GeneralIndiaNewsPoliticsSambad Matamat

নগ্ন প্রতিযোগিতা উন্নাও থেকে মণিপুর মানবাধিকার লঙ্ঘনের উলঙ্গ উৎসব

দেবারুণ রায় 

২০১৭ থেকে ২০২৩ ধর্ষণের স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠা উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ের দুটি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা। একটি নাবালিকা ও একটি দলিত মেয়েকে যারা দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের পর নারকীয় নৈরাজ্যের দৃশ্য তুলে ধরেছিল  তারা রাজ্য রাজনীতির প্রভাবশালী পালের গোদাদের আশ্রিত বলেই অভিযোগ। যদিও চিরাচরিত প্রথামাফিক অভিযোগ অস্বীকার করেছে শাসকদল। তবে স্বীকৃতি অস্বীকৃতির তোয়াক্কা না করেই এই ধর্ষণের ও তার পরবর্তীতে আগুনে পুড়িয়ে বা গাড়িতে ধাক্কা মেরে মারার মামলা দুটি তুলে নেওয়ার জন্য নিগৃহীতাদের ও তাদের পরিবারের ওপর ব্যাপক জোরজুলুম, অত্যাচার, খুনের হুমকি ঘরে আগুন দেওয়ার মতো যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে এলাকাবাসীর অভিযোগ আরও জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। নিগ্রহ আগাগোড়া শারীরিক ও মানসিক এবং সামাজিক। বিজেপির প্রাক্তন এক বিধায়কই আসামির কাঠগড়ায় এবং  আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত হয়ে মামলার দ্বিতীয় পর্যায়েই সেঙ্গর নামক বিজেপির  জনপ্রতিনিধি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। গণধর্ষণের দরুণ নাবালিকা গর্ভবতী হয় এবং তার শিশুটিকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার অভিযোগও আগুনের মতোই ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। অভিযুক্ত পয়গম্বর সেঙ্গরকেও দল দরজা দেখাতে বাধ্য হয়। তার পরেও অপরাধীর থাবা প্রশাসনের এতটা গভীর পর্যন্ত প্রসারিত যে, নিগৃহীতার মামলা লড়েছিলেন যে কৌঁসুলিরা তাঁদের ওপরেও প্রাণঘাতী হামলা হয়। কোনও অজ্ঞাত নাম্বারহীন ( কালো রঙ করা নাম্বারপ্লেট ) গাড়ি চাপা দিয়ে চলে যায় দ্বিতীয় গণধর্ষণের শিকার তরুণীসহ তাঁর আত্মীয় ও কৌঁসুলিদের। কতজন শেষ পর্যন্ত প্রাণে বাঁচলেন আর ক’জন বিকলাঙ্গ হলেন তার সঠিক চিত্র কখনও কি পাওয়া যাবে। এই ২০২৩ এরই ঘটনা। এভাবেই দুর্বৃত্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিজেপির অন্যতম মডেল রাজ্যে হিন্দুত্বের ম্যাসকট পরিচালিত জাতিগত সম্প্রদায়গত ও ধর্মের রাজনীতির বিভাজনের ল্যাবরেটরিতে। অথচ বাংলায় ভোটে এসে তাঁর রাজ্যের সুশাসনের দোহাই পাড়েন আদিত্যনাথ। মোদী শাহরা বলেন, সিএম হো তো অ্যায়সা। দেশজোড়া যোগীর প্রচারের ফানুস মিথ্যে মিথ দিয়ে এমন করে ফোলানো যে আদিত্যনাথ বা তাঁর আদিম প্রশাসনেরও আর সাফাই দেওয়ার মুখ নেই। ভবিষ্যতে বিজেপির  স্বপ্নের হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের প্রতীক হিসেবে প্রজেক্ট করা মুখ্যমন্ত্রী যোগীর রামরাজ্যের এই ছবির ছায়া অবলম্বনে বীভৎস বিকৃতির চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে দেশের অন্য অন্য রাজ্যে। মালদায় মেয়েরাই মেয়েদের নগ্ন করে গণধোলাই ও নগ্ন প্রদর্শনীর তাণ্ডব চালালে স্মৃতি ইরানির মতো উচ্চকণ্ঠী নেত্রী সেই নগ্ন ঢাল দিয়েই মণিপুরের উলঙ্গ পৈশাচিক প্রশাসনের কুৎসিৎ কলঙ্ক-মুখ ঢাকছেন। মাননীয় মোদীর মণিপুরী নীরবতাকে পরাচ্ছেন মমতারাজ্যের মালদা কাণ্ডের ঘোমটা। একটা অপকর্মের সঙ্গে আরেকটা অপকীর্তির তুলনা চলছে দুদিক থেকেই।  উত্তরপ্রদেশের সাংসদ প্রধানমন্ত্রী। তিনি উন্নয়ন নিয়ে সরব।  উন্নাও নিয়ে নীরব। 

