তাল মিলিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, জীবনযাত্রায় এখন বর্ধমান
আমিনুর রহমান, বর্ধমান
কয়েকটা বছর আগে একটাই জেলা ছিল।আর এখন বর্ধমান ভাগ হয়ে পূর্ব এবং পশ্চিম। সেই পূর্ব বর্ধমান নতুন করে জেলা হবার পর কিন্তু মানুষের জীবন যাত্রা প্রত্যাশা পেশা রাজনীতি সবটাই বদলে গেছে। বিশেষ করে পাঁচ বছর তো বটেই এক দশকে বদলটা খুব বেশি। এই কবছরে জেলার মূল প্রানকেন্দ্র অর্থাৎ বর্ধমান শহরে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে, আরো ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনীতির রং বদল থেকে শুরু করে শহর ও গ্রামের উন্নয়ন, মানুষের জীবন যাত্রাও পাল্টে গেছে অনেকটাই।এপ্রজন্মের কাছে জীবন অন্যভাবে দেখার সুযোগ মিলছে বর্ধমানে।বলা যায় বর্ধমান ক্রমশ ক্রম বর্ধমানের দিকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও জেলা শহর বর্ধমানে এত শপিং মল,এত দোকান পাট ছিল না। শহরের পরিধি অনেকটাই বেড়েছে।পৌর এলাকা যদি কাটোয়ার দিকে বাজেপ্রতাপপুর এবং দূর্গাপুর এর দিকে বাবুরবাগ পর্যন্ত থাকে অন্যদিকে কিন্তু সেই পরিধি দক্ষিণ দামোদর এলাকায় পলেমপুর পর্যন্ত রয়েছে। অন্যদিকে কলকাতার দিকে এক সময়ে পুলিশ লাইন এলাকায় আটকে থাকা এশহরটা আলিশা মৌজায় জাতীয় সড়কের উল্লাস মোড় পর্যন্ত জমজমাট হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এশহরে চলে আসছেন ব্যবসাবাণিজ্য,শিক্ষা, চিকিৎসা এমনকি পর্যটনের নেশাতেও। শুধু মাত্র জেলার গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দারাই নন সীমান্ত জেলা হুগলী, নদীয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া অসংখ্য মানুষ বর্ধমানে আসেন স্রেফ প্রান বাঁচানোর তাগিদে। বর্ধমানের খোসবাগান এলাকা এখন আগের তুলনায় “ডাক্তার পাড়া”হিসাবে আরও খ্যাতি পেয়েছে। অসংখ্য নাসিং হোম,প্যাথলজি, ওষুধের দোকান,ডাক্তার বাবু দে্র চেম্বার আরো বেড়েছে গত পাঁচটা বছরে। পশ্চিমবঙ্গ কেন ভারত তথা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে একমাত্র বর্ধমানেই এই সুযোগ গড়ে উঠেছে। কিছু দুরেই আছে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। যেখানে রাজ্যের প্রায় আট দশটা জেলা তো বটেই বিহার, ঝাড়খন্ডের মতো রাজ্য গুলি থেকে রোগীদের আনা হয় এখানে।এক কথায় কলকাতার পরই চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে বড়ো পরিকাঠামো রয়েছে বর্ধমানে।তবে ইদানিং খোসবাগানে ডাক্তারখানা, প্যাথলজি, নাসিংহোম এর জন্য জায়গায় অভাবে শহরের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক নাসিংহোম, স্পেশালিটি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। ওই সব হাসপাতাল,নাসিংহোম প্রায়ই গড়ে উঠেছে মেহেদীবাগান থেকে নবাবহাট এবং উল্লাস মোড় থেকে গাংপুড়ের মধ্যে। কলকাতার নামি ডাক্তারবাবুরাও প্রতিদিন আসছেন রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা দিতে। একদিকে যেমন চিকিৎসার সুযোগ সুবিধায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে একই সঙ্গে শিক্ষায় অনেকটাই ক্রমবর্ধমান এখন বর্ধমান। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তো আছেই, এই কবছরে একাধিক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গড়ে উঠেছে শহর ও শহরতলীর অদূরে।গড়ে উঠেছে একাধিক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাংলা মিডিয়াম বিদ্যালয় গুলোতেও আপগ্রেড হয়েছে।
অর্থনীতির কতটা উন্নতি অবনতি হয়েছে সে বিচারে না গিয়ে বলা যায় মুদিখানা, মনোহারী,রেডিমেড গার্মেন্টস,গহনা,মোটর গাড়ি সব বেচাকেনায় ক্রেতা বিক্রেতাদের রুচির বদল ঘটেছে। ঘরের ও রান্নাঘরের যাবতীয় জিনিস পত্র কেনার জন্য নামি কোম্পানির শপিং মল গড়ে উঠেছে এ শহরে। সেখানে ট্রলিতে চাল ডাল তেল মশলা তরিতরকারি ফলমূল জামাকাপড় জুতো গৃহস্থালির টুকিটাকি একসাথে কেনার সুযোগ মিলছে।যা চার পাঁচ বছর আগেও কেউ ভাবেন নি।গহনা কেনার জন্য কলকাতার ব্রান্ড জুয়েলারি সপ বর্ধমান শহরেই গড়ে উঠেছে।আবার এসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাবারেও এসেছে বৈচিত্র্য।প্রায় শতাধিক বিরিয়ানী র দোকান, ফাস্টফুড কর্নার, একাধিক রেস্তোরাঁয় সন্ধ্যা নামলেই ভোজনরসিক বাঙালিরা রসনাতৃপ্তিতে ডুবে যান। কয়েকটা বছর আগে যা ছিল এখানকার মানুষের কাছে কল্পনা মাত্র।
