ভয়মুক্ত সময়ের আন্দোলনে নেই বিরোধীরা, একের পীড়নে অপরে খুশি মানুষ
দেবারুণ রায়
সুনির্দিষ্ট যোজনা অনুযায়ী বিরোধী মতামত দমনের অভিযোগ তুলে চলেছেন বিরোধী নেতারা। কিন্তু এবিষয়ে জনমত গড়ে তোলা বা গণ আন্দোলনের পথে যাওয়ার জন্য তাঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই। নিছক ক্ষমতার বা ভোটের রাজনীতির বাইরে মানবাধিকারের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে আন্দোলনের রূচি নেই। এর অন্যতম কারণ হল, বিরোধীদের শাসিত রাজ্যগুলোতেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরতর ঘটনা ঘটছে। কেন্দ্রীয় শাসকদের বিরুদ্ধে বিরোধীদের যে অভিযোগ, কিছু কিছু রাজ্যেও তেমন অভিযোগ বিরল নয়। পুলিশ হেফাজতে আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা নিয়ে কে প্লকৃত দায়ী, কেন্দ্রীয় না রাজ্য পুলিশ তাও স্পষ্ট হচ্ছে না। মৃত্যুর বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি উঠেছে দুপক্ষের তরফ থেকেই। বগটুই গণহত্যার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে বহু দিন ফেরার থাকার পর লালন শেখ মাত্র দিনকতক আগে ধরা পড়ে। কিন্তু সিবিআই হেফাজতে তার মৃত্যুর ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই মানবাধিকারের প্রশ্নটি খুব জোরালো ভাবে উঠেছে। বলা হচ্ছে, সিপিআইয়ের লক আপে থাকলেও সেই লক আপের দরজার সামনে প্রহরা ছিল রাজ্য পুলিশের কর্মীর। অথচ, সিবিআইয়ের পুরো শিবিরসহ সমস্ত চত্বরটাই কেন্দ্রীয় পুলিশের প্রহরার ঘেরাটোপের ভেতরে। প্রশ্ন উঠেছে, লালন শেখ সত্যিই গলায় গামছা বেঁধে ঝুলে পড়েছেন, না, এর পেছনে অন্য কোনও রহস্যের ক্লু আছে। সর্বোপরি বিরোধী নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, লালন শেখের মৃত্যুতে কাদের লাভ হল, সেটাই তো আসল। সেটা ঠিক হলেই রহস্যের কিনারা হবে। অতীতে বাম আমলে পুলিশের হেফাজত থেকে নিখোঁজ হওয়া ভিখারী পাসোয়ানের ইস্যুতে আন্দোলনে নেমেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেই ঘটনা নিয়ে তাঁর দাবিতেই সিবিআই তদন্ত শুরু হয়। তখন রাজ্যে সিবিআইয়ের কর্তা ছিলেন স্বনামধন্য উপেন বিশ্বাস। রাজনীতির ও প্রশাসনের সেসময়ের কর্তারা রাজ্যে পরিবর্তনের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছেন এগার বছর আগে। কিন্তু ওই মামলার মতো মানবাধিকারের বহু মামলারই কিনারা হয়নি। দোষীদের সাজা তো হয়ইনি। উল্টে এমন ঘটনা আরও ঘটেছে। সমাজতাত্ত্বিকরা এবং মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত প্রবীণরা প্রশ্ন তুলছেন, অরক্ষিত মানবাধিকারের দুর্বলতা এই রাজ্যের সিস্টেমের মধ্যেই ঢুকে পড়েছে।
এইসঙ্গে সারা দেশেই এই ধরনের কাঠামোগত দুর্বলতা নিয়ে রাজনীতিবিদরা প্রশ্ন তুললেও তা রাজ্য বুঝেই তুলছেন। যেমন বিজেপির নেতারা আকছার বলেন, উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকারের আমলে পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে অভিযোগে বা সামাজিক অপরাধের বিষয়ে তৃণমূল সবসময়ই সোচ্চার। অথচ বাংলায় একই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে তারা চুপ। আবার তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি বা নেতারাও বিজেপির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলে থাকেন সবসময়ই। রাজনীতির চলনে এটাই তো স্বাভাবিক হয়ে উঠছে প্রতিটি দল ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে। সদ্যই একটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে টুইটারে অভিযোগ করেছেন উত্তরপ্রদেশের মেরঠের এক সাংবাদিক। তাঁর অভিযোগ, একটি স্থানীয় আদালত তাঁর মেরঠ জেলায় ঢোকায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। স্থানীয় আদালতের বিচারকের নির্দেশ উদ্ধৃত করে ওই সাংবাদিক অভিযোগ করছেন, উত্তর প্রদেশের গোহত্যা নিরোধ আইন অনুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তাঁর ওই এলাকায় থাকা খুবই বিপজ্জনক। যদিও