BusinessGeneralIndiaNewsSambad Matamat

কলকাতা বইমেলায় বাণিজ্যে বসতে সরস্বতী 

দেবারুণ রায় 

ছাব্বিশ অথবা মতান্তরে সাতাশ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে এবার  ৪৬ তম কলকাতা বইমেলায়। কে বলে কলকাতা শিল্পবিমুখ। শিল্প বাণিজ্য এ শহরে সঞ্চারিত ছবি বই সংস্কৃতি রাজনীতি নাটক রম্যরচনায়। কবিতায় অক্লান্ত বাঙালি, জাগরণ প্রবন্ধ, নিবন্ধ,  গল্প, উপন্যাস,নৃতত্ত্ব ও পৌরাণিক কর্ষণে। আকর্ষণীয় করে তোলার প্রতিযোগিতা প্রত্যেক প্রান্তিক মানুষের। সাহিত্যে ও শিল্পে মমতার মানবজমিন ভরপুর। বাংলার বাণিজ্যে লক্ষ্মীর আশীর্বাদ নেই লক্ষ্য করে তিনি মা সরস্বতীর দ্বারস্থ।  মমতার হাতে তাই তুলি ও কলম। বাঙালির যাবতীয় কষ্টের, কল্পিত অকল্পিত অগণিত ক্ষতের মলম। আগেকার নজির ডিঙিয়ে তিনি গিল্ডের আয়োজিত কলকাতার আন্তর্জাতিক বইমেলার উদ্বোধন করেন। কাঁসর বাজানোর কাঠি হাত ফসকে গেলে তিনি শঙ্খধ্বনি দেন। এতে যুগপৎ সংস্কৃতি ও রাজনীতির সংস্কার হতে পারে। কারণ, দেশের রাজনীতির রঙ যখন গেরুয়া। তাই ধ্যানে জ্ঞানে গানে গেরুয়া বিতর্কের শেষ নেই। এবং এই কলকাতা বইমেলার চালচিত্রের দিকে তাকিয়ে দেখুন একবার। এত আলো, যে ভালো করে তাকিয়ে থাকা যায় না।  চোখ ঝলসে যায়।  সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবাণিজ্যিক বইমেলা। এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম।  ভারতে তাহলে কী ? এমন বইয়ের মেলা কোথাও নেই। বই পড়ুয়ারা সাধারণত ঘরকুনোই হয়ে থাকেন। কিন্তু কলকাতার বইপড়ার কালচারের দৌলতে একটা প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা বইপাড়া গড়ে উঠেছে। যেখানে বইয়ের বেচাকেনার বারোমাস্যা কলকাতার সংস্কৃতির কাছে যতটা ঋণী, তার চেয়ে অনেক বেশি দাতা। বইপাড়া কলকাতার কাছ থেকে যতটা নিয়েছে তার চেয়ে দিয়েছে অনেক বেশি। আজকের ডিজিটাল এর বিশ্বজোড়া বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সব সংশয় তুচ্ছ করে দিয়ে ছাপা অক্ষরের জয়যাত্রা অব্যাহত।  মানুষের অস্তিত্বের শাশ্বত সত্য যেমন প্রযুক্তির রোবটকে কখনও সমকক্ষ মনে করেনি। 