কথায় বলে বর্ধমান নাকি রাজ্যের শস্যভান্ডার। পূর্ব বর্ধমান কৃষি প্রধান জেলা। সেই অর্থে কৃষিতে ও এসেছে বদল। আধুনিক ট্রাকটর,প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলেছে চাষবাস। লাঙ্গল,গরু আর প্রয়োজন হয় না। মেশিনই ধান কাটে ঝাড়ে বস্তায় ভরে দেয়।যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্ধমানের প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি কৃষক এই অভ্যস্ত।রাইসমিলে আধুনিক মানের চাল তৈরীর পর দেশে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। পাশাপাশি মিষ্টান্ন শিল্পেও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমবর্ধমান।যন্ত্রের মাধ্যমে মিষ্টি তৈরি হচ্ছে বেশিরভাগ বড়ো দোকানে। শতবর্ষ পার করা বর্ধমানের মিহিদানা সীতাভোগ তৈরীতেও এসেছে ভিন্নতা।একশো বছরেরও প্রাচিন বর্ধমানের গণেশ মিষ্টান্ন ভান্ডারে সাহসের সঙ্গে নলেন গুড়ের মিহিদানা সীতাভোগ তৈরি হয়ে বিদেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান এই শহরে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা তে বড়ো সুযোগ সুবিধা। শহরের দুপ্রান্তে নবাবহাট ও আলিশায় দুটি বাসস্ট্যান্ড হয়েছে। এশিয়ার মধ্যে প্রথম সর্ববৃহৎ রেলের ঝুলন্ত উরালপুল এশহরেই গড়ে উঠেছে। জাতীয় সড়কে আরও দুটি উড়ালপুল হতে চলেছে। এশহরে যানজটের মূল কারণ হলেও টোটো চলাচলে শহরের যাত্রীদের সুবিধাই হয়েছে। বিদায় নিয়েছে বলা না গেলেও প্যাডেল চালিত রিকশার সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে ।
সব কিছুই হলো, রাজনৈতিক রং বদল ও পরিবর্তনের আঁচ কোন অংশে কম নয় বর্ধমানে।এক সময় বর্ধমান কে বলা হত বামেদের “লালদূর্গ” । সেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে।রাজ্যের মধ্যে এই একটি মাত্র জেলা যেখানে গত বিধানসভা নির্বাচনে ১৬ টি আসনের সব কটিতেই তৃনমূল কংগ্রেস জয়লাভ করেছে।বামেরা ধুয়ে মুছে শেষ।গত লোকসভায় বিজেপি বর্ধমান -দূর্গাপুর আসনে জয়ী হলেও ধাদরাবাহিকতায় ফাটল ধরেছে। সংগঠনও দূর্বল হয়ে চলেছে।গত পৌরসভার ভোটে বিধানসভার নিরিখে শহরের ১৮ টির মতো ওর্য়াডে বিজেপি এগিয়ে ছিল, এবার সেই স্হানে অনেকটাই থাবা বসিয়েছে বামেরা। কারচুপির নানা অভিযোগ থাকলেও পঞ্চায়েত গুলি সবই শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এর দখলে গেছে।এবার পুরসভাগুলিও দখল করেছে তারা । জেলায় আগের তুলনায় সদস্য সংখ্যা, সমর্থক বাড়লেও গোষ্ঠী দ্বন্ধও বেড়েছে। জেলার সভাপতি বদল করে কাটোয়ার বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আবারও সভাপতি বদল নিয়ে চলছে জল্পনাকল্পনা। বিজেপির জেলা সভাপতি এখন অভিজিৎ তা।আর সিপিএমের জেলা সম্পাদক পদে অচিন্ত্য মল্লিকের জায়গায় আনা হয়েছে সৈয়দ হোসেন কে।গত এক দু বছরে এই সব রদবদল রাজনীতির আঙ্গিনায় পরিবর্তন এনে ছেড়েছে। বিজেপি সেই তুলনায় সাংগঠনিক ভাবে গোষ্ঠী দ্বন্ধে জর্জরিত। সেখানে সাম্প্রতিক কালে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে অনেকটাই এগিয়ে সিমিএম। ছাত্র,যুব, মহিলা শাখা সংগঠন এর পক্ষ থেকে যে কোন ইস্যুতে যখন তখন চলছে আন্দোলন। অন্যদিকে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এর মধ্যে শহরে দলীয় কোন্দল খুব একটা কমেছে বলা যাবে না।সদ্য পুরভোটে বিধায়ক খোকন দাস অনুগামীরা একচেটিয়া ভাবে কাউন্সিলর পদে টিকিট পাওয়া, তার স্ত্রীকে ভাইস-চেয়ারম্যান পদে বসানো এসব নিয়েও সম্প্রতি বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে।
ওই বিতর্কে নাম জরিয়েছে দলের জন্মলগ্ন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর সঙ্গে থাকা অরূপ দাস এর নাম। কাউন্সিলর হয়ে চেয়ারম্যান পদে বসতে না পারায় তিনি শপথ গ্রহণ করেন নি। ভাইস-চেয়ারম্যান পদের দাবিদার শিক্ষাবিদ ড : শিখা সেনগুপ্ত কে চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিলের পদ ও দেওয়া হয় নি। এসব নিয়ে জনমানসেও গুঞ্জন ছড়িয়েছে।আবার বিধায়ক বিরোধী গোষ্ঠীতে থাকা বাম আমলে পুরসভার চেয়ারম্যান আইনুল হক কে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী না করলেও বর্তমানে তাকে বর্ধমান উন্নয়ন সংস্থার ভাইস-চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়েছে। বিধায়ক বিরোধী যুব নেতা রাসবিহারী হালদার ও শুধু মাত্র কাউন্সিলর হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। আর এসব নিয়ে বর্ধমানের হালবদলের পেক্ষাপট মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।