সাংবাদিকটি দাবি করেছেন, তিনি সরকারের ত্রুটি বিচ্যুতি তুলে ধরেন বলেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা সাজানো হয়েছে। তিনি গোহত্যা করেননি। তিনি সাংবাদিক হিসেবে সরকারের সমালোচনা করেন, কুকীর্তি ফাঁস করেন বলেই তাঁকে জেলে পোরা হচ্ছে। মালয়ালি সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের গ্রেপ্তার ও লাগাতার জামিন নাকচের ঘটনাটিকেও একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা হিসেবে তুলে ধরেন মানবাধিকার কর্মীরা। তাঁরা বলছেন এবং অবশ্যই এপিডিআর এর মতো নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারের সপক্ষে আন্দোলনকারী সংগঠনের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, একটা ভয়ের আবহ তৈরি করে তোলার জন্যই এসব করছেন শাসকরা। সরকারের গরিষ্ঠতার অঙ্ক দিয়ে মানুষের ন্যায় বিচার পাওয়ার বা নাগরিক অধিকারের দাবিকে ধামাচাপা দিচ্ছেন সমাজের ক্ষমতাবানেরা। মানুষকেই এই পরিস্থিতি বুঝতে হবে। এবং এর বিরুদ্ধে সরব হতে হবে। মানুষ যখন বিপুলসংখ্যায় প্রতিবাদে সামিল হবে তখন রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের সঙ্গে আসতে বাধ্য হবে। নাহলে মানুষ যদি রাজনীতির লোকেদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাহলে যেখানে তাঁদের রাজনৈতিক লাভ সেখানেই শুধু তাঁরা মানুষের পাশে থাকবেন। ক্ষমতার রাজনীতিতে এটাই বাধ্যতা। আর এর ফাঁক দিয়ে নাগরিক স্বাধীনতা , সাংবাদিক স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ বা সমালোচনার ন্যায্য অধিকার বিসর্জন হয়ে যাবে। গৌরি লঙ্কেশ, ফাদার স্ট্যান স্বামী থেকে নরেন্দ্র দাভালকর বা ভারাভারা রাও হয়ে গৌতম নওলাখাকাদের বিচারের বাণী চিরকাল নীরবে নিভৃতে কেঁদে যাবে। ভয় আর আতঙ্কের আবহই আরও শক্তিশালী হয়ে কণ্ঠরোধের নিত্যনতুন পাসওয়ার্ড খুঁজে নেবে। আর কোথাও গো হত্যা, কোথাও মাদক পাচার কিংবা কোথাও অবৈধ নাগরিকত্বের নির্বিচার অভিযোগ অভিজ্ঞান হয়ে গণতন্ত্রের মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে দিতে পারবে। হিমাংশু কুমার ও অল্ট নিউজের মহঃ জুবের কলকাতায় এসেছিলেন সম্প্রতি। কিন্তু গণতান্ত্রিক সাংবাদিকতার গভীর অসুখে বেহুঁশ সংবাদ মাধ্যম ওঁদেরকে স্টিল হয়ে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছে। এই ভাবলেশহীন দৃষ্টি ওঁরা কলকাতার চোখে কখনও দেখেননি। যেতে যেতে হিমাংশু কুমার তেরো বছর আগের একটা ঘটনার কথা শুনিয়ে দেন সাংবাদিক সুদর্শনা চক্রবর্তীকে। সেই ঘটনাটি হল, ছত্তিশগড়ের দাঁতেওয়াড়ায় আদিবাসীরা বিপন্ন বলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি একটি জনস্বার্থের মামলা করেন। আদালতের রায় তাঁর বিপক্ষে যায়। তাঁর পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা হয়। যদিও তিনি জানান, তিনি জরিমানা না দিয়ে জেলে যেতে চান। তিনি ভয়কে জয় করতে হাসতে হাসতে জেলে যাবেন। একথা আদালতেই তিনি পেশ করেছেন। দশ ডিসেম্বরের মানবাধিকার দিবসের জন্য বক্তব্যে তিনি বলেন, “ভারতবর্ষে মানবাধিকার খতরে মে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক – দলিত, আদিবাসী, মুসলমান, ক্রিশ্চান বিপন্ন বোধ করছেন। তাঁদের উপর শোষন-পীড়ন নিরন্তর চলছে। তাঁদের মৌলিক অধিকার থাকছে না। ভারতে জাতপাত, ধর্মের নামে যে চিরায়ত বৈষম্য ছিল , এখন সেটিকেই পুঁজি করে অনেক বেশি করে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। নাগরিকদের এক গোষ্ঠী অন্য কোনও নাগরিক গোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে দেখলে বরং খুশি হচ্ছে, সমর্থন করছে। ভারতের মানুষ যেন ভুলে যাচ্ছেন যে জাতি হিসাবে নিজেদের সহ-নাগরিকদের অধিকার, মানবাধিকার নিরাপদ, সুরক্ষিত রাখাটা সবার দায়িত্ব। ভাবছেন না, ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে। এই পরিস্থিতি অন্য দেশে ঘটেছে। ইতিহাস থেকে তবু আমরা শিক্ষা নিতে নারাজ। ভারতবর্ষে এই পরিস্থিতি ‘ইউনিক’।