গতবছর বইবিক্রি ছিল অঙ্কে তেইশ কোটি টাকার।  এবার চারকোটি বেড়েছে। ধন্য বঙ্গভূমি।  যারা যখন সরকারে , তারা তথন দেখাতে চান এতো তাঁদেরই কৃতিত্ব । কিন্তু তা মোটেই নয়।  মানুষ বড় বিচিত্র। পড়ুয়ারা নানাভাবে সংগঠিত। কেউ মোর্চায়, কেউ মঞ্চে, আবার কেউ বা মনে মনে মনসুখ মেজাজে। কিন্তু কলকাতা যে কস্মিনকালেও ভবি ভোলবার নয় তার প্রমাণ দিতে হাজির পেল্লায় এক সোনার কেল্লা, সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কের নবযুগের বইমেলার মাঠে। এ সোনার কেল্লা সত্যজিতের নয়। পিসি চন্দ্রের। এই স্বর্ণশিল্প প্রতিষ্ঠানের দোকানের কোনও চমকপ্রদ নাম রাখা হয়নি। কারণ, বইমেলায় সোনার দোকানে প্রমত্ত পসরাই বলে দেয় তাদের পসার কি বিপুল। এবং বুকসেলার্স ও পাবলিশার্স গিল্ডের কর্তারা মোটেই আদার ব্যাপারী নন। তাঁরা বিলক্ষণ জানেন,বইমেলায় যাঁরা আসেন তাঁরা যে সোনা চেনেন না তা নয়। সেই যে বাউল গেয়েছেন, “যে জন প্রেমের ভাব জানে না, /তার সঙ্গে নাই লেনা দেনা,/ খাঁটি সোনা ছাড়িয়া কেনে নকল সোনা/ সে জন সোনা চেনে না…।” শুধু কি সোনা ? বিচার আর আচার নিয়ে বইপুস্তকের কদর তো ছিলই বুকফেয়ারে, একেবারে খাস টক মিষ্টি ঝাল নোনতা আচারের দোকানেও ভিড়ে ছয়লাপ। জৈনদের আচারের রমরমা। বাঙালির সংস্কৃতি এখন কবির কোন আদ্যিকালে কল্পিত অবাক জলপান। এখন বাঙালি জলপাইয়ের আচার  খুঁজতে কি জলপাইগুড়ি যাবে ? কলকাতায় জাতীয়তার সঙ কসমোপলিটান কালচারের সংহতি। মিনি ভারতবর্ষ। ইদানিং আমাকে আমার মতো থাকতে দাও …। আর অসংখ্য খাবার বিশেষত ফাস্ট ফুডের স্টলে উপচে পড়া ভিড়ের ছোঁয়া পেয়ে নাগরিক অধিকারের দাবিতে সোচ্চার এপিডিআর এর প্যাভিলিয়ন আলোকিত। কিছু লোকজন ঢুকে দেখছেন। ওদিকে  চেতনার উৎসবে উৎসারিত জাগো বাংলার মনমোহিনী প্যাভিলিয়নে উদাত্ত বাউলের গান সারাক্ষণই। সামনেই নানা রঙের কারবারিদের ফাউল চাপা পড়ে যাচ্ছে ভিড়ের করতালিতে। 

কলকাতায় স্টল ছিল ৯০০টি। বাংলাদেশের বিশেষ প্যাভিলিয়ন। আর থিম কান্ট্রি স্পেন। পিকাসোর নামে নিবেদন। সৌজন্যের বিনিময়ে স্পেনে পঁচিশের মেলায় থিম হবে ইন্ডিয়া।  ২০ টি রাষ্ট্র যোগ দিয়েছিল বইমেলায়। ইউরোপ থেকে এশিয়া। আমেরিকা তো আছেই। আছে বিনে পয়সায় কোরানের সঙ্গে বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের বঙ্গানুবাদের কমপিটিশন। কোরান নিঃশেষিত হিজবুল্লাহ থেকে নুরুল ইসলাম কহিলেন। কিন্তু রেভারেন্ড বিশ্বেসের আস্তিনে তখনও অনেক নয়া সনদ। তাহলে আস্তানায় আরও কত ? কিন্তু মজা হল, কুড়ি তিরিশের সফট ওয়্যার আর ওয়েব দুনিয়ার চারণকবিরা হাত পেতে নিতে হয় নিচ্ছে। দেনেওয়ালারা ভাবছে আহা কী ধর্মের টান কলকেতার। কিন্তু তারা জেনে গেছেন অথবা যাবেন নতুবা আগেই জেনে আছেন, ওই টানটা শুধু মেলার। ভিড়ের টান, জনজীবনের, জনজোয়ারের টান। দুবছর একলা থাকার, আতঙ্কের নিঃশ্বাসে কাটানোর পর এবার বসন্ত রাতের নির্যাস নেওয়ার পালা। নির্যাতন আর নির্বাসন থেকে নির্বাচনে ফিরে যাওয়ার পথে জীবিত শৈত্যেরমানুষের ভিড়ে নিজেকে উষ্ণ করে নেওয়া। অদ্ভুত  পর এবার অনিরুদ্ধ রঙদার নাতিশীতোষ্ণ দিন। ব্র্যান্ড গেরুয়া কিংবা নীল সাদা লাল কালোর ধর্ম-রাজনীতির রংঢঙ এ রঙের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা বাতুলতা। মেলায় কোনও ক্যাপটিভ ক্রাউড আসে না। তাদের ট্রাকে বাসে ট্রেনে ট্রেকারে কেউ নিয়ে আসে না। তারা আপন খেয়ালে আসে, আপন খেয়ালে বই কেনে, ছবি দেখে, খায় দায় গান গায়, আপন খেয়ালে ফিরে যায়। 

