GeneralIndiaSambad MatamatSports

দুর্গাপুর উৎসব: সবুজ তোতার নামকরণে আলোকের লক্ষ ঝর্ণাধারা

সুবীর পাল, দুর্গাপুর

ভারতীয় রূঢ়ের কপালে নামকরণের রাজতিলক এঁকে দিলেন ব্রাজিলীয় সবুজ তোতা। আর সাঁঝে ব্রহ্মলগ্নে এক লক্ষাধীক প্রদীপ শিখায় জ্বলে উঠলো চিমনি শহরের এক অভিনব মার্গীয় আলোকের ঝর্ণাধারা।

অতীতের আরশি থেকে বর্তমানের বহমান চাহনিতে ৩ ডিসেম্বরের নির্যাস লিখন ছিল যে এটাই। ভারতের শিল্পশহর দুর্গাপুরের নক্সিকাঁথায়। ছুটি ছুটি রবিবাসরীয় মেজাজে যেখানে অগ্রহায়নের লাজুক শিশির রোদ্দুরকে করে তোলে নম্র হিমেল, এমনই সকালে বিশেষ অতিথি হয়ে সটান হাজির সবুজ তোতা। দুর্গাপুরের নগর মানচিত্রে। সাম্বা দেশের ফুটবল তেকাঠির ওস্তাদ হোসে ব়্যামিরেজ ব্যারেটো যে মোহনবাগানের সবুজ তোতা হিসেবেই পরিচিত।

সবুজ তোতা এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন। হ্যাঁ জয় করে নিলেন নগরবাসীর আপন হৃদয়ের একমুঠো সুনামি উচ্ছ্বাস। বিনিময়ে রেখে গেলেন একটি স্মরণীয় ফলক। যে জ্বলজ্বলে ফলকে চিরতরে লেখা থাকবে এই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের নাম। দুর্গাপুরের সড়ক আলপনায়। নামকরণের আঙিনায়। সে প্রায় বছর পনেরো তো হবেই। আসানসোল দুর্গাপুর ডেভেলপমেন্ট অথরিটির তদানীন্তন কর্তৃপক্ষ দুর্গাপুর শহরতলীর সামগ্রিক অবয়ব ঘিরে একটি রিং রোড নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল। তারপর যা হবার তাই হয়েছিল। স্থানীয় সরকারি কলেজ থেকে একটি বেসরকারি হাসপাতাল পর্যন্ত রাস্তার কাজ গড়িয়ে ছিল ঠিকই। কিন্তু ওই পর্যন্তই। না আর সম্প্রসারণ ঘটেছিল। না হয়েছিল রাস্তাটির নামকরণ। এতোগুলো বছর অগত্যা পরিচয়হীন ভাবেই কেটে গেছে এই শহুরে সড়কের দুয়োরানি দশা। প্রায় আড়াই কিলোমিটার লম্বা এই কংক্রিট যাত্রাপথ এদিন পেল নবতম নামের তকমা। ‘মোহনবাগান এভিনিউ’ নামকরণে। উদ্বোধক ব্যারেটোর রাজকীয় উপস্থিতিতে। রাজ্য পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারের আন্তরিক সহচর্যে। মোহনবাগান ফ্যানস ক্লাব দুর্গাপুরের ঐকান্তিক উদ্যোগে। পিচের তৈরি এই জনপদের নামকরণ অনুষ্ঠানে সবুজ তোতা বলেন, “আজকে দুর্গাপুরের এই রাস্তার নামকরণ অনুষ্ঠানে উদ্বোধন করাটা আমার সারাজীবনে স্মৃতি হয়েই থাকবে। আমি বাংলাকে ভালবাসি। মোহনবাগান আমার হৃদয়ের স্পন্দন।”

