FemaleGeneralIndiaNewsPoliticsSambad Matamat

নিউ টাউনের ভোট রঙ্গ, এক অভূতপূর্ব গনতান্ত্রিক উৎসব

সীমা ঘোষ

নিউ টাউনে আজ পঞ্চায়েত নির্বাচন, ঘোষিত স্মার্ট শহর পরিণত হলো এসমার্ট গ্রামে।

এত বেশী পরিমান ট্যাক্স, জিনিস পত্রের দাম অন্যান্য জায়গার তুলনায় অনেক বেশী, অটো, টোটো ভাড়া বেশী – এই সমস্ত কিছুই আমরা, নিউ টাউনবাসীরা মেনে নিয়েছিলাম। এ নিয়ে কেউ কথা বললেও অন্যেরা বিদ্রূপ করতে ছাড়েন। আমরা জানতাম আমরা স্মার্ট সিটিতে থাকি, তার মাশুল একটু দিতে হবে। সেই আমরা ভীষণ ভাবেই অবাক, আক্ষরিক অর্থেই বাক্যহারা হয়েছিলাম নিউ টাউনের পঞ্চায়েতীকরণে। হঠাৎ করেই আমরা স্মার্ট শহরবাসী থেকে এসমার্ট গ্রামবাসী হয়ে গেলাম।

আমরা, যারা সেই অর্থে কোনো রাজনৈতিক দলের ঘোষিত সমর্থক নই, তারা চুপচাপ সরকারী সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি, একটু হাসাহাসি করলেও কোনো সমালোচনা করিনি, ভোট বয়কটের কথাও বলিনি। আমরা দেশের সরকারী সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে শান্ত ভাবে, জ্ঞানে, কোনো রকম মাদক জাতীয় কিছুই সেবন না করে আমাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে আজ প্রস্তুত ছিলাম।

আজ সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ আমি এবং আমার ছেলে, ভোট দেওয়ার জন্য একটি টোটো নিয়ে রওনা হই আব্দুল কালাম কলেজের উদ্দেশ্যে। নিউ টাউনে তো টোটো বা অটো ভাড়া ঠিক করেন তার চালকরাই, তাই আজ সেই টোটো ভাড়া বেড়ে গিয়ে পঞ্চাশ টাকার পরিবর্তে আশি টাকা। তবু আমরা গেলাম। প্রসঙ্গত জানাই, আমার ছেলে পড়াশোনার জন্য বিদেশে গিয়েছিল অল্প বয়সেই, তাই এবার ওর প্রথম ভোট দেওয়ার কথা ছিল, ও খুবই উৎসাহী ছিল এই ভোট দেওয়ার ব্যাপারে। প্রাইড প্লাজার কাছে যেতেই কিছু অল্প বয়সী ছেলের দল আমাদের টোটো আটকে দেয়, টোটো চালককে চলে যেতে বলে এবং আমাদের ও বলা হয় নিউ টাউন বাসীরা ভোট বয়কট করেছেন, তাই ভোট দিতে যাওয়ার দরকার নেই। আমরা সবিনয়ে জানাই, যে আমরা সরকারী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে রাজি নই, তাই আমরা ভোট দেব। কয়েকজন গায়ের জোরে আমার ছেলেকে আটকানোর চেষ্টা করে, তবে কয়েক জন তাতে বাধা দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে দেয়। আমরা পায়ে হেঁটেই এগোতে থাকি, কিন্তু আবার দেখি রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখানে আরও বেশি সংখ্যক ছেলে ও মেয়েরা ছিল এবং এই সময় তারা একবার বলে আমরা ভোট বয়কট করেছি, সেই সিদ্ধান্ত আপনাদের মানতে হবে এবং একবার বলে সব ভোট দেওয়া হয়ে গেছে, বুথে গিয়ে আর লাভ নেই। এইসব কথার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি, আমি শোনা কথাটুকুই বলছি। এখানে Signed দু’তিনজন ছেলে আমার ছেলের গায়ে হাত তুলেছে এবং ধাক্কা দিয়ে আমাদের বুথের বিপরীত রাস্তায় নিয়ে এসেছে। ওখানে একটি চলন্ত টোটো দাঁড় করিয়ে আমাদের তাতে উঠে চলে আসতে বলেছে। হ্যাঁ, দুই একজন ছিল মোটামুটি ভদ্র, তারা অন্যদের মারামারি বা ধাক্কাধাক্কি করতে নিষেধ করেছিল, কিন্তু মারামারিতে উৎসাহী রা সংখ্যায় বেশি ছিল। তাই আমরা টোটো নিয়ে চলে আসতে বাধ্য হই এবং লক্ষ্য করি যে, ঐ ছেলেদের মধ্যে একজন সাইকেল নিয়ে আমাদের অনুসরন করছে।

এইভাবে একটি গনতান্ত্রিক উৎসব প্রহসন অংশ গ্রহণ করলাম আজ। প্রমাণ চাইলে অবশ্য দিতে পারব না, কারণ তাদের সামনে মোবাইল বার করে ছবি তোলার সাহস হয়নি, মেনেই নিচ্ছি আমি ভীতু এবং তথাকথিত অমেরুদন্ডী প্রাণী, গনতন্ত্র আমার প্রিয়, কিন্তু নিজের প্রাণটি একটু বেশী প্রিয়। যেরকম নিউ টাউনবাসীদের আজ রাস্তায় দেখলাম,যদিও তাদের নিউ টাউন বাসী বলে মনে হয়নি। আরেকটু বেশি চেষ্টা করলে মনে হয় আমার বয়স বিবেচনা করেও তারা আমাকেও ছাড়ত না, কারণ টোটোতে ওঠার পরে আমার ছেলেকে ব্যঙ্গ করে বলা হলো ‘মা সঙ্গে আছে বলে আজ বেঁচে গেলি’।

এবারের মত ভোটরঙ্গ শেষ করে বাড়ি এলাম এবং নিরাপদে নিজের ঠান্ডা ঘরে বসে আমাদের অভিজ্ঞতা লিখে ফেললাম। জানি না স্মার্ট গ্রামে এরপর আর কী কী অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তবে এই পরিণত বয়সে এরকম ভোটদানের অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। বুথ ক্যাপচার কথাটি শুনেছি, কিন্তু ঠিক কেমন হয়, কিভাবে হয়, চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা আমার বোধহয় শেষ ভোটদানের সময় হলো, আর আমার ছেলের প্রথম এবং হয়তো শেষ ভোটদানের অভিজ্ঞতা, কারণ এরপরে ও আর কখনও গনতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে উৎসাহ পাবে না, আর এমন অভিজ্ঞতার পরে আমিও আর কখনও ওকে ভোট দেওয়ার অনুরোধ করতে পারব না। কিন্তু এরপরেও আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গর্বিত অধিবাসী।

জয় হোক গনতন্ত্রের, জয় হোক বাক্ স্বাধীনতা ও স্বাধীন মত প্রকাশের আমাদের সাংবিধানিক অধিকারের। জয় হোক পঞ্চায়েত রাজের। 

Leave a Reply

Your email address will not be published.