গিল্ডের কর্তারা একটা ব্রেক থ্রু করেছেন। ব্রেকিং নিউজও হল এই  কোটির অঙ্কে মন্ত্রী সান্ত্রী নেতা অভিনেতা ঘুষ নিয়ে ঘুঁষোঘুঁষি, সিবিআই, ইডি আর আদালত নিয়ে কিছু বলার নেইয়ের ফাঁক গলে। কলকাতা বইমেলাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন স্পেনের সরকারি কর্তৃপক্ষ। ম্যাড্রিডে পঁচিশের আন্তর্জাতিক বইমেলায় তাঁদের যেতে হবে। কারণ নিষ্প্রাণ বেচাকেনা নয়। কলকাতায় বইয়ের বাজারের রঙটা নিয়ে গিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। পাবলো পিকাসোকে বলতে হবে, “আমারই রঙ তোমায় দিলাম …।” যেমন করে আমাদের বাঙালির দুর্গাপুজো দুর্গোৎসব হয়ে ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে অতসীফুলের রঙ্ ছড়িয়েছে শরতকালের পুঞ্জমেঘের আকাশে। জাতীয় উৎসবের রঙে আন্তর্জাতিক রঙ লেগেছে। ঠিক সেভাবেই এবার হংসপাখার আকাশে ওড়ার পালা। কলকাতার পাততাড়ি গুটিয়ে প্রকাশক আর বইওয়ালারা আপাতত তমলুকের বইমেলায়। বন্ধু প্রকাশক বললেন, এক পড়ুয়া এসে পঁচিশ হাজার টাকার বই তুললেন। মফস্বলের মেলায় ওঁর এই বইখিদে দেখে অবাক বিক্রেতা। কিন্তু বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। ভদ্রলোক বললেন, কিনব বলেই এসেছি। দেখে চলে যেতে আসিনি। কিন্তু এক শর্তে। বিক্রেতা আরেক প্রস্ত অবাক।  ভাবছেন,  কী আবার শর্ত দেয় কে জানে। ক্রেতা বললেন,  আমার নাম প্রকাশ করা চলবে না, এটাই শর্ত। সুতরাং প্রকাশক ওঁর শর্তরক্ষা করেছেন। একইভাবে শর্তের মান রাখতে ও বেচাকেনার  সত্যরক্ষা করতে প্রকাশকের নামটাও অনুক্ত থাক।   

আপাতত তমলুকের খবর পাচ্ছি দিল্লিতে বসে। এখানেও আর ক’দিন পরেই বইমেলার আয়োজন। বাংলা থেকেও বইয়ের পাহাড় রাজধানীর পড়ুয়া মহম্মদদের কাছে পৌঁছবে। বইমেলার মৌতাতে বাংলাবাজারের রঙ লাগুক। ওদিকে বাংলাদেশের রাজধানীতেও তো এখন একুশের বইমেলার খোলা হাওয়া বইছে। দুই বাংলার খোলা হাওয়া লাগুক দিল্লির উতল হাওয়ার পালে। জি ২০ র বৈঠকে বন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সদস্যতার গণ্ডী পেরিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সভাপতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। দুদেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা কবিই দুদেশের সবচেয়ে কমন কোড মৈত্রীর। “বসন্তে ফুল গাঁথল/ আমার জয়ের মালা/ বইল প্রাণে দখিন হাওয়া/ আগুন জ্বালা।”

Leave a Reply

Your email address will not be published.