GeneralHealthIndiaSambad Matamat

আরোগ্য নিকেতন মার্গে ইরিম একলব্য 

সুবীর পাল, কলকাতা:

মান্যতার মার্গে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত ‘আরোগ্য নিকেতন’ সাহিত্যকর্মটি বাংলার এক যুগান্তকারী লেখ্যভূমি। সাম্প্রতিক কালেও প্রায় আরও এক অনুকরণীয় আদর্শভূমি রয়েছে। যার একলব্য মন্ত্রে দীক্ষিত ‘ইরিম’।

বর্তমানে যা কিছু বাজারজাত শব্জি দেখা মেলে তার সবটাই এখন উচ্চ ফলনজাত হাইব্রিডে পরিপূর্ণ। যা রাসায়নিক সার ও ওষুধ প্রয়োগে সমৃদ্ধ। এতে চাষযোগ্য জমির যেমন ক্ষতি তেমনই ক্ষতিকর ফলনের প্রতিপাদ্য। আর এই রাসায়নিক সারবত্তা খাদ্য হিসেবে ক্রমাগত আমাদের শরীরে দখলদারির কাজ করে চলেছে নিত্যদিন। যা অনেকটা স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধে মনুষ্য শরীরের চর্বিতে। ফলে অধুনা সমাজের আবালবৃদ্ধবনিতা বহু দূরারোগ্যের শিকারের সন্মুখীন হচ্ছেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে। এই সতর্কীকরণ কিন্তু আমেরিকা প্রবাসী আপাদমস্তক বাঙালি সাংবাদিক সুকুমার রায়ের।

গাড়িতে বসেই এই কথাগুলো যখন বলছেন সুকুমারবাবু তখন তাঁর পাশের আসনে বসা ইউরোপীয় ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের প্রবীণ ভারতীয় দিকপাল খুরশিদ বক্ত চৌধুরী উদ্বেগ নিয়ে বলে উঠলেন, তাহলে উপায় ? গাড়িটি ততক্ষণে হাওড়ার মৌড়ীগ্রামের রেলস্টেশনের গা ঘেঁষা ইন্ডিয়ান রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিন (ইরিম) নামক অবাক করা প্রতিষ্ঠানের গেটের সামনে এসে হাজির। মার্কিনবাসী তৎক্ষণাৎ ইরিমের অভিমুখে তর্জনী উঁচিয়ে মন্তব্য করলেন, এই তো মুশকিল আসান। প্রকৃত ভেষজের মক্কা মদিনা যে এখানেই উপস্থাপিত।
মানে ? ইরিম আবার কি ? খায় না মাথায় দেয় ? এই প্রশ্নগুলো যখন সুনামির মতো মস্তিষ্ককে বিব্রত করেই চলেছে তখন বিনম্রতার সঙ্গে এগিয়ে এলেন ইরিমের প্রাণপুরুষ তথা ভারত বিখ্যাত আকুপাংচার চিকিৎসক ডাঃ দেবাশিস বক্সি। মধুর সরবৎ সহযোগে সপারিষদ অতিথি আপ্যায়ন সেরে তিনি বলেন, এসেছেন যখন তখন না হয় অনুগ্রহ করে পরখ করুন ইরিমেরই গুপ্তধন।
খুল যা সিম সিম, মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে ইরিমের মূল ভবণের ছাদে উপস্থিত হতেই চক্ষু যে চড়কগাছ। একি! এ যে সবুজের প্রকৃতই প্রাকৃতিক গুপ্তধন। মেটালের তৈরি থরে থরে অতি সযত্নে জ্যামিতিক আকারে সাজানো অজস্র থ্রিটায়ার বেড। তাতে নিপুন কৃষ্ণকায় রঙের গাঢ় প্রলেপ। মধ্যেকার প্রায় ভরাট মাটিতে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ এখানে প্রাচীন কালের ছায়া মারানোর মতো প্রবল নিষিদ্ধ। শাক সব্জির বাহারি ফলনে কি নেই? টমেটো থেকে লাউ, ফুলকপি হতে শসা, বেগুন সহ করোলা। প্রতিটি গাছ গাছালি কি সবুজ আর কি সবুজ। এখান থেকেই সংগৃহীত হয় ইরিমের নিত্যদিনের আহারাদির কাঁচা জোগান। পুরো ছাদ যেন নৈঃশব্দে রচিত হয়েছে মেক্সিকান সবুজ বিপ্লবের এক অনুচিত্রে।
ইরিমের আশ্চর্যের ছাদের মতোই ইন্ডিয়ান রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিনের অন্দরমহলও যেন অল্টারনেটিভ মেডিসিনের সপ্তর্ষিমন্ডলের সমাহার। কোথাও রয়েছে যোগা সেন্টার তো কোথাও আবার মেডিটেশনের নিভৃত কক্ষ। প্রাকৃতিক চিকিৎসার নানান উপকরণ তো ফিজিওথেরাপির অজস্র প্রক্রিয়া বিদ্যমান। উজ্জ্বল ভাবে যেখানে উপস্থাপিত আকুপাংচারের অত্যাধুনিক চিকিৎসা সুযোগ সেখানেই ঘটে নেশামুক্তির অনন্য সাধন। সবটাই কিন্তু নারী ও পুরুষের দ্বিবিভাগে বিভক্ত। সঙ্গে সাময়িক চিকিৎসার জন্য আউটডোর ও প্রয়োজনে ভর্তির জন্য ইনডোর ফেসিলিটিও সমান পর্যায়ে পরিচালিত হয় সর্বসাধারণের বহণযোগ্য খুবই স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে। ভেষজ আহারের সুবিধা সহ অতিথি আবাসেরও উপকরণ এখানে সমানভাবে উজ্জ্বল। এমন একটি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে অল্টারনেটিভ মেডিসিনের রকমারি বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, গবেষণা কেন্দ্র ও উপরি পাওনা হিসেবে বনৌষধির বহুল চর্চার সুযোগ। বোনাস হিসেবে একটা সুপরিকল্পিত সুন্দর ও সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাগার অবশ্যই নজর তো কাড়ে।

সংস্থার কর্মকর্তী সুজাতা পাল জানালেন, ইরিমের যাত্রাপথ শুরু ১৯৮১ সালে। আনুমানিক দুই হাজার বর্গমিটার অঞ্চল জুড়ে চলেছে তাঁদের এই অনির্বাণ কর্মরজ্ঞ। প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা ডাঃ দেবাশিস বক্সির ভাষায়, নিজের শরীর নিজের কাছে সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। তাকে জানুন। তাকে চিনুন। আসলে নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়ে ইরিম সেই জানানোর কাজটা সঙ্গে সেই চেনানোর শপথটাই অমৃত মন্থনের মতো করে চলেছে সাধারণ মানুষের অন্তঃস্থলে।

না, ইরিম কোনও বিজ্ঞাপনের গল্পের গরু গাছে উঠানোর প্রয়াসের নিমগ্ন আজও হয়নি। যার চুড়ান্ত সত্যতার দলিল ইরিমের আস্তিন থেকে সকলকে চমকে দিয়ে বেরিয়ে এলো, যখন দেখা গেল অন্যতম আবাসিক মধুদাদু দুপুরে একমনে গল্পের বই পড়ছিলেন। উনার প্রকৃত পরিচয় কৃষ্ণদাস মুখোপাধ্যায়। মধুচাষ ও মধুভিত্তিক একাধিক গবেষণায় লিপ্ত থেকেছেন জীবনের অধিকাংশ অধ্যায়েই। এখনও নিয়মিত তিনি মধু খান নানা পর্যায়ে। অথচ সারাদিনে একবার আহারাদি সারেন। উনার বয়স কত জানেন? তিনি বলেন, বয়স তাঁর ৯৭। এই বয়সেও প্রায় নিরোগ। মন ও শরীর তো তারুণ্যের ধনুকছিলা সম। এক গাল হেসে তিনি বললেন সেই পরম আপ্তকথাটি, আমরা তো সবাই প্রকৃতিরই সন্তান। তাকে অবজ্ঞা করলে প্রকৃতিও আপনাকে বুড়ো আঙুল দেখাবে। তাকে বন্ধু ভেবে আপন করে নিন দেখবেন প্রকৃতিও আপনার পরম সাথী হয়ে উঠেছে। আসলে ইরিমের এহেন আবাসিকের নিঃরোগ দীর্ঘ জীবনের মূল বীজমন্ত্র হলো মধুময় প্রাকৃতিক বান্ধবতা। এটাই এই সংস্থার অআকখ।

এলেন। দেখলেন। আর এরিম পরখ করতে করতে একটা বহুল পরিচিত সুর গুনগুনিয়ে উঠলেন পঁচাশি বছরের স্বভাবসিদ্ধ তরুণ শিল্পউদ্যোগী খুরশিদ বক্ত চৌধুরী। নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়। আচমকা এই সময়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এই গান! মুখে কিছু না বলে তিনি শুধু হাসলেন। এই হাসিটার তাৎপর্য কিন্তু অনেক কিছুরই ইঙ্গিত বহণ করে। তাৎপর্যের অর্থ এটা নয়তো, কোনও এক অখ্যাত জনপদ মৌড়ীগ্রামের মাত্র দুই হাজার বর্গমিটার জমির কড়িকাঠে আবদ্ধ হতেই পারে ইরিমের দৃশ্যত অবয়ব। কিন্তু তার জীবনদায়ী ভেষজ মনন ও ঔষধহীন চিকিৎসা চিন্তন এই বিশ্বালয়ে হাসিছ খেলিছ তুমি আপন সনে, নিরজনে প্রভু নিরজনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.