আমাদের দেশের জাতীয় ক্লাব হলো মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব। আবার জার্মানির রূঢ় শহরের অনুকরণে ভারতের রূঢ় বলতে একবাক্যে দুর্গাপুরকেই বোঝেন সমগ্র বিশ্বের তাবড় পুঁজি নিবেশকারীরা। একটা রাস্তাকে সাক্ষী রেখে তাই জাতীয় ক্লাবের সঙ্গে দেশীয় রূঢ়ের এই নামকরণের মেলবন্ধন নিয়ে যথেষ্টই আপ্লুত রাজ্য পঞ্চায়েত মন্ত্রী। প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “মোহনবাগান এভিনিউ নামকরণটা হলো এই শহরের অহংকার। ব্যারেটোর হাত ধরে এই উদ্বোধন তো প্রকৃতই গর্বের অধ্যায়।”
আড়াইশো বছর আগেকার কথা। তৎকালীন যুগে স্থানীয় সগরভাঙার জমিদার ছিলেন দুর্গাচরণ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর না অনুসারে তাঁরই জমিতে ১৮৫৫ সালে নির্মিত হয়েছিল রেলওয়ে স্টেশন। যার নাম হয় দুর্গাপুর। শাল, মহুয়া গাছের ছায়া ঘেরা সেই রেলস্টেশন পরিবৃত্তে পরবর্তী কালে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় গড়ে তোলেন তাঁর স্বপ্নের শিল্পনগরীকে একেবারে ভাড়ি শিল্পের পরিকল্পিত পীঠস্থান হিসেবে। এরপর নানা অধ্যায়ে দুর্গাপুর শুধু রাজ্যে নয়, পশ্চিমবঙ্গের বহিরাংশে ভারতে বিনিয়োগের মক্কা মদিনায় রূপান্তরিত হয়েছে। জঙ্গলমহলের আবহকে পিছনে ফেলে। নগরায়ণের অভিযোজনে।

সেই শিল্পশহুরের অতীতকে জনসমক্ষে পুনরায় চাগিয়ে তুলতে, আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ফের সাম্প্রতিক দর্পনে চিচিং ফাঁক করতে, এলাকার ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক রীতিকে আবার গণদেবতার দরবারে সম্মুখীন করতে তো প্রয়োজন একটা সুষ্ঠু আয়োজনের। আর সেই সুষ্ঠু আয়োজনের সলতেটা জ্বালিয়ে দিল দুর্গাপুর উৎসব কমিটি। ‘দুর্গাপুর উৎসব’ প্রেক্ষাপটে। রাজীব গান্ধী মেমোরিয়াল গ্রাউন্ডে। চলবে টানা ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। রকমারি জমকালো সাংস্কৃতিক পশরায়। অজস্র কর্পোরেট স্টল, দর্শকদের উৎসাহের বহুবিধ কেনাবেচার স্টল এই আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ। দুর্গাপুর প্রেস ক্লাব, বেঙ্গল ডিজিটাল মিডিয়া ফাউন্ডেশন, নিউজ টেন’এর স্টলগুলিও জৌলুস বাড়িয়েছে এহেন উদ্যোগের।

শহরের পশ্চিম আকাশে সূর্যদেব অস্তাচলগামী হতেই রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার এদিনের সাঁঝবেলায় সদর্পে ঘোষণা করলেন, “শহর জুরে এই অনুষ্ঠান চত্বর সহ ইস্পাত নগরীর দিকে দিকের জনপদে এখন প্রজ্জ্বলন করা হবে এক লক্ষ প্রদীপ।” হলোও তাই। শীতকাতুরে আকাশের একছত্র অন্ধকারকে কার্যত বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে এক লক্ষ প্রদীপ জ্বলে উঠলো এক লহমায়। আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণের এই দুর্গাপুর উৎসবের সুচনাপর্বে ততক্ষণে হাজির রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক, পান্ডবেশ্বরের বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। মূলমঞ্চে তখন সশরীরে উপস্থিত চলচ্চিত্রের নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। থিকথিক করছে উদ্বেলিত জনজোয়ার। এরইমধ্যে মলয়বাবুর কন্ঠে শোনা গেল, “দুর্গাপুর উৎসবের আঙ্গিক হলো এই শহরের স্বভিমান। এখানকার কৃষ্টি আজ বিশ্ববন্দিত।” আগত দর্শকদের দিকে হাত নাড়াতে নাড়াতে নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বলেন, “এই উৎসবের আভিজাত্যই আলাদা। এই শহর আমাকে বারবার টেনে এনেছে। দুর্গাপুর উৎসবে যোগ দিতে পেরে আমি ধন্য।” পরিশেষে মধুরেণ সমাপয়েৎ হিসেবে সঙ্গীতশিল্পী জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের গান অনুষ্ঠানের উত্তাপ বাড়িয়েছে বৈকি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.