উন্নাও  গণ ধর্ষণের মামলার খবর করতে গিয়ে  হাথরস থেকে গ্রেপ্তার হন মালয়ালম ভাষী  কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান। ৮০০ দিনের কদর্য অভিজ্ঞতা জেলে। কোভিড কালে বাথরুমে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল প্রথমেই বেশ অনেক দিনের জন্য। দীর্ঘদিন বিনাবিচারে কারাগারের কালকুঠুরিতে কাটিয়ে সবে জামিন পেয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ইউ এ পিএর। দেশদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়েছে।  জঙ্গিদের সঙ্গেও যোগাযোগের গুরুতর অভিযোগ।এ থেকে অব্যাহতি পেতে হলে তাঁকেই পাল্টা তথ্যপ্রমাণ পেশ করতে হবে। কাপ্পান কারাবাসের পর কলকাতায় এসে তাঁর দু’বছরের কঠিন লড়াইয়ের কথা এক জনসভায় বলে গেলেন। বলে গেলেন, নারকীয় অবস্থায় ছিলাম। কিন্তু ভয় পাইনি। ভয়কে জয় কলে ফেলেছি।            মানবাধিকারের সংকট বেশ শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে বলেই মনে করছে বিরোধী দলগুলো ও আন্তর্জাতিক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে এপিডিআর এর মতো সংগঠন পর্যন্ত।

২০২২ এর রিপোর্টে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে ভারতে নানা অভিযোগে মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের কথা। ২৫ এপ্রিল গুজরাতের  নির্দল বিধায়ক জিগ্নেশ মেবানির মতো দলিত নেতাকে গ্রেপ্তার করে অসম পুলিশ। ২৫ জুন মানবাধিকার আন্দোলনের প্রথম সারির নেত্রী তিস্তা শীতলবাদ।তারপর একে একে প্রাক্তন পুলিশ অফিসার সঞ্জীব ভাট ও আর বি শ্রীকুমারকে ধরা হয় জোচ্চুরির অভিযোগে। ফোরজারি অ্যান্ড ফেব্রিকেটিং এভিডেন্স অর্থাৎ জালিয়াতি আর জল মেশানো সাক্ষ্য প্রমাণের মামলায়। গত বছর মিডিয়া কর্মী  মহঃ জুবেরকে পাকড়াও করা হয়েছিল। মোট এগারো জন মানবাধিকার কর্মীকে ইউএপিএর মামলায় আটক করা হয়।

এদিকে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর রিপোর্ট বলছে,  তার আগেই ১৪ জুলাই লোকসভায় উপযুক্ত প্রস্তাব এনে কিছু নির্দিষ্ট ও ব্যবহৃত শব্দ নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়। মানে সংসদে বিতর্কের পরিসরে এইসব “অসংসদীয়” শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। এই শব্দগুলো হল, দুর্নীতিবাজ,  যৌন হয়রানি,  ক্রিমিনাল,  আই ওয়াশ বা চোখে ধুলো, অযোগ্য, অপদার্থ, নিকম্মা এবং হিপোক্রেসি বা ভণ্ডামি। অ্যামনেস্টির মতে, এই শব্দগুলো দেখলেই বোঝা যায়,  এটা বিরোধীদের ওপর পুলিশি করার বা ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা। 

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশকে অকুণ্ঠভাবে স্বাগত জানিয়েছে। বলেছে, ২০২২-এর ১১মে কোর্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে,  ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫২ বছরের পুরনো ধারা  ১২৪ এ পুনর্বিবেচনা করুন। এতে যে দেশদ্রোহের জন্য শাস্তির কথা বলা হয়েছে ,এখনকার পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী পুনর্বিবেচনা না করা পর্যন্ত ওই ধারা স্থগিত থাকবে। এদিকে ইতিমধ্যেই দিল্লির দাঙ্গার মামলায় ১১ জন মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দাঙ্গায় নিহত মুসলিমদের সংখ্যা ৫৩ জন বলে দাবি। বিরোধীদের লাগাতার অভিযোগ কে শোনে ? তাদের মতে, দাঙ্গার পাণ্ডাদের সাতখুন মাফ। রাজধানীর বুকের ওপর দাঙ্গা করেও যারা পার পেয়ে যেতে পারে, তারা কারা ? রামমোহন রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের বা মহাত্মা গান্ধীর আর ভগৎ সিংয়ের ভারতের মুখে চুনকালি দিতে তৎপর যারা এটা যে তাদের মুক্তাঞ্চল নয় একথা কে তাদের বলবে ? Pic courtesy : SCLD

Leave a Reply

Your email address will not be published.