আমরা সবাই বাদশা আমাদের এই বাদশার রাজত্বে

সুকন্যা পাল, দুর্গাপুর
“দুর্গাপুর নগর নিগম এলাকা যদি আমার সামগ্রিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হয়, তবে ‘বাদশা’ হল আমার একান্ত অন্তরাত্মা। এখানকার আবাসিক গুরুজনদের বিভিন্ন জীবন অভিজ্ঞতা আমাকে সমৃদ্ধ করে। আমাকে প্রেরণা দেয়।” মাত্র দিন দুই আগে প্রকাশ্যে এমন প্রানময় মন্তব্য দুর্গাপুরের প্রথম নাগরিক তথা মেয়র অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়ের। যার আবর্তে শিল্পনগরীর মেয়রের এহেন হৃদয় গাঁথা বক্তব্য, সেই ‘বাদশা’ বা ‘বর্ধমান ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি ফর হিউম্যান অ্যাক্টিভিটিস’ আসলে একটি বৃদ্ধাবাসের আদুরে নাম। রূপসী বাংলার রূঢ় অঞ্চলের ইস্পাত নগরীর এক বৃদ্ধাবাসের যে এটাই অহংকারী পরিচিতি। ২০০৫ সাল। স্থানীয় ভূমি মানুষ মানবেন্দ্র মন্ডল, সুনীল মুখোপাধ্যায়, সুকুমার রায়, চন্ডী কোনার, শংকর রায়, দীপক মন্ডল সহ বেশকিছু সুধীজন সেদিন ভেবেছিলেন, এই চিমনি এলাকায় একটা বৃদ্ধাবাস গড়ে তুললে কেমন হয়। ব্যাস, ভাবনার ক্যানভাসে লাগলো বাস্তবতার রঙিন রামধনু ছোপ। ধীরে ধীরে গড়ে উঠল ‘বাদশা’। এদিকে বাদশার পথ চলার নুপুরে সিম্ফনির বোলে বেজে উঠলো আরও এক একতারা বাউল মনে । সকলকে আত্মীয়তার বন্ধনে যুক্ত করেছিলেন প্রথিতযশা সাংবাদিক সুকুমার রায়। একদা এই শহরের বাসিন্দা হলেও আপাদমস্তক এই ভারতীয় বর্তমানে কিন্তু আমেরিকার ফ্লোরিডায় ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়’ গান গেয়ে থাকেন অবিরাম। তিনি বাদশার প্রেসিডেন্ট ।
৮ই মে বাদশার অনুষ্ঠান ও বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবসে বাদশায় একটি মনোজ্ঞ আলোচনা সভায় বক্তারা বক্তব্য রাখছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকার প্রসঙ্গে। প্রানঞ্জল ভাষায় একটু আগেই বক্তব্য রেখেছিলেন ডা. দেবাশিস বক্সি, তিনি হাওড়ার মৌরীগ্রামে অব অবস্থিত আইআরআইআইএম (IRIIM)-এর অধ্যক্ষ, মিশন হাসপাতালের ডা: পার্থ পাল, বিবেকানন্দ হাসপাতালের ডা:এস কে সরকার, ডা: দেবাশিস চ্যাটার্জি প্রমুখ । ডায়াসের একাসনেই তখন বসেছিলেন এই শহর-মেয়র অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়, সাংসদ সুনীল মন্ডল, বোড়ো চেয়ারম্যান রমা হালদার ও প্রবীণ সমাজকর্মী সুদেব রায়। অনুষ্ঠানের স্টপগ্যাপে অবশ্য ততক্ষণে সঙ্গীত পরিবেশন করে ফেলেছেন দুই প্রবীণা আবাসিক ঝর্ণা মুখোপাধ্যায় এবং পুতুল সেন। একজনের কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ঝরঝর মুর্ছনা তো অপরজনের সুরে শ্রীরামকৃষ্ণের পবিত্র বন্দনা। আর তাতেই বাদশার বেতাজ মুকুটে মূহুর্তে উদ্ভাসিত হয়েছিল জীবন-সংস্কৃতির নানান আঙ্গিকের এক মিশ্র পারিবারিক ককটেল। বুঝে নিতে এখানে মোটেও তাই অসুবিধা হয়নি, সমাজের রকমারি স্তর থেকে উঠে আসা প্রবীণ-প্রবীণারা এখানে হাজির হয়েছেন বৃদ্ধাবাসে নয়, আসলে জড়ো হয়েছেন এক লাল নীল সবুজের অকৃত্রিম হরিহর হট্টমেলায়। যেখানে আছে হাসি দুঃখ সুখ আনন্দ পরস্পরে ভাগ করে নেওয়ার এক অপার প্ল্যাটফর্ম। যেখানে আছে সুস্থ সংস্কৃতির সঙ্গে মানবিক স্পন্দনগুলো খুঁজে নেওয়ার এক ‘বয়স তুবড়ি মারার’ বৃত্তময় সাতনুড়ি গলার হার। এদিকে আলোচনায় অংশ নিয়ে একটু ভিন্ন পর্যায়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সুকুমার রায় বলেন, “আমরা আবাসিকদের কাছে সাধারণত কোনও অগ্রিম নিই না। এমনকি সর্বনূন্যতম হিসেবে আমরা কিছু আবাসিকদের কাছে মাসিক মাত্র আড়াই হাজার টাকা নিয়ে থাকি খাওয়া ও থাকা বাবদ। যা বহু বৃদ্ধাবাসের কাছে এই বিষয়টা আজকের দিনে ভাবনার অতীত।” তিনি আরও সংযোজন করেন, “বাদশায় যা ঘাটতি হয় তা বিভিন্ন অনুদান থেকে ভারসাম্য বজায় রাখা হয়। কিছু প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় প্রশাসন এবং রাজ্যের সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য , প্রাক্তন সাংসদ প্রয়াত অবনী রায় ও বরুন মুখার্জি মহাশয়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করতে পেরেছি। আমাদের কাজ অনেক অনেক অনেকাংশে বাকি। বাদশাকে সমৃদ্ধ করাই যে আমাদের কাছে এখন অর্জূণের পাখির চোখ।”
আলোচনার আসর যখন মধ্যগগণে তখন একটু পাশেই ‘আমার হাত ধরে নিয়ে চলো সখা’ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে চলছিল রক্তদান শিবির, চক্ষু চিকিৎসা শিবির এবং সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির। বিবেকানন্দ হাসপাতাল ও নেশন হাসপাতালের সহচর্যে এই শিবিরগুলোতে সাধারণ মানুষের উৎসাহ কিন্তু বেশ নজর কাড়া। মেয়র অনিন্দিতা দেবী রক্তদাতাদের মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছেন পরমতম স্নেহে। আসলে তাঁর মমতা-স্পর্শে তিনি বুঝিয়ে দিলেন উপস্থিত বাদশার আবাসিকদের, ‘আমি তোমাদেরই লোক।’
সাংসদ সুনীল মন্ডল এর আগেও বাদশায় এসেছেন মনের আহ্বানে। আপন আনন্দে। তাই তো তিনি বলে উঠলেন কথা প্রসঙ্গে, “বাদশার সঙ্গে আমার সংযোগ শুধু একদিনের নয়। বহুদিনের। বাদশার মঙ্গল কামনা হল আমার শ্বাস প্রশ্বাস। আমি অবশ্যই সমাজের মানবমন বন্ধুদের কাছে আবেদন করবো, আপনারা এগিয়ে আসুন বাদশার উন্নতি সাধনে। আমি নিজেও কিছু সাংসদকে একই অনুরোধ করবো।”
অতিথিদের উপস্থিতি, আলোচনাচক্র, রক্তদান ও স্বাস্থ্য শিবির, আবৃত্তি ও সঙ্গীত পরিবেশন সঙ্গে মধুরেণ সমাপ্তি হিসেবে একটু হৈ চৈ করা সবাই মিলে মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন, সবই যেন চলছিল নিখুঁত পরিশীলিত অভ্যাসে। কিন্তু তারই মধ্যে সাগর মন্থনে অমৃত ভান্ডের ন্যায় আসল কথাটি বলে ফেললেন নাম প্রকাশে এক অনিচ্ছুক আবাসিক। তাঁর নিজস্ব মনচারিতা, “আপনারা কি ভাবেন বলুন তো? বাদশার কি শুধু একটা নাম? বাদশা কি স্রেফ একটা বৃদ্ধাবাস ? ভুল ভুল, বুঝলেন। আসলে এখানে ‘বাদশা’ অর্থ কি জানেন?” বিরবির করে আপন খেয়ালে আচমকা এবার মেলোডি গেয়ে উঠলেন, “আমরা সবাই বাদশা আমাদের এই বাদশার রাজত্বে, নইলে মোদের বাদশার সনে মিলব কি স্বত্বে ?
Pingback: আমরা সবাই বাদশা আমাদের এই বাদশার রাজত্বে – Badsha Old Age Home