বই কথা : গণতন্ত্র বনাম গেরুয়া ভারত
বন্ধু সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র সময়ের প্রতি ন্যায়বিচার করেছেন। এটা বাংলার পেশাদার সাংবাদিকরা সতত করেন না। আত্মসমীক্ষা করেই এই প্রত্যয় হল। বেশিরভাগই কালের বহমানা ভাগীরথীর জ্ঞানের প্রখর জলধারার মধ্যে আরও দু ঘটি ঢেলে দিয়ে কর্তব্য শেষ করেন। কিন্তু মৈত্র মহাশয় সত্যিই সাগরসঙ্গমে গেছেন। তীর্থস্নান লাগি। গ্রামে গ্রামে এই বার্তা রটেনি। কারণ তেমন আত্মব্যাখ্যাতা নন। ওঁর সাম্প্রতিক বই , “গণতন্ত্র ও গেরুয়া ভারত” পড়ে মনে হল, এটা রটিয়ে দেওয়ার কাজ যতটা পারি করি। তাই এই অবতারণা। এই গ্রন্থটির প্রকাশক “বিরাসত” প্রকাশনার কাছেও তাঁরা কৃতজ্ঞ থাকবেন, যাঁরা এই বইয়ে চোখ বোলাবেন।
সমকালের রাজনীতির এই হ্যান্ডবুকটির শব্দে শব্দে ইতিহাস আর রাজনীতির রঙ্গরূপ যতটুকু পল্লবিত ততটুকুই এই প্রজন্মের পক্ষে প্রয়োজনীয়। মানে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হলে রাজনীতির যে বোধটুকু চাই সেটা পূর্বাপর সরল ব্যাখ্যায় সুলভ। জোলোদুধ থেকে দুধটুকু শুষে নেওয়ার কাজটা করা আছে। ৭৫ বছরের স্বাধীনতা ও বাহাত্তর বছরের রিপাবলিককে এখনও কেন বাহাত্তুরে বার্ধক্য গ্রাস করতে পারেনি তার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় এই প্রবন্ধ সংকলনে। একটি বিষয় নিয়ে লম্বা চর্বিতচর্বণ নেই। আধুনিক ইতিহাসের আলোছায়া সিনেমা করার মতো করে ছুঁয়ে গেছেন লেখক। যাতে রাজনীতি বা ইতিহাস নিয়ে লেখা প্রবন্ধ পড়ার একঘেয়েমি নেই। কারণ, ইতিহাসের ও রাজনীতির বিতর্কিত বাঁকগুলো একেকটা ঝলকে উজ্জ্বল। ওই ঝলকগুলোই নতুন যুগের কাছে নিজেকে আবিষ্কারের মতো লাগবে। এটুকু জানা থাকলে সাবলীলভাবে বদলে যাবে একালের কফি হাউসের কোলাহল বা কলরব। একালে যেমন হয়। আড্ডাটা বাঙালির পকেটমারি হয়ে গেছে।
তবে এই বইয়ের শীর্ষক দেখে পুরো বর্ণমালা বোঝা যাবে না। গেরুয়া ভারতের গৈরিক নেতামন্ত্রীরা কেন কী বলছেন, কত কী ভাবছেন সেটা তো বোঝাই যাবে। কিন্তু গান্ধীজি যে বিতর্কে হার মেনেছিলেন বিধান রায়ের কাছে, কিংবা নেহরু যে জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্কেও কতটা আন্তর্জাতিক ও আধুনিক মনস্ক ছিলেন, তাও যে এই গ্রন্থের আকর।প্রধানমন্ত্রী মোদীর সত্যি সত্যি মন কি বাত কী তা যেমন লিখেছেন , তেমনি উচ্চবর্ণ না চণ্ডাল কাদের দখলে আছে এদেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো, সেই ভয়ংকর প্রশ্নেও আলোকসম্পাত করেছেন শুভাশিস। এমন এমন বৈচিত্র্যময় ফুল তুলে এই বইয়ের সাজিতে রেখেছেন লেখক, যে যারা রাজনীতি ও ইতিহাস, সমাজতত্ত্বের বই বড় একটা পড়েন না তাদের সঞ্চয়ে রাখার মতো। এত ভাল বইয়ের প্রসঙ্গ আছে এখানে যেগুলো পড়ে সত্যিই মনে হবে অনেক বই পড়ার আগে এটাই পড়ে নেওয়া যাক। যাতে পাঠ্য আর অপাঠ্য সম্পর্কে একটা দিকদর্শন মিলবে। গান্ধীকে কেন “খুন করেও মুছে দেওয়া গেল না,”এটা তো জানতে হবে এই প্রজন্মকে। নাহলে গডসেকে গড বানানোর লখনৌভি ভুলভুলাইয়ায় ফেঁসে থাকতে হবে সারা জীবন। এই বইয়ে বামপন্থীদের সমালোচনার পাশাপাশি আছে বিরল মূল্যায়ন। দিল্লিতে বা কলকাতায় এমবেডেড বা অনুপ্রাণিত সাংবাদিকতার মরশুমে মরশুমি মাশরুম নন অনেকেই। শুভাশিসও নন। তাই ইস জমানেকী তকাজা, এই সময়ের চাহিদা, তিনি বাংলার রাজনৈতিক হ্যাংলাদের নিয়ে লিখুন। এই বইয়েও একটুকু ছোঁয়া , একটুকু কথা থাকলে তাই নিয়ে মনে মনে “রচি মম ফাল্গুনী” নাহয় হতো।