ব্যাঙ্ক জালিয়াতিতে রেকর্ড করল গুজরাতের এবিজি, নির্মলার যুক্তি – ব্যাঙ্ক জালিয়াতি ধরা খুব শক্ত
দেবারুণ রায়
সামন্ততান্ত্রিক প্রভুত্বের আমলে ব্যাঙ্ক ডাকাতি শোনা যেত। ব্যাঙ্কে সশস্ত্র ডাকাতরা হানা দিয়ে বন্দুক পিস্তল উঁচিয়ে ক্যশ থেকে টাকা লুঠ করে চম্পট দিত। ব্যাঙ্কের ক্যাশ কাউন্টারে বা ক্যাশিয়ারের হেফাজতে রাখা লাখ বা হাজারের অঙ্কে আমানতকারীদের টাকা লুঠ করার খবর নিয়ে সারা শহরে দেশে চাঞ্চল্য ছড়াত। পুলিশ প্রশাসনের ওপর চাপ পড়ত প্রচণ্ড। এবং ডাকাতির কিনারা না হলে মুখ পুড়ত সরকারের। ভোটের সময় সরকারের বিরুদ্ধে বড় অস্ত্র হিসেবে তা ব্যবহার করতেন বিরোধী নেতারা। জবাবদিহি করতে হত সরকারের মাথাকে। এখন পুঁজির স্যাঙাততন্ত্র এমন জাদুদণ্ড ও জাদুকরী তৈরি করেছে যে তার দৌলতে ব্যাঙ্কের পুকুর চুরি ও ব্যাপক লুঠ আর কোনও চাঞ্চল্যকর খবর নয়। খবরের কাগজ ও টিভি চ্যানেলের দৈনন্দিন সান্ধ্য আড্ডার চেহারাই বলে দেয়, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ঘুনপোকা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের শরীর কুড়ে কুড়ে খেলেও মানুষের যাতে তা নজর এড়িয়ে যায় সেজন্য পাঁচরকম মুখরোচক খবরের রকমারি আয়োজন করা হচ্ছে। যার পেছনে অবশ্যই ক্ষমতাসীনদের মদত অস্পষ্ট নয়। এখনকার ব্যাঙ্ক ডাকাতি বা লুটের জন্যে আর সশস্ত্র ডাকাতির দরকার নেই। সরকারি দল বা ব্যক্তির অনুগ্রহ কিনতে পারলেই হল।সেই অনুগ্রহে ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা ধার করে কালক্রমে সেই ধার করা টাকাকে এনপিএ তকমা পর্যন্ত ঠেলে দেওয়া। তারপর খুঁটির জোর বুঝে দেশে থেকেও ধার শোধ না করা বা বিদেশে চম্পট দেওয়া। এই ধরনের কুখ্যাত ব্যবসায়ীর ভিড় ক্রমাগত বেড়েই চলছে। এবং বিশেষ ভাবে এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আঁতুড়ঘর গুজরাত কেবলই জড়িয়ে যাচ্ছে। অবশ্য সম্পন্ন ও শিল্পসমৃদ্ধ রাজ্যের এ এক অদ্ভুত খ্যাতির বিড়ম্বনা। অবশ্য মহারাষ্ট্র বা কর্নাটকেও এমন করিতকর্মা কর্পোরেটের কমতি নেই। ললিত মোদি, বিজয় মালিয়া থেকে যে কেলেঙ্কারির রাজনীতি অর্থনীতি শুরু তা আরও জাঁকিয়ে বসেছে গুজরাতের মামা ভাগ্নে মেহুল চোক্সি নীরব মোদির কল্যাণে। ভারতের এই সব রত্নের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার খবর নিত্যনতুন ভাবে বেরয় দেশের মিডিয়ায়। কিন্তু এরা সবাই কুখ্যাত মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের মতোই অধরা। অথচ এদের একেকটি রত্নকে ধরে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতে অন্তত সাধারণ নির্বাচন হয়েছে ছ’টি। এবং মূলত বিজেপিই দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠনের যে ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাতেই ভারতের ভোটাররা সবচাইতে বেশি আস্থা রেখেছেন। দীর্ঘদিনের কংগ্রেস রাজত্ব দুর্নীতির অভিযোগেই সবচেয়ে বেশি কাবু থাকায় কংগ্রেসকে তার মূল্য দিতে হয়েছে বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়ে। যার সুফল অনায়াসেই পেয়েছে বিজেপি। যদিও লাগাতার এই ধরনের আর্থিক লুঠ ও ব্যাংক জালিয়াতি ( ডাকাতি বলা হয় না ) ণঅবাধেণটেণে যাওয়া এবং বিজেপি লালিত রাজ্যের সঙ্গেই জড়িয়ে অভিযুক্তরা, এসব অবশ্যই বিজেপির দিকেই একেকটা তির হয়ে আসছে। ক্রমশ তাদের হালও হচ্ছে কংগ্রেসের মতো।
