FEATUREDGeneralIndiaNewsSambad Matamat

প্রণব বাবুকে নিয়ে লেখা রাজনীতির নানা নেপথ্য কাহিনির বই

দেবারুণ রায়

মূল্যমানের রাজনীতির মূল্যায়ন কি সহজ কথা ? কিন্তু সেই কঠিন কাজটাই সহজ ভাবে করে ফেলেছেন সতীর্থ গৌতম লাহিড়ি। চার দশকের বেশি যার পেশাদার সাংবাদিকতার বয়স, তিনি যদি শুধু চাকরির দায়ে এই দীর্ঘ সময় বন্ধুর পথ পরিক্রমায় ব্রতী থাকতেন তাহলে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে এই ঐতিহাসিক বই লেখা তাঁর হতই না। আর প্রণবের মতো এক প্রাঞ্জল নেতা, যাঁর মগজাস্ত্র শানিত কৌটিল্যের রণনীতিতে, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ময়না তদন্ত করতে হলে চাই একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, সচেতন কমিটমেন্ট এবং রাজনীতি আর কূটনীতির রসায়ন সম্পর্কে জ্ঞানগম্যি। গৌতম লাহিড়ি এই রসায়নের রসবোধে জারিত হয়েছেন তাঁর রিপোর্টার জীবনে। প্রণব শব্দের যা অর্থ তা তাঁর মতো কেউ কেউ রাজনীতির রিপোর্টিং করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছেন প্রণববাবুকে কাছ থেকে দেখে। যেটা শুধু বাংলায় বা শুধুমাত্র দিল্লির দরবারে তাঁকে দেখে পাওয়া সম্ভব নয়। এই দুই পটভূমির সারাংশ ওঁর স্মৃতি থেকে কলমের কালিতে রূপান্তরিত। এখন অবশ্য কালির বদলে টাইপ আর কলমের জায়গা নিয়েছে কী বোর্ড। খুব দ্রুততার সঙ্গে লেখা প্রণব মুখার্জি : রাজনীতির ভেতর বাহির গ্রন্থের প্রথম খণ্ড। বাংলাদেশের আল হামরা প্রকাশনের মাধ্যমে বাজারে সফল হওয়ায় দ্বিতীয় খণ্ডের অবতারণা। এককথায় বাজারের বা পাঠকের পীড়াপীড়িতেই বাঙালির আইকন ও ভারতের এই রাষ্ট্রনায়কের ওপর লেখা দ্বিতীয় খণ্ডটি। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর আত্মার সম্পর্ক নিয়েও তাঁর একটি পৃথক বই লেখা চলছে।

প্রথম গ্রন্থটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে সফরকালে লেখকের কাছ থেকে গ্রহণ করেন, দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনে পদস্থ কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে। সংবাদ মাধ্যমে চার দশক ধরে নানা পদে ও বি-পদে আলোচিত আলোকিত প্রণববাবু নিজেই সুপারহিট কয়েকটি বই আত্মকথনের মতো করে লিখে গিয়েছেন। তারপর এই ধরনের একটা বস্তুনিষ্ঠ আলোকপাত যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের। এখানে যুগপৎ আছে ইতিহাস ও ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মানুষের প্রতি সনিষ্ঠ দায়বদ্ধতা। এই দুটো জিনিসকে মেশানো খুব মামুলি কাজ নয়। হয়তো অজানা অচেনা কারও মূল্যায়ন যত সহজে করা যায়, চেনাজানা মানুষ ও জগতের ক্ষেত্রে তা হয়না। কিন্তু নিষ্ঠার সঙ্গেই যে ইতিহাসের তৃষ্ণা মেটানো যায় সেই স্কুলিংয়ের পরিচয় মিলবে বইটির ছত্রে ছত্রে। সেক্ষেত্রে রাজনীতির ছত্রপতি যিনিই হন না কেন তাতে তাঁর উজ্জ্বলতা কমে না। প্রণববাবুকে গৌতম তুলে ধরেছেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের নানা ছন্দ ও দ্বন্দ্বের ভিতরে। বাজেট রচনা করেন যিনি কৌটিল্যের ঐতিহ্যবাহী মন্ত্র উচ্চারণ করে। অথচ মনমোহন মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ও প্রধান যন্ত্রী হিসেবে তিনি অবলীলায় অনুমোদন করেন কেইনসীয় উদার অর্থনীতির বাধ্যতা ও বাস্তবতা। আসলে নেহরুভিয়ান অর্থনৈতিক রাজনীতির লগ্নকে শুকনো মুখে বিদায় জানাতে যখন বিদায়নীতির বিতর্ক এলো, তখনই তো নেত্রী সনিয়া আনলেন মুশকিল আসান প্রণবকে রিফর্মস উইথ আ হিউম্যান ফেসের বার্তা দিতে জনগণকে। দশ বছরের ইউপিএ-শাসনের সাফল্যের পাশাপাশি একবগ্গা বামসাথী কারাটের ক্যারাটেতে মনমোহন কাত না হয়ে মাত করলেন প্রণব চাণক্য মুখোপাধ্যায়ের কূটনীতিক ব্যাকস্টেজ কারুকাজে,এই গল্পটা সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস। যা লিখেছেন নিপুণ হাতে গৌতম।

এছাড়া বাঙালির প্রধানমন্ত্রীত্বের কার্যত শেষ পাশাটি কীভাবে উল্টো চালে উল্টে গেল, রাষ্ট্রপতিই বা হলেন কীভাবে এবং কংগ্রেস হাইকমান্ডের চাল কি স্থূল অথবা ভুল ছিল তার নির্ণয় দিল ইতিহাস, ২০১৪-য়। রাষ্ট্রপতিভবনে তখন ভারতের রাজনীতির অন্য ক্যানভাস তৈরি হচ্ছে। প্রকাশ্যে প্রণব-বন্দনা আর নেপথ্যে কংগ্রেসমুক্ত ভারতের সাধনা, এই দুই স্রোতের মধ্যেই সাঁতরে তাঁর মেয়াদ পেরিয়েছিলেন প্রণব। অনেক কিছুই দেখেছিলেন, নতুন করে বুঝেছিলেন রাজনীতির জাগ্রত পাঠক। জিএসটির নৈশ অধিবেশনেও বলার কথাটি বলেছিলেন। এই রাষ্ট্রনায়ককে বিগ্রহ বানাতে ভারতরত্ন করা যায়, কিন্তু দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতির পদে আনা যায় না কেন ? এই কেনর নেপথ্যে কী ছিল গৌতমের গ্রন্থ পড়ে তেমন কিছু জানার আশা জাগল।

Leave a Reply

Your email address will not be published.