দানিশের ছবি জনমত তৈরি করতে পারত
সুদীপ মৈত্র
দানিশ সিদ্দিকির আচমকা মৃত্যু শুধু যে আন্তর্জাতিক ফোটোগ্রাফির দুনিয়ায় বেশ বড়রকমের শূন্যতা তৈরি করল, তা নয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন ধারার গণ-আন্দোলনের কর্মীরাও হারালেন এক বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে। অধিকার আন্দোলনের লড়াইয়ে জনমত নির্মাণ একটা খুব বড় বিষয়। সেই জনমত নির্মাণের ক্ষেত্রে দানিশের ছবি খুব কাজে দিত। তাঁর ছবিগুলি ছিল ধারাল অস্ত্রের মতো। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ভুয়ো খবর ফালাফালা করে কেটে দিত দানিশের এক একটি ফোটোগ্রাফি।
এটা শুধু বলার জন্য বলা নয়। দানিশের ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায়, শুধু গোলমালের মধ্যে ঢুকে পড়লেই ভালো ছবি মেলে না। ওই গোলমালের পরোয়া না করে ঠান্ডা মাথায় চোখটাকেও সজাগ রাখতে হয়। দানিশের অবিচুয়ারিও হওয়া উচিত ছিল ছবির মালা দিয়ে।
আফগানিস্তানের কন্দহরে তালিবান-আফগান দু’পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গিয়ে সম্প্রতি মৃত্যু হয়েছে পুলিৎজারজয়ী ভারতীয় চিত্রসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকির। কন্দহরের অশান্ত পরিস্থিতির ছবি তুলতে দিন কয়েক আগেই সেখানে গিয়েছিলেন দানিশ। আফগান সেনাবাহিনীর সঙ্গে থেকে কাজ করছিলেন তিনি। গত শুক্রবার সংবাদ সংস্থা জানায়, কন্দহরের স্পিন বোলডাক জেলায় আফগান-তালিবান সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে নিহত হয়েছেন দানিশ।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রধান চিত্র সাংবাদিক ছিলেন দানিশ। বৃহস্পতিবার রাতেই গুরুতর জখম হয়েছিলেন তিনি। তিনি আফগান সেনা শিবিরেই ছিলেন। তাঁকে আহত অবস্থায় শিবিরে রেখেই আফগান সেনারা তালিবান বিরোধী অভিযানে গিয়েছিলেন। কিন্তু শুক্রবার সকালে ফের তালিবানি হামলার মুখে পড়ে আফগান সেনারা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দানিশের। এক সাংবাদিক নেট মাধ্যমে জানান, দানিশের দেহাবশেষের ছবিও এসেছে তাঁদের কাছে। কিন্তু তাঁরা তা প্রকাশ করছেন না।
মুম্বইয়ে বাড়ি দানিশের। বয়স ৪০। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্র ছিলেন তিনি। টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে চিত্র সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ২০১০ সালে রয়টার্সে শিক্ষানবিশ চিত্রসাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। তার ছ’বছরের মধ্যেই ইরাকের মসুলের যুদ্ধের ছবি তুলতে যান দানিশ। ২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্পের ছবিও তোলেন। ২০১৯-২০-তে হংকং বিক্ষোভ, ২০২০-তে দিল্লির দাঙ্গার ছবিও তোলেন এই চিত্রসাংবাদিক।
তিনিই ভারতের প্রথম পুলিৎজারজয়ী চিত্রসাংবাদিক। ২০১৮ সালে সহকর্মী আদনান আবিদির সঙ্গে ফিচার ফোটোগ্রাফিতে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন দানিশ। ভারতের রয়টার্সের আলোকচিত্রীদের দলটির প্রধান ছিলেন দানিশ।
আফগানিস্তানে ন্যাটো তাদের বাহিনী সরিয়ে নেওয়া শুরু করতেই তালিবানেরা একে একে আফগানিস্তানের এক একটি জেলার দখল নিতে শুরু করে। শেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের ৪৬০টি জেলার মধ্যে ইতিমধ্যে ২০০টির দখল নিয়েছে তালিবানেরা।