ইডির ম্যারাথন জেরার ফাঁকে রাহুল গান্ধী যথারীতি হুল ফুটিয়েছেন সরকারকে। বলেছেন, মোদি সরকারের আমলে ৫ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক জালিয়াতি হয়েছে। যদিও সেই ললিত মোদি থেকে নীরব মোদি পলায়ন পর্বের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী মোদির কোনও জবাব শুনতে পায়নি দেশবাসী। অথচ ইডি আর সিবিআই তদন্ত নিয়েই জাতীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ সরগরম। ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় অভিযুক্ত কংগ্রেসের প্রাণভোমরাকে নিয়ে টানাপোড়েন নবির সম্পর্কে কটূক্তির স্পর্শকাতর ইস্যু থেকে শুরু করে দেশের নানা এলাকায় সাম্প্রদায়িক মোড় নেওয়া ঘটনার ঘনঘটা তো বটেই, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নিরিখে বিরোধী ঐক্যের নান্দীমুখের খবরকেও ঢেকে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক অনিয়মের অভিযোগকে অস্ত্র করে রাজনীতিতে শান দিচ্ছে শাসকদল এমন অভিযোগে বিরোধী রাজনীতি ডালপালা ছড়াচ্ছে। রাহুল গান্ধী ও কংগ্রেস সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য এখন রাহুলের পাশাপাশি অভিষেক ব্যানার্জির হেনস্তার বিরুদ্ধে জেহাদে রূপান্তরিত। চাপের মুখে উভয় শিবিরই। তবে সবকিছুর মধ্যে দিয়ে কিন্তু সুরত আর দাহেজের শিপ ইয়ার্ড কোম্পানির কর্তা ঋষি কমলেশ আগরওয়ালের বিরুদ্ধে লুকআউট নোটিসের খবর লুকোনো যায়নি। এই কোম্পানির বিরুদ্ধেই প্রায় ২৩ হাজার কোটির ব্যাংক জালিয়াতির অভিযোগ দেশের সবচেয়ে বড়ো ব্যাঙ্ক লুঠেরার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অতীতে এর একাংশ জালিয়াতির অভিযোগ নিয়েও সংসদ তোলপাড় হয়েছে। পথে নেমেছে বিরোধীরা। এখনও যার কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি।
মোট আঠাশটি ব্যাঙ্ক এই লুটের বলি হয়েছে। এবিজি শিপ ইয়ার্ডের এই ধারের কাণ্ড শুরু চাক্ষুষভাবে ২০০৮থেকে হলেও এর বীজ বোনা শুরু ২০০১ এ বিজেপির সরকারের সময়। তারপর মন্দার সময় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার সদিচ্ছায় যখন সরকার ঋণ নীতিতে আরও উদার হয় তখন থেকেই বিপুল অঙ্কের টাকা ধার নিয়ে এই শিল্পগোষ্ঠী তাদের মতলব হাসিল করার ফন্দিফিকির খোঁজে। ৯৮ টি সংস্থায় এই ঋণের টাকা লগ্নি করার জোরদার অভিযোগ তুলছে ব্যাঙ্কগুলো। ব্যাঙ্ক সমূহের কনসর্টিয়াম করে ঋণের বন্দোবস্ত হয়। কনসর্টিয়াম এর নেতৃত্ব করে আইসিআইসিআই ব্যাংক। নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। এবিজি শিপইয়ার্ড এবিজি গ্রুপেরই একটি কোম্পানি। এই সংস্থা জাহাজ তৈরি এবং জাহাজ সারানোর কাজ করে থাকে। গুজরাতের সুরত এবং দাহেজে রয়েছে সংস্থার কারখানা। এসবিআইয়ের অভিযোগ, সংস্থার তিন ডিরেক্টর ২,৯২৫ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েছিল সেটা আর ফেরত দেয়নি তারা। শুধু এসবিআই নয়, আইসিআইসি ব্যাঙ্ক থেকেও ৭,০৮৯ কোটি টাকা, আইডিবিআই ব্যাঙ্ক থেকে ৩,৬৩৪ কোটি টাকা, পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক থেকে ১,২৪৪ কোটি টাকা, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক থেকে ১,২২৮ কোটি ধার করেছিল। এছাড়াও একাধিক ব্যাঙ্কের থেকে। কিন্তু টাকা ফেরত দেয়নি তারা। ব্যাঙ্ক গুলি অভিযোগ করেছে যে কারণে তাঁদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছিল সেই কাজে সেটা ব্যবহার করেনি তারা। তার বদলে ৯৮ টি সংস্থায় সেই টাকা খাটিয়ে ব্যক্তিগত আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে। নানাভাবে ডালপালা ছড়িয়ে ব্যাংক জালিয়াতির অঙ্ক ৯১ হাজার কোটিতে দাড়াতে পারে বলে ব্যাংক সূত্রের দাবি।
ব্যাঙ্ক এই মামলা হাতে নিয়েও এফআইআর করে তদন্ত শুরু করতে করতে প্রায় এক বছর পার হয়ে যায়। বিরোধীদের প্রশ্ন এখানেই। প্রশ্ন, সরকারের সঠিক পথনির্দেশ ছাড়া ব্যাঙ্ক বা সিবিআই কীভাবে এগোবে ? রাজনৈতিক সদিচ্ছা চাই সরকারের। যদিও মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন অবশ্য ব্যাঙ্কের কোনও ত্রুটি আছে মনে করেন না। তাঁর যুক্তি, জালিয়াতি হয়েছে এটা বোঝা অত সোজা না। ফোরেনসিক অডিট না হওয়া পর্যন্ত অস্পষ্টতা থেকে যায়। ব্যাঙ্কের হিসেবনিকেশে জালিয়াতি বোঝা বেশ শক্ত। Pic courtesy : businesstoday.in