার। হয়তো সেজন্যই প্রধানমন্ত্রীকে কোনও সরকারি প্রেস কনফারেন্স ডাকার কথা ভাবতে হয়নি। অন্য মন্ত্রী সান্ত্রী ক্লান্তিহীন ভাবে সাংবাদিকদের সামনে বলেছেন। আর প্রধানমন্ত্রীকে রেখেছেন প্রশ্নের বাইরে। সংসদে থাকলেও কদাচিৎ। বাইরে কখনও নয়। তিনি বলে থাকেন, রেডিওতে দূরদর্শনে, কিংবা জনসভায়। যাঁরা মোদীকে ২০০২ এ মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই দেখেছেন তাঁদের দাবি সেই সময় থেকেই প্রশ্নোত্তরে বঞ্চিত থেকেছেন তিনি। সুতরাং মোদীকে এবার প্রশ্ন করা নিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিককে ব্যাপক ট্রোলের শিকার হতে হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী হন নিয়মিত, বাইডেনের সঙ্গে যথেষ্টই সম্মানজনক সম্পর্ক তাঁর। সুতরাং হোয়াইট হাউসের তরফ থেকে তাঁকে ও যেকোনও সাংবাদিকদের প্রতি হেনস্তাকে কড়া ভাষায় খারিজ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি। ভারতে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে প্রধানমন্ত্রী কী পদক্ষেপ করেছেন জানতে চান ভারতীয় উৎসের মার্কিন সাংবাদিক। মোদী গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে অগণতান্ত্রিক কোনও ঘটনাই ঘটে না এমন কথাই বলেন জবাবে। তার পর ট্রোলিং ও হোয়াইট হাউসের গণতান্ত্রিক অবস্থান। মণিপুরের আগুন জ্বলছিল , মোদীর আমেরিকা সফরকালে। বিরোধীদের অনর্গল অভিযোগ আসছিল।রাহুল গান্ধীর হুল ফোটানো শুরু মোদীর আতিথেয়তায় আমেরিকার আয়োজনকালে। তারপর মোদীর নৈশভোজের দিন এলইডি গাড়ির প্রচারণায় ও বিক্ষোভে “মোদী গো ব্যাক” ও হল। কোনও কিছুতেই কিছু হত না। সাংবাদিক সম্মেলনটি ঠিকঠাক উৎরে গেলে। মোদীর মতো বক্তা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিকের প্রশ্নটি অনায়াসেই ট্যাকল করতে পারতেন। একথা মনে করছেন বিরোধীরা। কেন করেননি, সেটাও কি রাজনীতি ? মেরুকরণের ? কিন্তু আগাম আমেরিকা গিয়ে রাহুল গান্ধী যে গণতন্ত্র বিপন্নতার ইস্যু তুলেছিলেন, সেটাই কি জড়িয়ে গেল ভারতের বেস্ট স্ট্রাইকার মোদীজির পায়ে ?

একটা আলো দেখা গেল মিডিয়া জগতের সৃষ্ট ধোঁয়াশায়। সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার আসল অর্থ যে মিডিয়া মালিকের স্বাধীনতা সেটা আজ বলে নয়, বাবরের আমলেও বোঝা যেত। কিন্তু আজ এত ক্রস কারেন্টের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের কর্তৃপক্ষ কিন্তু সলিডভাবে পাশে থাকলেন, সলিডারিটি বা সংহতি জানালেন সাবরিনা সিদ্দিকিকে। অবশ্য জো বাইডেন যেভাবে পাশে আছেন তাতে মালিকের আর অন্য দিকে যাওয়ার জো নেই। Pic courtesy Indian Express

Leave a Reply

Your email address will not be published.