কন্দহরে তালিবান জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছে আফগান সেনারা। দানিশ এই সেনাবাহিনীর সঙ্গে থেকেই পরিস্থিতির ছবি তুলছিলেন গত কয়েকদিন ধরে। বৃহস্পতিবার তালিবান জঙ্গিদের গুলিতে তিনি গুরুতর জখম হয়েছিলেন। তাঁকে ছাউনিতে রেখে শুক্রবার সকালে যুদ্ধে যায় আফগান সেনা। ফিরে এসে তারা দেখে, মৃত্যু হয়েছে আলোকচিত্রীর।
ভারত তো বটেই, এমনকি আফগানিস্তান, ইরাক সহ মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ছবি তুলে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন দানিশ। তাঁর তোলা বহু ছবি ভাইরাল হয়েছে গত কয়েক বছরে। দু’বছর আগে দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার হন সংখ্যালঘু মুসলিমরা। বেছে বেছে আঘাত হানা হয়েছিল সংখ্যালঘু মহল্লায়। সেই সময় দানিশের তোলা গণপ্রহারের একটি ছবি প্রায় সমস্ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ওই একটি ছবিই বলে দেয়, দিল্লিতে দাঙ্গা হয়নি, হয়েছিল একতরফা হিংসা। যা ফাঁস হয়ে গিয়েছিল দানিশের ক্যামেরায়। তারপর ধরুন, গত বছর মার্চে ভারতে আচমকা লকডাউন ঘোষণার পর যখন সব যানবাহন বন্ধ হয়ে গেল, যখন ভিনরাজ্যে কর্মহীন হয়ে পড়লেন লাখো শ্রমিক, সেই সময় বাড়ি ফিরতে গিয়ে কম নাকাল হতে হয়নি তাঁদের। খালি পায়ে হাজার হাজার মাইল পথ পেরোতে গিয়ে বহু শ্রমিকের সপরিবারে মৃত্যু হয়। জাতীয় সড়কে ভুখা শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার মিছিলের ছবি তুলেছিলেন দানিশ। শীর্ণ বাপের কাঁধে একরত্তি মেয়ের ছবি। তাদের পিছনে হাতে মাথায় পোঁটলা নিয়ে আরও কত মানুষের মুখ। সেই ছবিও ভাইরাল হয়। মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ ও মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের খোঁজে উদ্বাস্তু পরিবারগুলির অন্বেষণ, তাও সযত্নে উঠে এসেছিল দানিশের ক্যামেরায়। তারপর এই সেদিন করোনায় মৃত হাজার হাজার মানুষের দেহ নিয়ে গণচিতার ছবি, নদীতে ভাসমান মরদেহের স্রোত সেইসব ছবি তোলার জন্যও ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন দানিশ। হংকংয়ে গণবিক্ষোভ থেকে শুরু করে নেপালের ভূমিকম্প, দিল্লিতে কৃষক আন্দোলন, নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ, ব্রিটেনে মুসলিম ধর্মান্তরণের সমস্যা ইত্যাদি নানা ইস্যুতে দানিশের তোলা ছবি মানুষকে রাজনীতি শিখিয়েছে।
সত্যি বলতে কী, দানিশের ফোটো সিরিজ দেখলে তাঁকে ফুটবলের পাওলো রোসি, রোনাল্ডোদের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছা হয়। মনে হয়, ফুটবলে যেমন রোসি-রোনাল্ডোরা, ফোটোগ্রাফিতে তেমনই রঘু রাই, দানিশ সিদ্দিকিরা। রোসি-রোনাল্ডোরা গোল করার জন্য যে ভাবে ঠিক সময়ে গোল বক্সে পৌঁছে যেতেন, সেটা তো গভীর ফুটবলবোধ ছাড়া হয় না। রঘু রাইয়ের মতো দানিশ সিদ্দিকিও ঠিক সেভাবেই যেকোনও ঘটনার প্রাণকেন্দ্রে ঠিক সময়ে পৌঁছে যেতেন ক্যামেরা নিয়ে। এটাও গভীর রাজনৈতিক বোধ ছাড়া হয় না।
এর পরেও অনেক ঘটনা ঘটবে, ছবিও উঠবে। কিন্তু সেসব ছবিতে দানিশের ছবির মতো জনমত নির্মাণের উপযোগী মশলা ভরে দিতে পারলে তবেই তাঁর উত্তরাধিকার বজায় রাখা যাবে। (লেখক একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক)
নিজের পেশার প্রতি এতটা ডেডিকেশন যা তার প্রতি আরও শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দেয়।
Excellent